২৮ এপ্রিল ২০২৪, রবিবার, ০৯:০৯:২৪ অপরাহ্ন
দুষ্টচক্রেই বেসামাল নিত্যপণ্যের বাজার
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৭-০৭-২০২৩
দুষ্টচক্রেই বেসামাল নিত্যপণ্যের বাজার

বাজারের স্বাভাবিক নিয়মে চাহিদার তুলনায় পণ্যের সরবরাহে ঘাটতি থাকলে দাম বাড়ে। আবার আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়লেও দেশে বাড়তে পারে। কিন্তু বাংলাদেশের বাজারে কোনো নিয়মই খাটে না। এখানে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম ওঠানামা করে প্রধানত বড় ব্যবসায়ীদের ইচ্ছায়। দ্রব্যমূল্য-সংক্রান্ত জাতীয় টাস্কফোর্সের সর্বশেষ প্রতিবেদনে দেখা যায়, আন্তর্জাতিক বাজারে কোনো কোনো পণ্যের দাম কমলেও দেশে উল্টো বেড়েছে। কিছু ক্ষেত্রে বিশ্ববাজারের তুলনায় কমেছে সামান্য। আবার বিশ্ববাজারে মূল্যবৃদ্ধির তুলনায় দেশে বেড়েছে অনেক বেশি।


ওই প্রতিবেদনমতে, গত এক বছরে আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত সয়াবিন তেলের দাম লিটারপ্রতি কমেছে ৪৪ শতাংশ। অথচ দেশে কমেছে বোতলজাত সয়াবিনে শূন্য দশমিক ২৫ শতাংশ, খোলা সয়াবিনে ২ দশমিক ১৭ শতাংশ। যদিও ভোজ্যতেলের মজুত চাহিদার তুলনায় ২ লাখ ৩০ হাজার টন বেশি। এ ছাড়া আদার দাম বিশ্ববাজারে ১৭২ শতাংশ বাড়লেও দেশে বেড়েছে ২২২ দশমিক ২২ শতাংশ। অবশ্য আদার ঘাটতি ৭৭ হাজার টন।


মে মাসে হঠাৎ করে পেঁয়াজের দাম বেড়ে গেলে বাজার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে কৃষিমন্ত্রী জানিয়েছিলেন, দেশে চাহিদার চেয়ে বেশি পেঁয়াজ উৎপন্ন হয়েছে, যথেষ্ট মজুত আছে। বিশ্লেষকদের মতে, আমদানি বন্ধ থাকার দোহাই দিয়ে, সরবরাহ সংকট দেখিয়ে তখন পেঁয়াজের বাজার অস্থির করে তোলা হয়েছিল। পরে আমদানির ঘোষণা আসতেই দাম অনেকটা কমে যায়। সম্প্রতি একই চিত্র দেখা গেছে কাঁচা মরিচের ক্ষেত্রেও।


জাতীয় টাস্কফোর্সের প্রতিবেদনমতে, এক বছরে পেঁয়াজের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে ৬৩ শতাংশ কমলেও দেশে বেড়েছে ৯৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ। অথচ দেশে পেঁয়াজের মজুত চাহিদার তুলনায় ১০ লাখ ৯২ হাজার টন বেশি।


ভোক্তা অধিকার সংগঠক ও অর্থনীতিবিদেরা মনে করেন, ভোগ্যপণ্যের বাজারে অস্থিরতার জন্য কয়েকটি করপোরেট প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণই দায়ী। সরকারও এদের কাছে অসহায়। জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরও বিভিন্ন সময়ে বিষয়টি স্বীকার করেছে।


অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান গত মঙ্গলবার আজকের পত্রিকাকে বলেন, নিত্যপণ্যের বাজারে এক ধরনের অদৃশ্য শক্তি কাজ করে। এই অদৃশ্য শক্তির বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া না হলে নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব নয়।


শিল্প প্রতিমন্ত্রী কামাল আহমেদ মজুমদার মে মাসে এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, ‘আমি অনেককে দেখেছি, বাজার করতে গিয়ে কাঁদছেন। কারণ, বাজারের যে অবস্থা তার পকেটে সে টাকা নেই। এটার একমাত্র কারণ সিন্ডিকেট।’


ভোগ্যপণ্যের বাজার অস্থিতিশীল করার ক্ষেত্রে বড় ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট বা অসাধু চক্রের কারসাজি থাকার বিষয়টি অস্বীকার করেননি দ্রব্যমূল্য-সংক্রান্ত জাতীয় টাস্কফোর্সের সভাপতি ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব তপন কান্তি ঘোষ। তবে ব্যবসায়ী চক্রের নিয়ন্ত্রণ থেকে বাজারকে মুক্ত করার ক্ষেত্রে সরকারের ভূমিকার বিষয়টি তিনি এড়িয়ে যান। তপন কান্তি ঘোষ গত মঙ্গলবার বলেন, ‘ব্যবসায়ীরা বেশি দামে পণ্য বিক্রি করছে বা লাভ করছে, এটা ঠিক। তবে তাদের চ্যালেঞ্জ করতে হবে। নিত্যপণ্যের ব্যবসায় নতুন বিনিয়োগকারী আসতে হবে। তারা এলে সরকারের পক্ষ থেকে সহযোগিতা করা হবে। কিন্তু এই খাতে নতুন কেউ আসছে না।’


জানা যায়, ভোজ্যতেল নিয়ন্ত্রণ করছে মূলত সিটি, মেঘনা, এস আলম, টিকে গ্রুপ, এসিআই, বসুন্ধরা ও বাংলাদেশ এডিবল অয়েল লিমিটেড। চিনির বাজার নিয়ন্ত্রণে আছে সিটি, মেঘনা, এস আলম, দেশবন্ধু ও আবদুল মোনেম গ্রুপ। আটার বাজারও নিয়ন্ত্রণ করছে সিটি, মেঘনা, টিকে, এসিআই, বসুন্ধরা, এস আলম, নাবিল গ্রুপসহ চট্টগ্রামের কয়েকটি প্রতিষ্ঠান।


আমদানিকারকদের দাবি, ডলারের মূল্যবৃদ্ধি এবং ডলার-সংকটে সময়মতো ঋণপত্র খুলতে না পারায় কিছু পণ্যের ঘাটতি আছে। বাংলাদেশ সুগার রিফাইনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও মেঘনা গ্রুপের চেয়ারম্যান মোস্তফা কামাল বলেন, সব ধরনের পণ্য আমদানি সবার জন্য উন্মুক্ত রয়েছে। কেউ যদি মনে করে, পণ্য আমদানি করে মোটা অঙ্কের লাভ করা যায়, তাহলে তারা আমদানি করে দেখুক। অনেকেই ব্যাংক ঋণে দেউলিয়ার পথে।


টিকে গ্রুপের পরিচালক সফিকুল আথহার তসলিম বলেন, গত এক বছরে ডলারের দাম বেড়েছে ৩৪-৩৮ শতাংশ। আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম ৩০ শতাংশ কমলেও দেশে আরও ৮ শতাংশ ঘাটতি থাকছে।


পণ্যের দাম বাড়ার ক্ষেত্রে ডলার-সংকট একমাত্র কারণ হতে পারে না বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন। তিনি আজকের পত্রিকাকে বলেন, অনেক সময় ভরা মৌসুমেও চালের দাম বেড়েছে। দেশে পণ্য বিক্রির ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা কম। পণ্য আমদানির সঙ্গে জড়িতরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকেন। তাঁর মতে, বাজার কারসাজির সঙ্গে বড় ব্যবসায়ীরাই জড়িত।


বাংলাদেশ এডিবল অয়েল রিফাইনার্স ও বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি মোস্তফা হায়দার বলেন, ‘করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো যদি সিন্ডিকেট হয়ে থাকে, তাহলে সেটি প্রমাণ করতে হবে। আমরাও চাই, বাজারে আরও উদ্যোক্তা তৈরি হোক।’


টাস্কফোর্সের প্রতিবেদনে দেখা যায়, এক বছরে অপরিশোধিত চিনির দাম আন্তর্জাতিক বাজারে ৩৩ শতাংশ বাড়লেও দেশে বেড়েছে ৫৭ দশমিক ৫৮ শতাংশ। চাহিদার তুলনায় চিনির মজুত ৭২ হাজার টন কম। আন্তর্জাতিক বাজারে এক বছরে গমের দাম কমেছে ৩৫ শতাংশ। আর দেশে আটার দাম বেড়েছে ১২ দশমিক ৬৩ থেকে ২৫ শতাংশ পর্যন্ত। অথচ গম আমদানিতে কোনো শুল্কও ধার্য নেই। তবে চাহিদার তুলনায় ২৪ লাখ ১১ হাজার টন গম কম আমদানি হয়েছে। মসুর ডালের দাম বিশ্ববাজারে ১৯ শতাংশ কমলেও দেশের বাজারে কমেছে ৬ দশমিক ২৫ শতাংশ। ডাল আমদানিতে কোনো শুল্ক নেই। দেশে চাহিদার তুলনায় ২০ হাজার টন বেশি মজুত আছে। বিশ্ববাজারে রসুনের দাম ১৬ শতাংশ কমলেও দেশে কোনো প্রভাবই পড়েনি। চাহিদার চেয়ে ১ লাখ ৯৬ হাজার টন রসুন বেশি মজুত আছে।


টাস্কফোর্স সুপারিশে বলেছে, অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের ক্ষেত্রে টিসিবি বাণিজ্যিক কার্যক্রম বাড়িয়ে বাজার ব্যবস্থাপনায় ইতিবাচক প্রভাব রাখতে পারে; বাজার ব্যবস্থাপনায় প্রতিযোগিতা বাড়াতে প্রতিযোগিতা কমিশন পলিসিগত ও কাঠামোগত ঘাটতি অনুসন্ধান করে করণীয় সম্পর্কে পরামর্শ দিতে পারে এবং অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের সাপ্লাই চেইনের কোন ধাপে বেশি মুনাফা হচ্ছে, তা বের করার জন্য সমীক্ষা করা যেতে পারে। প্রস্তাবিত ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন দ্রুত চূড়ান্ত করা এবং জনবল বাড়ানোরও সুপারিশ করা হয়েছে।


অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেনও মনে করেন, বাজার স্থিতিশীল রাখার ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা কমিশন বড় ভূমিকা রাখতে পারে। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশনের চেয়ারম্যান প্রদীপ রঞ্জন চক্রবর্তী বলেন, অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের সাপ্লাই চেইনে কোন ধাপে বেশি মুনাফা হচ্ছে, সেটি বের করতে তাঁরা সমীক্ষা চালাচ্ছেন। এরই মধ্যে তাঁরা খাতুনগঞ্জ বাজার পরিদর্শন করে কিছু তথ্যও সংগ্রহ করেছেন। অন্যান্য স্থানের তথ্য সংগ্রহের পর তাঁরা সরকারকে জানাবেন।


কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, দেশের অধিকাংশ মন্ত্রীই ব্যবসায়ী। তাঁরা ভোক্তার স্বার্থ না দেখে ব্যবসায়ীদের স্বার্থই বেশি দেখছেন।


সার্বিক বিষয়ে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক গবেষণা পরিচালক ড. এম আসাদুজ্জামান বলেন, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয়হীনতা দূর করতে হবে। ডলার-সংকট দূর করতে পদক্ষেপ নিতে হবে। নতুন বিনিয়োগকারীদের প্রয়োজনে প্রণোদনা দিতে হবে। তিনি বলেন, শুধু বাজার তদারকি করে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। বাজারে অসমতা দূর করতে গবেষণা করতে হবে। একই সঙ্গে বাজারে প্রতিযোগিতা তৈরি করতে হবে।


শেয়ার করুন