আওয়ামী লীগকে আবারও সরকারে দেখতে চান জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শ্যামল চন্দ্র ধর। প্রকাশ্যে মাইকে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পুনরায় আওয়ামী লীগকে ‘বিপুল ভোটে’ জয়ী করার প্রত্যাশা ব্যক্ত করেছেন তিনি। এ ছাড়া দেওয়ানগঞ্জ পৌর মেয়রকে ‘সুযোগ্য’ এবং স্থানীয় সংসদ সদস্যকে ‘নয়নের মণি’ বিশেষণে অভিহিতও করেছেন ওসি। জাতীয় শোক দিবসের এক আলোচনা সভায় ওসির দেওয়া বক্তব্যের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে।
পুলিশ বাহিনীতে কর্মরত থেকে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগকে প্রকাশ্যে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় দেখতে চাওয়ায় ওসির পুলিশিং কার্যক্রম নিয়ে নানা প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে। তবে ওসির দাবি, ‘যা বলার তা তিনি বলেছেন, এতে যদি চাকরি চলে যায়, তাতেও তাঁর কোনো অসুবিধা নেই।’
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, গত ১৫ আগস্ট দুপুরে জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে দেওয়ানগঞ্জ পৌরসভা আয়োজিত দোয়া মাহফিল ও দুস্থদের মাঝে খাবার বিতরণ করা হয়। দেওয়ানগঞ্জ পৌরসভা মাঠে অনুষ্ঠিত ওই সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ও দেওয়ানগঞ্জ-বকশীগঞ্জ আসনের সংসদ সদস্য আবুল কালাম আজাদ। এতে সভাপতিত্ব করেন দেওয়ানগঞ্জ পৌরসভার মেয়র শেখ মোহাম্মদ নুরুন্নবী অপু।
ওসি শ্যামল চন্দ্র ধর তাঁর বক্তব্যে বলেন, ‘দোয়া ও খাবার বিতরণ অনুষ্ঠানের সম্মানিত সভাপতি পৌরসভার সুযোগ্য মেয়র নুরনবী অপু। উপস্থিত আছেন আমাদের নয়নের মণি, দেওয়ানগঞ্জ-বকশীগঞ্জ থেকে বারবার নির্বাচিত প্রতিনিধি, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রাক্তন মন্ত্রী মহোদয় আমাদের মাটি ও মানুষের নেতা জনাব আবুল কালাম আজাদ। আরও উপস্থিত আছেন, বিভিন্ন ইউনিয়ন থেকে আগত আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সেক্রেটারি, সাধারণ সদস্যবৃন্দ, উপজেলা পরিষদ, প্রশাসনের কর্মকর্তাবৃন্দ, বোনেরা আমার ভাইয়েরা আমার সবাই আমার ছালাম নেবেন। ১৫-ই আগস্ট শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সপরিবারে হত্যার ঘৃণিত এই দিনে ঘৃণিত খুনিদের শাস্তি হোক। সব খুনিরাই কিন্তু শাস্তি পায় নাই। সবাইকে ফাঁসি দিয়ে ঝুলাইতে পারি নাই, শুধু কুচক্রী মহলের জন্য। আমরা চেয়েছিলাম। জাতির জনকের জন্য পেয়েছি আমরা লাল সবুজের পতাকা। যাঁর জন্য পেয়েছি আমরা এই স্বাধীন বাংলাদেশ। বাংলাদেশ মানেই শেখ মুজিবুর রহমান। বাংলাদেশ মানেই জাতির জনকের দেশ। বঙ্গবন্ধু মানেই বাংলাদেশ।’
আগের দিন ১৪ আগস্ট মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মৃত্যু ঘিরে দেশব্যাপী সাঈদীর অনুসারীদের কর্মকাণ্ড প্রসঙ্গের ইঙ্গিত করে ওসি শ্যামল চন্দ্র ধর বলেন, ‘গতকাল আমরা এক কুচক্রী মহলের অনেক উসকানি দেখেছি। সুতরাং এগুলো থেকে আপনারা সাবধান থাকবেন এবং সামনে আমাদের নির্বাচন আসছে, আপনারা সবাই সতর্ক দৃষ্টি রেখে আমাদের দলের কাজ করে, আগামী সরকার যাতে আমরা পুনরায় আওয়ামী লীগ সরকারকে বিপুল ভোটে জয় করতে পারি। সেই প্রত্যাশা রেখে আপনাদের সবাইকে আমার দেওয়ানগঞ্জ মডেল থানার পক্ষ থেকে ছালাম দিয়ে শেষ করলাম আজকের এই বক্তব্য। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু। জয় হোক আপনাদের সকলের।’
এ বিষয়ে দেওয়ানগঞ্জ মডেল থানার ওসি শ্যামল চন্দ্র ধরের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি মোবাইল ফোনে বলেন, ‘হ্যাঁ আমি বক্তব্য দিয়েছি।’
রাজনৈতিক দলের পক্ষে ভোট চেয়ে বক্তব্য দিতে পারেন কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে ওসি বলেন, ‘এ বিষয়ে আপনাকে জবাব দিতে আমি বাধ্য না। আপনি ফিল্ডে কাজ করেন। আমিও ফিল্ডে কাজ করি। ঠিক আছে? উভয়ে ফিল্ডের মানুষ। অন্য বিষয়ে থাকলে বলেন।’
আপনাদের দল বলতে আওয়ামী লীগকে বুঝিয়েছেন কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে দাম্ভিকতার স্বরে শ্যামল চন্দ্র বলেন, ‘আমি ওসি দেওয়ানগঞ্জ ঠিক আছে। আমি বাংলাদেশ ছাত্রলীগ করে এখানে এসেছি। আওয়ামী লীগকে বিজয় করতে ভোট চেয়েছি। এতে যদি আমার চাকরি চলে যায়, অসুবিধা নেই। এটুকুই আমার বলা। চাকরি গেলে যাকগা। আমার রিজিকে যা আছে, তাই করে খাবো। আপনি সাংবাদিক সাংবাদিকের জায়গায় থাকেন, আমি আমার জায়গায় আছি, ধন্যবাদ।’
এ বিষয়ে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (দেওয়ানগঞ্জ সার্কেল) সুমন কান্তি চৌধুরী বলেন, ‘ওসি কখন তাঁর বক্তব্যে কী বলেছে, সেটা আমি জানি না।’
জামালপুরের পুলিশ সুপার (এসপি) মো. কামরুজ্জামান বলেন, ‘ওসির বক্তব্যের বিষয়টি আমার নলেজে নেই। এটি ব্যক্তিগত দায়। তবে ইউনিফর্ম পরে কোনো রাজনৈতিক দলের জন্য ভোট চাওয়া, না চাওয়া একান্তই তাঁর (ওসির) ব্যক্তিগত বিষয়। এর থেকে আমার আর কিছু বলার নেই।’
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মোহাম্মদ সেলিম মিয়া বলেন, ‘নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলকে বিপুল ভোটে বিজয় করার প্রত্যাশা করাসহ ওসির পুরো বক্তব্যই বেমানান। দলকানা না হলে, এমন রাজনৈতিক বক্তব্য ওসি দিতে পারেন না। এটা আইন অবমাননা।’
থানা সূত্রে জানা যায়, ২০২২ সালের ২৮ জুলাই দেওয়ানগঞ্জ মডেল থানার ওসি হিসেবে যোগদান করেন শ্যামল চন্দ্র ধর। এর আগে ২০২০ সালের অক্টোবর মাস থেকে দেওয়ানগঞ্জ সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে পুলিশ পরিদর্শক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। নেত্রকোনার কেন্দুয়া থানার সোহাগপুর গ্রামের বাসিন্দা শ্যামল চন্দ্র ধর ২০০১ সালে পুলিশ বাহিনীতে এসআই পদে যোগদান করেন।