সরকারের পদত্যাগ ও নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের একদফা দাবিতে চলমান আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে হিসাব-নিকাশ করে প্রতিটি পদক্ষেপ নিচ্ছে বিএনপি। বিশেষ করে গত মাসে ঢাকার প্রবেশপথে অবস্থান কর্মসূচিতে ব্যর্থতার পর অত্যন্ত সতর্কভাবে অগ্রসর হচ্ছে দলটি। আগামী দিনের আন্দোলনে আর কোনো ভুল করতে চান না নীতিনির্ধারকরা। এ কারণে সাধারণ মানুষের আকাঙ্ক্ষা, বিদেশিদের অবস্থান এবং সরকারের মনোভাবসহ সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে আন্দোলন ও রাজনীতির গতিপথ নির্ধারণ করা হচ্ছে বলে বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতা জানিয়েছেন।
নির্বাচন কমিশন থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, আগামী নভেম্বরে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের তপশিল ঘোষণা করা হবে। সে হিসাবে আর বাকি আছে প্রায় ২ মাস। এ সময়কে কাজে লাগিয়ে কীভাবে আন্দোলনে সফলতা অর্জন করা যাবে, সে বিষয়ে বিএনপির অভ্যন্তরে আলাপ-আলোচনা চলছে। দলটির পরিকল্পনা হচ্ছে, আন্দোলনের মাধ্যমে একদফা দাবি আদায় করেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে তারা। আর সরকার যদি এই দাবি উপেক্ষা করে একতরফা নির্বাচনের উদ্যোগ নেয়, বিএনপি তা প্রতিহত করবে এবং সেই নির্বাচনে অংশ নেবে না।
বিএনপির দাবি, যুগপৎ আন্দোলনে সম্পৃক্ত কোনো দলই বর্তমান সরকারের অধীনে ভোটে যাবে না। আর যেসব দল যুগপতে নেই; কিন্তু অবাধ-সুষ্ঠু নির্বাচন চায়—২০১৪ সালের মতো তারাও ওই নির্বাচন বর্জন করবে।
বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতা আশা প্রকাশ করে বলেন, খুব কম সময়ের মধ্যেই আন্দোলন পরিণতি লাভ করবে। বর্তমান বাস্তবতায় সরকারের পক্ষে কোনোভাবেই একতরফা নির্বাচন করা সম্ভব নয়। ফলে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে সরকারকে কোনো না কোনো বিকল্প পথ বেছে নিতেই হবে।
তারা মনে করেন, নির্বাচন বা আন্দোলনের মাঠে এবার বিএনপিই সরকারের একমাত্র প্রতিপক্ষ নয়। আগামী নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হোক—এটি যেমন দেশের সাধারণ মানুষ চায়, তেমনি গণতান্ত্রিক বিশ্বেরও চাওয়া এটি। এ ইস্যুতে সরকারের ওপর চাপ অব্যাহত রেখেছে তারা। শিগগির এই চাপ আরও জোরালো হবে। বিশেষ করে বাংলাদেশে আগামীতে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে অবস্থান নিয়েছে, তাতে আস্থার জায়গা খুঁজে পাচ্ছে বিএনপি। দলটি মনে করছে, এর ফলে তাদের সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবি আরও জোরালো হয়েছে। এ ইস্যুতে ভিসা নীতি ঘোষণাসহ মার্কিন তৎপরতা আশা জোগাচ্ছে তাদের।
বিগত দুটি নির্বাচন শেখ হাসিনা সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়েছে। ২০১৪ সালের দশম সংসদ নির্বাচন বিএনপি বর্জন করে প্রতিহতের ডাক দিয়েছিল; কিন্তু সেই নির্বাচন ঠেকানো সম্ভব হয়নি। ওই সময় নির্বাচন নিয়ে মধ্যস্থতা করতে জাতিসংঘের সহকারী মহাসচিব অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো ঢাকায় এসেছিলেন। তার উপস্থিতিতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির শীর্ষ নেতাদের বৈঠকও হয়। বিএনপি নেতাদের দাবি, তখন সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার নির্বাচনের পর দ্রুততম সময়ে আরেকটি নির্বাচন দেওয়ার কথা বলেছিল সরকার; কিন্তু পরবর্তী সময়ে তারা কথা রাখেনি। এরপর দলীয় অবস্থান পরিবর্তন করে ২০১৮ সালের নির্বাচনে অংশ নেয় বিএনপি। একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের আশায় প্রধানমন্ত্রীর ডাকা সংলাপে গিয়েছিলেন বিএনপি নেতারা; কিন্তু নির্বাচনে অংশ নিয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত ফল অর্জন করে দলটি। মাত্র সাতটি আসনে বিজয়ী হয়। নির্বাচনের পর বিএনপির পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে সংলাপে দেওয়া প্রতিশ্রুতি রাখেননি প্রধানমন্ত্রী।
সেই অভিজ্ঞতা থেকে এবার দলীয় সরকারের অধীন নির্বাচনে না যাওয়ার সিদ্ধান্তে অনড় বিএনপি। সরকারের পতন ও নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের একদফা দাবিতে গত ১২ জুলাই থেকে আন্দোলন শুরু করছে তারা। অন্যদিকে সংবিধান অনুযায়ী বর্তমান সরকারের অধীনেই নির্বাচন আয়োজনের সিদ্ধান্তে অটল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। উভয় পক্ষের নাছোড় মনোভাবের কারণে নির্বাচনকালীন সরকার ইস্যুতে সহসাই কোনো সমঝোতা হবে—এমন কোনো লক্ষণ নেই।
এমন প্রেক্ষাপটে সার্বিক পরিস্থিতি মূল্যায়ন করছে বিএনপি। সরকারের যে অনমনীয় মনোভাব, সেটিও তারা সতর্কতার সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করছে। মার্কিন ভিসা নীতিসহ গণতান্ত্রিক বিশ্বের অব্যাহত চাপের মুখে সরকার তাদের আন্দোলন কর্মসূচি পালনের সুযোগ দেবে, নাকি আগের মতোই কোণঠাসা করার চেষ্টা করবে—সেটি পর্যবেক্ষণ করছে দলটি। তবে আন্দোলন ঘিরে সম্প্রতি বেশকিছু নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে বিএনপির মূল্যায়ন, অতীতের মতো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ব্যবহার করে আন্দোলনকে দমনের পথে হাঁটছে সরকার।
সরকারের এই অবস্থানসহ সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে আন্দোলনের নতুন রোডম্যাপ সাজাচ্ছে বিএনপি। সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি থেকে ফের আন্দোলনে গতি আনতে চান দলের নীতিনির্ধারকরা। কর্মসূচিতে বৈচিত্র্য আনার জন্য দলে নানামুখী পর্যালোচনা চলছে। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন ও মির্জা আব্বাস এখন চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরে আছেন। তারা দেশে ফিরলে আন্দোলন-সংক্রান্ত এই আলোচনা-পর্যালোচনা সিদ্ধান্তে রূপ নেবে।
জানা গেছে, তিন-চার দিন আগে লন্ডন থেকে সিঙ্গাপুরে এসেছেন স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুও। দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনা, গুঞ্জন আছে, ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক ও আন্দোলন পরিকল্পনা নিয়ে সিঙ্গাপুরে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হবে। সেখানে কয়েকটি দেশের কূটনীতিকের সঙ্গেও আলোচনা হতে পারে বিএনপি নেতাদের।
বিএনপি সূত্রে জানা গেছে, খসড়া পরিকল্পনা অনুযায়ী মধ্য সেপ্টেম্বর থেকে একদফার যুগপৎ আন্দোলন গতি লাভ করবে। তার আগে দলের ৪৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন করা হবে। আলোচনা সভা ছাড়াও আগামী ১ সেপ্টেম্বর ঢাকায় বিশাল আয়োজনে বর্ণাঢ্য র্যালি করবে দলটি। নেতাকর্মীদের ব্যাপক অংশগ্রহণে র্যালিকে একদফার কর্মসূচির মতো রূপ দেওয়ার পরিকল্পনা করছে তারা।
সেক্ষেত্রে সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে গিয়ে চূড়ান্ত রূপ নেবে আন্দোলন। ওই সময় ঢাকায় ফের মহাসমাবেশ, গণসমাবেশ বা বড় ধরনের কর্মসূচির চিন্তা রয়েছে নীতিনির্ধারকদের। এর মধ্য দিয়ে চূড়ান্ত আন্দোলনের ‘শেষ ধাপ’ শুরু হবে, যা দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত চলবে। সেই পর্যায়ে কর্মসূচি হবে সম্পূর্ণ ঢাকাকেন্দ্রিক। বিচারালয়ের সামনে অবস্থান ছাড়াও নির্বাচন কমিশন, গণভবন, সচিবালয়ের মতো বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ঘেরাওয়ের কর্মসূচি আসবে। এর সঙ্গে টানা অবস্থান কর্মসূচি দেওয়ার চিন্তাও রয়েছে বিএনপির।
জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান বলেন, ‘আগামী দিনে কী ধরনের কর্মসূচি দেওয়া যায়—তা নিয়ে দলের অভ্যন্তরে আলোচনা চলছে। যুগপৎ আন্দোলনে থাকা নেতারাও কর্মসূচি কী হতে পারে, তা নিয়ে পরামর্শ দিচ্ছেন। সরকারের ফাঁদে পা না দিয়ে বিএনপি শান্তিপূর্ণ পথেই এগোবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হতে হলে সরকারকে পদত্যাগে বাধ্য করতে হবে। নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন দিতে হবে। সরকার যত দ্রুত এই গণদাবি অনুধাবন করবে, ততই দেশের জন্য মঙ্গল হবে।’