আস্তানা ও প্রশিক্ষণকেন্দ্র হিসেবে পাহাড়ি এলাকাকে বেছে নেওয়ার প্রবণতা শুরু হয়েছে নতুন জঙ্গি সংগঠনের মধ্যে। পাশাপাশি পুরো পরিবার নিয়ে ‘হিজরত’ করার প্রবণতাও দেখা যাচ্ছে। পুরো পরিবারকে উগ্রবাদী করার এই প্রবণতাকে বিপৎসংকেত বলছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
নতুন দুই জঙ্গি সংগঠন ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’ ও ‘ইমাম মাহমুদের কাফেলা’র ক্ষেত্রে এসব প্রবণতা দেখা গেছে। আগে জঙ্গি সংগঠনগুলো সমতলে আস্তানা গেড়ে তৎপরতা শুরু করত। কিন্তু সম্প্রতি নিষিদ্ধঘোষিত জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার আস্তানা ও প্রশিক্ষণকেন্দ্র ছিল পার্বত্য জেলা বান্দরবানে। ইমাম মাহমুদের কাফেলার আস্তানা পাওয়া গেছে মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার পাহাড়ি এলাকায়। জামাতুল আনসারকে ১০ আগস্ট নিষিদ্ধ করে সরকার। এ নিয়ে দেশে ৯টি জঙ্গি সংগঠনকে নিষিদ্ধ করা হলো।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সূত্র বলছে, কয়েকটি কারণে নতুন জঙ্গি সংগঠনগুলো সীমান্তবর্তী পাহাড়ি এলাকায় আস্তানা ও প্রশিক্ষণকেন্দ্র করেছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে উপমহাদেশের বিভিন্ন উগ্রবাদী সংগঠনের সঙ্গে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা, পার্শ্ববর্তী দেশে জঙ্গিবাদের বিস্তার ঘটানো, অস্ত্র-বিস্ফোরক কেনা ও মজুত করা, প্রয়োজনে সীমান্ত পেরিয়ে পার্শ্ববর্তী দেশে পালিয়ে যাওয়ার সুবিধা। দুর্গম বলে পাহাড়ি এলাকায় জনবসতি কম। তাই আস্তানা ও প্রশিক্ষণকেন্দ্র এবং সদস্যদের আনাগোনা কারও নজরে পড়বে না। সমতল ঘনবসতিপূর্ণ হওয়ায় এই সুবিধা নেই।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের সূত্র বলেছে, জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার প্রতিষ্ঠাতা শামিন মাহফুজ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র শামিন বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে ২০১৪ সালে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন।
কারাগারে তাঁর সঙ্গে বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের নেতাদের পরিচয় হয়। সেখানেই নতুন জঙ্গি সংগঠন তৈরির পরিকল্পনা হয়। ২০১৮ সালে জামিনে মুক্তির পর শামিন অন্য জঙ্গি সংগঠনগুলোর সদস্যদের সমন্বয়ে নতুন সংগঠন তৈরির কাজ শুরু করেন। পাহাড়ি সন্ত্রাসী সংগঠন কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) নেতা নাথান বমের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে সখ্য ছিল তাঁর। পরে জঙ্গিদের প্রশিক্ষণের জন্য নাথান বমের সঙ্গে চুক্তি হয়। বান্দরবানে করা হয় প্রশিক্ষণকেন্দ্র। সেখানেই ২০২২ সালে নামকরণ হয় নতুন জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসারের। শামিনের স্ত্রীও এই দলের সদস্য।
সিটিটিসি বলছে, কুমিল্লার আট তরুণের একসঙ্গে নিখোঁজের ঘটনা তদন্তে র্যাব বান্দরবানের পাহাড়ে জামাতুল আনসারের অস্তিত্ব পেয়ে গত অক্টোবরের শেষ দিকে অভিযান শুরু করে। চলতি বছরের মে পর্যন্ত একের পর এক অভিযানে জঙ্গি সংগঠনটির বেশ কিছু আস্তানা গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। ধরা পড়ে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ‘হিজরতে’ এসে প্রশিক্ষণ নেওয়া সংগঠনটির অর্ধশত সদস্য। শামিনকে স্ত্রীসহ রাজধানীর ডেমরা থেকে গ্রেপ্তার করা হয় গত জুনে।
গোয়েন্দাদের একটি সূত্র বলেছেন, জামাতুল আনসারের পরিকল্পনা ছিল মিয়ানমারের রোহিঙ্গা উগ্র সংগঠনগুলোর সঙ্গে আল-কায়েদা ভারতীয় উপমহাদেশ শাখার (একিউআইএস) সম্পর্ক করিয়ে দেওয়া। নজরে আসতে সংগঠনটি তার প্রশিক্ষণ ও আস্তানার ছবি, ভিডিও একিউআইএসকে পাঠিয়েছিল। সীমান্তবর্তী মিজোরাম হয়ে তারা ভারতীয় উগ্রবাদীদের সঙ্গেও সহজে যোগাযোগ স্থাপনের সুযোগ পেয়েছিল। জঙ্গিরা পাহাড়ে আস্তানা করায় স্থানীয় লোকজনের মধ্যে যে আতঙ্ক ছড়িয়েছিল, র্যাবের টানা অভিযানের পরও তা পুরোপুরি কাটেনি।
বান্দরবানের রুমা উপজেলার রেমাক্রী প্রাংসা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জিরা বম আজকের পত্রিকাকে বলেন, মানুষ আতঙ্কে এখনো নিজ ঘরে ফিরছে না।
র্যাবের মুখপাত্র খন্দকার আল মঈন বলেন, জামাতুল আনসারের সদস্যদের মধ্যে বেশির ভাগই ধরা পড়েছে। তারা নতুন করে সংগঠিত হতে পারবে না। তবে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের পলাতক সদস্যরা আবার তৎপর হতে পারে।
চলতি আগস্ট মাসে মৌলভীবাজারের কুলাউড়ার পাহাড়ি এলাকায় নতুন জঙ্গি সংগঠন ইমাম মাহমুদের কাফেলার সন্ধান পায় সিটিটিসি। সিটিটিসি বলেছে, এই সংগঠনটিও সমতলের চেয়ে পাহাড়ি এলাকায় আস্তানাকে বেশি নিরাপদ মনে করে। সংগঠনটির শীর্ষস্থানীয় নেতারাসহ বেশির ভাগ সদস্য পরিবার নিয়ে ঘর ছেড়ে সেখানে গিয়েছিলেন। পুরো পরিবারকেই তাঁরা উগ্রবাদে ‘উদ্বুদ্ধ’ করেছেন। শিশুরাও বাদ যায়নি। সংগঠনটির নেতৃত্বে আছেন ইমাম মাহমুদ ওরফে জুয়েল ওরফে হাবিবুল্লাহ। ঢাকা ও মৌলভীবাজার থেকে সংগঠনের অন্তত ৫০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার ও সিটিটিসির প্রধান মো. আসাদুজ্জামান আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমরা সম্প্রতি দেখছি, একটি পরিবারের পুরুষ সদস্য নিজে জঙ্গিবাদে জড়ানোর পর পরিবারের নারী, শিশু ও কিশোর বয়সীদেরও জঙ্গিবাদে নিয়ে আসছেন। এটি আমাদের জন্য বিপৎসংকেত।’