২৮ এপ্রিল ২০২৪, রবিবার, ০৮:৪৪:২৭ অপরাহ্ন
মর্যাদার ঠিকানা মডেল মসজিদ
  • আপডেট করা হয়েছে : ১৫-০৭-২০২৩
মর্যাদার ঠিকানা মডেল মসজিদ

দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় চালু হওয়া মডেল মসজিদ ও ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্রগুলো নতুন পরিচিতি দিচ্ছে স্থানীয়দের। সংশ্লিষ্ট এলাকায় এসব স্থাপনা একেকটি মাইলস্টোন হিসেবে জনগণের মধ্যে দ্রুতই স্বীকৃতি লাভ করেছে। ফলে আশপাশের বাসিন্দারা গর্বভরে আপন করে নিচ্ছেন এসব মসজিদ। দেশের চারটি জেলায় চারটি মডেল মসজিদ ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র সরেজমিন ঘুরে এমন চিত্রই মিলেছে।


সারাদেশের জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে ইতোমধ্যে ২০০টি মডেল মসজিদ আনুষ্ঠানিকভাবে চালু হয়েছে। সব মিলিয়ে ৫৬৪টি মসজিদ নির্মাণ করা হবে। এসব কেন্দ্রে অস্থায়ী জনবল নিয়োগ দিয়ে প্রাথমিকভাবে নামাজ পড়ার কার্যক্রম চলছে। স্থায়ী জনবল নিয়োগ হলে পুরো কার্যক্রম শুরু হবে।


৯ হাজার ৪৩৫ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হচ্ছে। প্রকল্পটি শুরু হয়েছে ২০১৭ সালে। ২০২৪ সালের জুনের মধ্যে সব মডেল মসজিদ ও ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার কথা। মডেল মসজিদ প্রকল্পের পরিচালক নজিবুর রহমান সমকালকে বলেন, চালু হওয়া মডেল মসজিদগুলোতে এখন শুধু নামাজ পড়ার জন্য প্রয়োজনীয় জনবল নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। স্থায়ী জনবল নিয়োগের প্রস্তাব ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে ধর্ম মন্ত্রণালয়ে গেছে। জনবল নিয়োগ হলে মডেল মসজিদ ও ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের পূর্ণরূপ সবাই উপভোগ করতে পারবেন।


সরেজমিন চার মসজিদ


যশোর জেলা মডেল মসজিদটি শহরের মুজিব সড়কে নির্মাণ করা হয়েছে। আগে এই এলাকাটি পঙ্গু হাসপাতাল বা রেলগেট এলাকা নামে পরিচিত ছিল। এখন বলা হচ্ছে ‘মডেল মসজিদ’ এলাকা। শহরের তুলনামূলক নিম্ন আয়ের মানুষের বাস এ এলাকায়। এখানে এত বড় একটি মসজিদ হবে– এলাকাবাসী ভাবতেও পারেননি। গত ৬ মে রাতে এশার নামাজের আগে এবং পরে মসজিদ মহল্লার একাধিক বাসিন্দার সঙ্গে কথা হয় সমকালের।


পাশের মহল্লার বাসিন্দা ব্রাইট বসুর সঙ্গে কথা হচ্ছিল রাত ৮টার দিকে। তিনি হিন্দু ধর্মাবলম্বী হলেও তাঁর এলাকায় মডেল মসজিদ হওয়ায় তিনি উচ্ছ্বসিত। এর কারণ জানতে চাইলে তিনি সমকালকে বলেন, মডেল মসজিদের পাশেই থাকা বিল্ডিংটি পঙ্গু হাসপাতাল। শহরের অন্য এলাকা থেকে আমার বাসায় আসতে গেলে রিকশাওয়ালাকে পঙ্গু হাসপাতালের ঠিকানা বলতে হতো। এই নামটা বলতে আমার ভালো লাগে না, এখন আর সেটা বলতে হয় না। মডেল মসজিদ বললেই সবাই চেনে। এ বিষয়টি আমার ভালো লাগে। মসজিদের ডিজাইনটাও সুন্দর হয়েছে, দেখতে ভালো লাগে। বলতে পারেন মসজিদ হওয়ার পর থেকে আমাদের ঠিকানা পরিবর্তন হয়ে গেছে।


মুজিব সড়কে গত ২৫ বছর ধরে ব্যবসা করছেন জামাল উদ্দিন টিংকু। ওয়েল্ডিং ওয়ার্কশপের এই মালিক জোহর থেকে এশা পর্যন্ত চার ওয়াক্ত নামাজ মডেল মসজিদেই পড়েন। প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তিনি বলেন, খুব সুন্দর মসজিদ হয়েছে। আমাদের এলাকায় এত বড় মসজিদ হবে– চিন্তায়ও ছিল না। এক প্রশ্নের জবাবে জামাল উদ্দিন জানান, মডেল মসজিদের একটি জায়গায় একটু সমস্যা মনে হয়। মসজিদে ঢুকতে ২৫টি সিঁড়ি উঠতে হয়। এলাকার বৃদ্ধদের অনেকে নামাজ পড়তে এলে সিঁড়ি বেয়ে ওঠার কষ্টের কথা বলেন।


তবে মসজিদের পেছনের অংশে লিফটের ব্যবস্থা হয়েছে। প্রথম পর্যায়ে লিফট লাগানো হচ্ছে না। পাশের মহল্লা রায়ের পাড়া থেকে নিয়মিত মডেল মসজিদে নামাজ পড়তে আসেন মাদ্রাসা শিক্ষক রফিক উদ্দিন। তিনি বলেন, অনেক এলাকার মানুষ এ মসজিদটি দেখতে এবং এখানে নামাজ পড়তে আসেন। ব্যাপারটি ভালোই লাগে।


যশোর মডেল মসজিদের অস্থায়ী ইমাম হাফেজ মাওলানা মঈনদ্দীন জানান, গত রমজান মাসে যশোরের বিভিন্ন এলাকায় অনেক নারী মুসল্লি মসজিদে এসে তারাবির নামাজে অংশ নিয়েছেন। মসজিদ প্রতিষ্ঠার প্রথম বছরেই এত নারী মুসল্লি মসজিদে আসবেন, তিনি ভাবতেও পারেননি। জুমার দিনে নারীদের জন্য নির্ধারিত স্থান পূর্ণ হয়ে যায়। নারীদের জন্য অজুখানা, চলাচলের সিঁড়ি পৃথক থাকায় তারা স্বাচ্ছন্দ্যে মসজিদে আসতে পারেন।


যশোরের জেলা প্রশাসক ও পদাধিকার বলে জেলা মডেল মসজিদের সভাপতি তমিজুল ইসলাম খান বলেন, বাংলাদেশের বাস্তবতায় নারীদের মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়ার পরিবেশ খুব একটা নেই। এখন দেশের প্রত্যেক জেলা ও উপজেলায় মডেল মসজিদ স্থাপনের মাধ্যমে সেই সুযোগ তৈরি হচ্ছে। তিনি বলেন, আমার মনে হয় দেশে ইসলামী সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাসে এটি অনেক বড় পরিবর্তনের সূচনা। মডেল মসজিদ স্থাপন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী সিদ্ধান্ত।


শিবালয় উপজেলা মডেল মসজিদ


ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের পাশ দিয়ে মানিকগঞ্জের শিবালয় উপজেলা সদর পার হওয়ার সময় চোখ আটকে যায় উপজেলা মডেল মসজিদটিতে। সবুজ গাছ-গাছালির মধ্যে দূর থেকে সাদা টাইলসের সিঁড়ি আর ঘিয়া রঙের অবকাঠামোর নান্দনিক সৌন্দর্য নিয়ে গড়ে উঠেছে মসজিদটি। গত ৫ মে জুমার নামাজের পরে কথা হয় মসজিদের ইমাম মাওলানা আব্দুল মালেকের সঙ্গে। তিনি বলেন, সরকারিভাবে বড় কোনো উদ্যোগ নেওয়া হলে সেটা বাস্তবায়নে অনেক সময় লাগে। অতীতে তাই দেখেছি। তেমনি মডেল মসজিদ হবে জানতে পারলেও এত তাড়াতাড়ি নির্মাণ হয়ে যাবে ভাবিনি। আল্লাহ সরকারকে এরকম আরও ভালো ভালো কাজ করার তৌফিক দিন, এই দোয়া করি।


অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা প্রকৌশলী নজরুল ইসলাম নিয়মিত শিবালয় মডেল মসজিদে নামাজ পড়েন। তিনি বলেন, এলাকার মানুষের মধ্যে মসজিদে এসে নামাজ আদায়ের আগ্রহ বেড়েছে বলে মনে হচ্ছে। যারা আগে চা স্টলে আড্ডা দিতেন, তাদের অনেককে এখন মসজিদে আসছেন নামাজ পড়তে। এটি ভালো লক্ষণ।


স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মসজিদের আশপাশে বসবাসকারীদের প্রায় সবাই নদীভাঙা এলাকা থেকে এখানে এসে বসতি গড়েছেন। তাই স্থানীয়ভাবে এই এলাকাটির মূল্যায়ন তুলনামূলক কম। কিন্তু মডেল মসজিদ হওয়ার পর পরিস্থিতি বদলাতে শুরু করেছে বলে মনে করেন বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরি করা রবিউল ইসলাম। তিনি বলেন, ঢাকার এত কাছে হওয়ার পরও শিবালয়ে উন্নয়নের ছোয়া লাগেনি বললেই চলে। এ নিয়ে এলাকাবাসীর মনে হতাশা আছে। তবে মডেল মসজিদটি আমাদের মর্যাদা বাড়িয়েছে।


ভাঙ্গা উপজেলা মডেল মসজিদ


ফরিদপুরের ভাঙ্গা উপজেলায় বর্তমানে অন্যতম দৃষ্টিনন্দন জায়গা হচ্ছে ভাঙ্গা সড়ক চক্কর (ইন্টারচেঞ্জ)। এর পাশেই গড়ে তোলা হয়েছে ভাঙ্গা উপজেলা মডেল মসজিদ ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। গত ৭ মে এশার নামাজ শেষে এ মসজিদের ইমাম মাওলানা আহমাদ মাসরুর বলেন, ধর্মীয় কার্যক্রমের শৃঙ্খলা বিধানে মডেল মসজিদ বড় ভূমিকায় আবির্ভূত হতে যাচ্ছে। এই উদ্যোগের প্রভাব হবে সুদূরপ্রসারী। আমরা গর্বিত যে, আমাদের শেখ হাসিনার মতো একজন প্রধানমন্ত্রী আছেন। তিনি মনে করেন, এই মসজিদ নির্মাণের কারণে সরকারের ওপর জনগণের আস্থা বাড়বে।


মসজিদের খাদেম মাওলানা ওয়ালীউল্লাহ জানান, এদিকে পর্যটকদের আনাগোনা বেশি। আগে নতুন পর্যটকদের মসজিদ খুঁজতে অন্যদের সাহায্য নিতে হতো। কিন্তু মডেল মসজিদ অনেক দূর থেকে দেখা যায়। তাই সহজে মানুষ মসজিদে আসতে পারেন।


সাভার উপজেলা মডেল মসজিদ


সাভার মডেল মসজিদের ইমাম মারুফ বিল্লাহ বলেন, রমজান মাসে তারাবি পড়তে এত বেশি নারী মুসল্লি আসবেন, মসজিদ কর্তৃপক্ষ ভাবতেও পারেনি। পুরুষ মুসল্লিদের অনেকে তারাবি নামাজের পুরোটা পড়েন না। কিন্তু নারী মুসল্লিদের যারা মসজিদে এসেছেন, তাদের প্রায় সবাই পুরো তারাবির নামাজ পড়েছেন। মাঝেমধ্যে এমনও হয়েছে, নারীদের জন্য বরাদ্দকৃত জায়গা পূর্ণ হয়ে যাওয়ার পর পুরুষদের জন্য বরাদ্দকৃত খালি জায়গায় নারীদের নামাজের ব্যবস্থা করতে হয়েছে।


 ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স-মাস্টার্স পড়া মারুফ বিল্লাহ বলেন, ‘মডেল মসজিদের অবকাঠামো অসাধারণ হয়েছে। কিন্তু এর প্রকৃত সাফল্য নির্ভর করছে যোগ্য জনবল নিয়োগের ওপর।’


 


মডেল মসজিদে অন্য ধর্মাবলম্বীরাও আসছেন। এখানকার লাইব্রেরিতে হিন্দু ধর্মীয় শিশু-কিশোররাও আসে। জাতীয় পর্যায়ে ইসলামিক সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় এই মসজিদ মহল্লার এক হিন্দু ছাত্র অংশগ্রহণ করে পুরস্কারও পেয়েছে।


মারুফ বিল্লাহ বলেন, ইসলাম সম্পর্কে প্রকৃত জ্ঞান রাখেন– এমন উদার সংস্কৃতিমনা ব্যক্তিদের দেশব্যাপী মডেল মসজিদগুলোতে নিয়োগ দিতে হবে। তাহলেই ইসলামী সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠবে মডেল মসজিদগুলো।


যা আছে মডেল মসজিদে


মডেল মসজিদে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাসহ নামাজের জন্য আলাদা জায়গা আছে। এসব কেন্দ্রে নামাজের বাইরে বহুমুখী কার্যক্রম পরিচালিত হবে। এর মধ্যে রয়েছে হিফজখানা, প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা ও কোরআন শিক্ষা, ইসলামিক কনফারেন্স রুম, হজযাত্রীদের নিবন্ধন-প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা, ইমাম প্রশিক্ষণকেন্দ্র, গবেষণাকেন্দ্র, ইসলামিক লাইব্রেরি, অটিজম কর্নার, দাফনের আগে জানাজার ব্যবস্থা ও গাড়ি পার্কিং সুবিধা।


প্রতিটি কেন্দ্রে জেলা ও উপজেলা ইসলামিক ফাউন্ডেশনের অফিসও থাকবে। এর বাইরে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড, ইসলামী দাওয়াত, ইসলামি বই বিক্রয়কেন্দ্র, মসজিদের সঙ্গে দেশি-বিদেশি অতিথিদের জন্য সীমিত আকারে বোর্ডিং সুবিধাও রাখা হয়েছে।


সর্বশেষ গত ১৭ এপ্রিল চতুর্থ ধাপে সারাদেশে ৫০টি মডেল মসজিদ ও ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র উদ্বোধন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর আগে ২০২১ সালের ১০ জুন প্রথম ধাপে ৫০টি, চলতি বছরের ১৬ জানুয়ারি দ্বিতীয় ধাপে ৫০টি ও ১৬ মার্চ তৃতীয় ধাপে ৫০টি মসজিদ উদ্বোধন করা হয়। এ উদ্যোগের অধীনে মোট তিন ধরনের স্থাপনা তৈরি হচ্ছে বলে প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে।


‘এ’ ক্যাটাগরির অধীন ৬৮টি চারতলা মসজিদ নির্মাণ করা হচ্ছে। এই মানের প্রতিটি মসজিদে মেঝেসহ ২ হাজার ৩৬০ বর্গমিটার জায়গা থাকছে। ‘বি’ ক্যাটাগরির ৪৮০টির প্রতিটি মসজিদে ১ হাজার ৬৮০ বর্গমিটার ফ্লোর স্পেস থাকছে। অন্যদিকে উপকূলীয় অঞ্চলে ‘সি’ ক্যাটাগরির অধীন ২ হাজার ৫২ বর্গমিটার মেঝের ১৬টি মসজিদ নির্মাণ করা হচ্ছে। মডেল মসজিদগুলো পরিচালনার দায়িত্বে আছে ইলামিক ফাউন্ডেশন। 

শেয়ার করুন