২৮ এপ্রিল ২০২৪, রবিবার, ০৬:৪৬:০৫ পূর্বাহ্ন
সম্পর্ক কিসে আটকায়
  • আপডেট করা হয়েছে : ১৮-০৮-২০২৩
সম্পর্ক কিসে আটকায়

এটা আর অস্বীকার করবার উপায় নেই, সোশ্যাল মিডিয়া তথা ফেসবুকে দৃষ্টি ফেললে বোঝা যায় যে সমাজের লোকজন এখন কী নিয়ে বেশি ভাবছে কিংবা বেশি চিন্তিত। একটা আলোচনার ইস্যু জন্ম নিয়েছে সম্প্রতি জাস্টিন ট্রুডো ও তাঁর স্ত্রীর আলাদা হওয়ার প্রসঙ্গ টেনে। ট্রুডো ক্ষমতাবান, সুদর্শন, স্ত্রীর সঙ্গে তাঁর জীবনযাপন সুখের ছিল বলে ধারণা প্রচলিত ছিল। এমন এক দম্পতির আচমকা সম্পর্কের টানাপোড়েন যেন অবিশ্বাস্য ঘটনায় দাঁড়িয়ে গেল। অনেক জল্পনা-কল্পনার কারণ হলো। সেই সঙ্গে জনমনে রাজ্যের বিস্ময় আছড়ে পড়ল। বিল গেটস বিশ্বের বিত্তবান ব্যক্তি, অভিনেতা হুমায়ুন ফরীদি প্রচণ্ড ভালোবাসতেন অভিনেত্রী সুবর্ণা মুস্তাফাকে, অথচ তাঁদেরও দাম্পত্য সম্পর্ক টেকেনি। অর্থ, বিত্ত, প্রভাব, ক্ষমতা এবং ভালোবাসার থাকার পরও সম্পর্ক টেকে না। ফলে প্রশ্ন উঠেছে, নারী বা পুরুষের এই সামাজিক সম্পর্ক আসলে কীসে আটকায়? তবে পুরুষের চাইতে প্রশ্নের তীরটা নারী জাতির প্রতিই বেশি। সামাজিক সম্পর্ক টেকানোর দায়টা নারীরই যেন। যা হোক, সোশ্যাল মিডিয়া যেন ভ্রাম্যমাণ গবেষণাগার। ফেসবুকাররা যে যা পারলেন, নিজের মতো করে এ বিষয়ে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ দিয়ে গেলেন। এখানে যে বিষয়টি লক্ষণীয় ছিল তা হলো, প্রচলিত সামাজিক মূল্যবোধ, দৃষ্টিভঙ্গি ও অভিজ্ঞতা অনুসারেই এসব ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ দেওয়া হয়েছে, হচ্ছে। 


নারী তার মেধা, সক্ষমতা ও যোগ্যতাবলে পুরুষের পাশাপাশি অবস্থান নিলেও এই সমাজ এখনো পুরুষশাসিত। কেবল ধর্মীয় দৃষ্টিতেই নয়, রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক নীতিনির্ধারণীতেও নারীকে পুরুষের তুলনায় দুর্বল অবস্থানে রাখা হয়েছে। খুব কৌশলে নারীকে পুরুষের অধীনস্থ করে রাখা হয়েছে। ফলে অধিকার, ন্যায্যতাপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে নারী এখনো বঞ্চনার শিকার, নির্যাতনের শিকার। অহরহ নারী নির্যাতনের ঘটনা অনেক ধরনের বৈষম্য, নারীর প্রতি মর্যাদাহীন গল্পের জন্ম দেয় এবং তা প্রতিনিয়ত। তেমন একটা অবস্থায় নারী ও পুরুষের সামাজিক সম্পর্ক না টেকার বেলায় দোষারোপের ওজনটা নারীর দিকেই বেশি যাবে, সেটাই স্বাভাবিক। সামাজিক বিধিটা এমনভাবেই দণ্ডায়মান। আর তারই ফলে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ উত্থাপিত হয় নারীর দিকে বন্দুকের নল তাক করে। যা হোক, সম্পর্কের বেলায় নারী বা পুরুষ কীসে আটকায় বলতে যে যুক্তি ও ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে বা হচ্ছে, তা নারী বা পুরুষ কারওর জন্যই মর্যাদাকর নয়, মর্যাদা রক্ষা করে না।


রীতিমতো অসম্মানজনক। পুরুষের টাকা থাকলে কিংবা পুরুষ সুদর্শন হলে কিংবা ক্ষমতাবান হলেই যে নারী তার প্রতি দুর্বল থাকবে, থেকে যাবে—এমন ধারণা পোষণ যথার্থ বা সঠিক নয় এবং সেটা বর্তমান যুগে তো নয়ই। এখানে নারীর মূল্যবোধ, বিবেককে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা হয়েছে। এক কথায়, নারী টাকা-পয়সায়, বিত্তে, রূপে এবং ক্ষমতার প্রতি যে দুর্বল, সেটাকেই বোঝানো হয়েছে, যেটা মোটেও কাম্য নয়, যুক্তিসংগত নয়। এটা একধরনের ধৃষ্টতাপূর্ণ অভিমত নিঃসন্দেহে। একই কথা প্রযোজ্য পুরুষের বেলায়ও। দেখা যায়, শিক্ষিত, সুন্দরী ও সম্পদশালী স্ত্রী ঘরে থাকলেও অনেক পুরুষের বহুগামিতা বা নারীপ্রীতি রয়েছে। অন্য নারীর প্রতি তার বেপরোয়া আসক্তি দেখা যায়। সামাজিক ও নৈতিক শিক্ষার অভাবের পাশাপাশি ব্যক্তির শারীরিক কোনো ত্রুটি এর কারণ হতে পারে। আবার রূপ, গুণ ও অর্থের প্রতি কোনো কোনো নারী বা পুরুষ যে দুর্বল হয় না, তাও কিন্তু নয়। অস্বাভাবিক চাহিদা, লোভ ব্যক্তিকে বিভ্রান্ত করে, বিপথে ঠেলে দেয়।


সম্পর্ক কী—এমন প্রশ্নের নানান জবাব হতে পারে এবং সেটা ব্যক্তির দৃষ্টিভঙ্গি, বিশ্বাস ও দর্শনের ওপর ভিত্তি করে। প্রত্যেক ব্যক্তিই স্বতন্ত্র। অর্থাৎ, ভিন্নতা ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে থেকে যায়। বিশেষ করে মনস্তাত্ত্বিক বিষয়ে। ব্যক্তির পরিবেশ বিষয়টিকে প্রভাবিত করে। ফলে সম্পর্ক বিষয়ে ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির তফাত থেকে যায়। তবে সাধারণভাবে সম্পর্ককে ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির তেমন গভীর যোগাযোগ বোঝায়, যা সম্পূর্ণভাবে একটা সুস্থ, সুষ্ঠু বিশ্বাস প্রক্রিয়ার চর্চার মধ্য দিয়ে রচিত হয়, গভীর হয় এবং বিদ্যমান থাকে। সন্তান প্রসবের পর যদি মায়ের কাছ থেকে সন্তানকে দূরে রাখা হয়, তাহলে মা ও সন্তানের ভেতরে নাড়ির টানের সম্পর্ক দৃশ্যমান হয় না, অনুভূত হয় না। মায়ের ভেতরে একধরনের অনুভূতি জাগলেও সন্তানের ভেতরে তা জাগে না। অনেকেই এটাকে রক্ত সম্পর্কের জন্য দায়ী করে। 


নারী ও পুরুষের দাম্পত্য সম্পর্ক হলো একটা সামাজিক চুক্তিভিত্তিক সম্পর্ক, যা কিছু রীতিনীতি ও কাগজকলমে স্বাক্ষরের দ্বারা গ্রথিত হয়। পছন্দ করে বিয়ে কিংবা আলাপ-আলোচনা করে বিয়ে—সব ধরনের বিয়েকে সামাজিক ও ধর্মীয় রীতিনীতি মেনে সম্পন্ন করতে হয়। আবার সামাজিক রীতিনীতির বাইরে গিয়েও কেউ কেউ এমন সম্পর্কে আবদ্ধ হয়। সেখানে আকাশ-বাতাসকে সাক্ষী মানা হয়। 

বিয়ে সম্পর্কের শুরুতে থাকে বিভিন্ন আয়োজন, অনুষ্ঠান। সবটাই থাকে আনন্দঘন ও উৎসবমুখর। কিন্তু সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার সময় শুধু স্বাক্ষরের প্রয়োজন পড়ে। কেন সম্পর্ক ভেঙে যায়? প্রতিটি সম্পর্ক ভাঙার ক্ষেত্রে থাকে ভিন্ন ভিন্ন কারণ। তবে সাধারণভাবে কারণ হিসেবে যেটা আসে সেটা হলো আস্থা ও বিশ্বাসে ফাটল কিংবা সম্পর্কের মোহ কেটে যাওয়া। সমাজে পরকীয়ার আধিক্য বলে দেয়, নারী ও পুরুষের বিদ্যমান সম্পর্ক থেকে বের হওয়ার প্রবণতা বেড়ে গেছে। সামাজিক নৈতিকতা ও শৃঙ্খলাবোধের অভাবই এই প্রবণতা বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ। মানিয়ে চলা, মেনে চলা সম্ভব হচ্ছে না—এমন অজুহাতও সম্পর্ক ভেঙে দেওয়ার কারণ হিসেবে আসে।


সন্তানসন্ততি হওয়ার পরও নারী ও পুরুষ নিজেদের প্রাপ্তির হিসাব কষতে বসে। কারণ, সমাজটা এখন ব্যক্তিপ্রধান এবং ব্যক্তিকেন্দ্রিকতার দিকে ধাবিত হচ্ছে। এখানে চুলচেরা হিসাব কষা হয়। তবে কামনা-বাসনার বিষয়টি মুখ্য বলে কেউ কেউ মনে করেন। সেই সঙ্গে আধুনিক বিশ্বে বিভিন্ন ধরনের প্রযুক্তির প্রচলন ও তার ব্যবহার জীবনকে এতটাই সহজ করে দিয়েছে যে, জীবনের প্রতি ব্যক্তির যত্ন, দায়বোধও কমে গেছে। সহজভাবে সবকিছু পাওয়া, ভোগ করার আচরণ আধুনিক বিশ্বের মস্ত বড় খেসারত। 


একটা সময় ছিল, সম্পর্ক বিষয়টা রক্ষণশীল বেড়াজালে আবদ্ধ রাখা হতো। পরিচর্যার বিষয়টি অনুসৃত হতো। আধুনিক বিশ্ব সেই বেড়াজাল থেকে সম্পর্ককে উন্মুক্ত করেছে। দুটো ডানা দিয়েছে। একটুতেই নারী ও পুরুষের ভেতর থেকে সম্পর্ক উড়াল দেয়। অন্যত্র ঠাঁই নেয়। ব্যক্তি যতই তার অধিকার সম্পর্কে সচেতন হচ্ছে, যতই অধিকার বিষয়ে সমাজে আইন প্রণয়ন হচ্ছে, ততই যেন সম্পর্ক ভাঙতে সহজ হচ্ছে। আস্থা, ভরসা ও বিশ্বাসের অভাব—এমন সম্পর্ক রেখে লাভ কী? কিংবা সম্পর্কের ভেতরে একঘেয়েমি চলে আসছে, জীবন ত্যানা-ত্যানা—এমন অজস্র কারণ ও মনোভাব থাকে সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার পেছনে। রেললাইনের পাশের বস্তিতে একজন নারী ও পুরুষের ভেতরে মানসিকতা যেমন থাকে, তেমনই থাকে অভিজাত এলাকার নারী ও পুরুষের মধ্যে। এই সম্পর্ক এক বছরে যেমন ভেঙে যায়, তেমনি ভাঙতে বিশ, তিরিশ, চল্লিশ বছরও লেগে যায়। 


দুটি ভিন্ন সত্তার মানুষ এক বিন্দুতে থেকে চলাটা কিন্তু ওই দুই ব্যক্তির চাওয়া ও পাওয়ার ওপর নির্ভর করে। তারা কী চাইবে, কী পাবে—এটা তাদের ব্যক্তিগত বিষয়। অন্য কারওর অধিকার নেই সে বিষয়ে কথা বলার। এখানে যেকোনো সুস্থ সম্পর্কই হলো সভ্যতার অন্যতম সামাজিক আচরণ, যা সভ্যতাকে টিকে থাকতে সহায়তা করে, সুশৃঙ্খল করে। পরিশেষে বলব, পাশ্চাত্য সংস্কৃতির সঙ্গে তুলনা করে আমাদের সামাজিক সম্পর্কের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ প্রদান করা সমীচীন নয় কোনোভাবেই। বীজ বপনের পর যেমন বৃক্ষের যত্ন লাগে, বেড়ে উঠতে জায়গার প্রয়োজন হয়, ঠিক সম্পর্কের বেলায়ও যত্ন লাগে, জায়গার প্রয়োজন হয়। কীসে আটকায় না, কীসে মজবুত ও বিস্মৃত হয়, সেই অনুসন্ধান করলে ব্যক্তির ভেতরকার ঝামেলা দূর হয়।

শেয়ার করুন