দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলের জন্য, বিশেষ করে এ অঞ্চলের শান্তি নিশ্চিতের ক্ষেত্রে বেশ গুরুত্ব বহন করছে বাংলাদেশের আগামী জাতীয় নির্বাচন। কারণ, ঢাকায় শাসনব্যবস্থায় কোনো পরিবর্তন হলে স্বাধীনতা বিরোধীদের প্রত্যাবর্তনের সঙ্গে উত্থান ঘটতে পারে উগ্র ইসলামপন্থি মৌলবাদীদের সমর্থনপুষ্ট সাম্প্রদায়িক শক্তির, যা সমগ্র অঞ্চলকে অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে বলে শঙ্কা রয়েছে।
গেল শুক্রবার (২৫ আগস্ট) এ সংক্রান্ত এক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ফার্স্টপোস্ট। বাংলাদেশের আগামী নির্বাচনে শেখ হাসিনার জয় ভারতের জন্য কেন গুরুত্বপূর্ণ, প্রতিবেদনে সে বিষয়টি সামনে এনেছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং লেখক জয়দীপ সাইকিয়া।
এতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। আর এই নির্বাচন শুধুমাত্র বাংলাদেশের জন্য নয়, ভারতের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়া, ধর্মনিরপেক্ষ শক্তির ক্ষমতায় থাকা এবং উগ্র ইসলামপন্থি মৌলবাদীদের সমর্থনপুষ্ট শক্তির রাজনীতির পথ প্রশস্ত না করাটাও সমান গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিকে ভারত বরাবরাই সমর্থন দিয়েছে উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, সর্বোপরি, বাংলাদেশের স্বাধীনতায় যথেষ্ট সহায়তা করেছিল ভারত। এটাও যুক্তিযুক্ত যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, যিনি ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির নেতৃত্ব দিচ্ছেন, ভারত তাকে সমর্থন করবে।
এছাড়াও, বাংলাদেশে স্বাধীনতাবিরোধীরা ক্ষমতায় ফিরলে তা ভারতের নিরাপত্তার জন্য ক্ষতির কারণ হবে, বিশেষ করে দেশটির উত্তর-পূর্বে। ইউনাইটেড লিবারেশন ফ্রন্ট অব আসাম (উলফা) এবং ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট অব বড়োল্যান্ডের (এনডিএফবি) মতো ভারতীয় বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর হুমকি মোকাবিলাও এক্ষেত্রে চিন্তার বিষয়। কারণ, ক্ষমতায় এসে শেখ হাসিনা যেভাবে এই সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর প্রায় পুরো নেতৃত্বকে ভারতের হাতে তুলে দিয়েছিলেন, তা প্রশংসার দাবিদার।
ফার্স্টপোস্টের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সাম্প্রতিক সময়ে আসাম এবং তার আশপাশে কিছু উগ্র ইসলামপন্থি দল প্রবেশ করেছে বলে জানা যায়। আর বিষয়টি যদি সত্য হয়ে থাকে, সেই বিবেচনায়ও শেখ হাসিনার ক্ষমতায় থাকা ভারতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এই পরিস্থিতিতে নয়াদিল্লিকে শেখ হাসিনার প্রত্যাবর্তন নিশ্চিত করতে হবে।
অন্যদিকে, বাংলাদেশের আসন্ন নির্বাচনে যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে আগ্রহ দেখাচ্ছে তা নিয়ে নানা মন্তব্য করছেন দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা। সম্প্রতি মার্কিন কংগ্রেস সদস্যরা ঢাকা সফর করেছেন এবং যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক কমান্ডের পরিচালক বাংলাদেশ সফর করবেন বলেও জানা গেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের আগে থেকেই বাংলাদেশ সম্পর্কে আগ্রহ ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের। তবে বর্তমানের প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণের দাবি রাখে। কারণ জল্পনা রয়েছে, বাংলাদেশে শাসন পরিবর্তন করতে চাইছে ওয়াশিংটন, যা এই অঞ্চলে তার ভূ-রাজনীতির জন্য উপযুক্ত হবে। এমনকি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেও বলেছেন, ওয়াশিংটন আগামী নির্বাচনে বাংলাদেশে একটি অগণতান্ত্রিক দলকে ক্ষমতায় আনতে কাজ করছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার ষড়যন্ত্রের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে চোখ বন্ধ করে রেখেছিল, তা বোঝার জন্য গ্যারি জে বাসের বিখ্যাত বই ‘দ্য ব্লাড টেলিগ্রাম’-এর ওপরও আলোকপাত করেছেন বিশ্লেষক জয়দীপ সাইকিয়া।
১৯৭০-এর দশকের গোড়ার দিকে মার্কিন কনসাল জেনারেল আর্চার ব্লাড যেভাবে পাকিস্তানের ‘পূর্বে’ গণহত্যা চালানোর বিষয়ে ওয়াশিংটনের সমর্থন চেয়েছিলেন, বইটিতে তা নথিভুক্ত করা হয়েছে। এছাড়া ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সদস্যদের হত্যাকাণ্ডে নিক্সন-কিসিঞ্জার জুটি কীভাবে সমর্থন দিয়েছিল, সে বিষয়েও লিখেছেন গ্যারি বাস।
ফার্স্টপোস্টের প্রতিবেদন বলছে, ১৯৭১ সালে আমেরিকা যে পাকিস্তানকে প্রকাশ্যে সমর্থন করেছিল তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। আর বর্তমান বাংলাদেশের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের অতিআগ্রহে এটি স্পষ্ট যে, ওয়াশিংটন চায় বাংলাদেশের আগামী নির্বাচনে বিএনপি (ইসলামপন্থি মৌলবাদীদের সমর্থনপুষ্ট দল) জয়ী হোক। এটি গ্লোবাল পুলিশিংয়ের সবচেয়ে নিকৃষ্ট উদাহরণ।
এতে আরও বলা হয়, উগ্রপন্থিদের উত্থান বিশ্বজুড়েই লক্ষ্যণীয়। কিন্তু বাংলাদেশে শেখ হাসিনার সরকার স্বাধীনতাবিরোধীদের বিরুদ্ধে দ্রুত কাজ করেছেন এবং তাদের বেশ কয়েকজনকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে। তবে এটা বুঝতে হবে, বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে শেখ হাসিনার শক্ত কোনো রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ নেই এবং তার দলের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে।
‘তবে শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের মধ্যে থাকা চীনপন্থিদের চাপেও থাকতে পারেন বলে মনে করা হয়। বাংলাদেশে চীনপন্থিদের জয় কিংবা ১৯৭৫ সালের মতো কোনো ঘটনার পুনরাবৃত্তি ভারতের জন্য সুখকর হবে না,’ বলা হয় প্রতিবেদনে।
এতে আরও বলা হয়, বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০২৪ সালের জানুয়ারির নির্বাচনে প্রাথমিকভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে উন্নয়ন, স্বাস্থ্য খাত এবং হিন্দু, খ্রিস্টান ও বৌদ্ধ জনগোষ্ঠীসহ ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে শেখ হাসিনার সক্ষমতার ওপর ভিত্তি করে। সংখ্যালঘুদের স্বার্থ রক্ষা করার আশ্বাস দিতে হবে আওয়ামী লীগকে। কারণ, বাংলাদেশের সংখ্যালঘুরা কখনোই শেখ হাসিনার প্রতি তাদের আনুগত্য থেকে বিচলিত হয়নি।
অন্যদিকে আশঙ্কা রয়েছে, বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচনে বিএনপি এবং ইসলামপন্থি মৌলবাদী শক্তিকে এক হয়ে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে লড়ার জন্য আর্থিক সাহায্যের পাশাপাশি নানাভাবে সহায়তা করতে পারে পাকিস্তানের অন্যতম বড় গোয়ন্দা সংস্থা ইন্টার সার্ভিসেস ইন্টেলিজেন্স (আইএসআই)।
সম্প্রতি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক গতিশীলতা নিয়ে এক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিক ইনস্টিটিউট। এতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের অনেক নাগরিক দেশের অর্থনীতির বর্তমান অবস্থা এবং নির্বাচন পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগে থাকলেও, আওয়ামী লীগ সরকারের উন্নয়ন নীতির কারণে শেখ হাসিনার প্রতি যথেষ্ট জনসমর্থন রয়েছে।
তবে স্বাস্থ্য খাত নিয়ে জনগণের মাঝে ব্যাপক অসন্তুষ্টি রয়েছে উল্লেখ করে ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, এক্ষেত্রে সরকারের আরও তৎপর হওয়া প্রয়োজন। বিশেষ করে ডেঙ্গুর মতো রোগ মোকাবিলায় আরও বেশি সংকল্পের সঙ্গে লড়াই করা প্রয়োজন বলে মনে করেন পর্যবেক্ষকরা।
ফার্স্টপোস্টের প্রতিবেদনে বলা হয়, এটা নিশ্চিত যে বাংলাদেশের রাজনীতি এবং যে পদ্ধতিতে অতিরিক্ত-আঞ্চলিক ক্ষমতার খেলা দেশটির ভোটের ফলকে প্রভাবিত করতে পারে; সে বিষয়টি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন নয়াদিল্লির নিরাপত্তা সংশ্লিষ্টরা।
বাংলাদেশে জাতীয় নির্বাচনের আর মাত্র পাঁচ মাস বাকি উল্লেখ করে প্রতিবেদনের শেষ অংশে বলা হয়েছে, শেখ হাসিনা যাতে আবারও জয়ী হতে পারেন, তা নিশ্চিতে সব ধরনের পদক্ষেপ নেয়া জরুরি। আর তা করতে ব্যর্থ হলে, কেবল বিপদই বাড়বে ভারতের।