২৮ এপ্রিল ২০২৪, রবিবার, ০৯:২৫:০৮ অপরাহ্ন
গুম তদন্ত জাতিসংঘের প্রস্তাব মেনে নেওয়ার আহ্বান এইচআরডব্লিউর
  • আপডেট করা হয়েছে : ৩০-০৮-২০২৩
গুম তদন্ত জাতিসংঘের প্রস্তাব মেনে নেওয়ার আহ্বান এইচআরডব্লিউর

জোরপূর্বক গুমের ঘটনায় নিরপেক্ষ তদন্ত কমিশনে সমর্থন দেওয়ার যে প্রস্তাব দিয়েছে জাতিসংঘ, বাংলাদেশের তা মেনে নেওয়া উচিত। 


মঙ্গলবার জোরপূর্বক গুমবিষয়ক আন্তর্জাতিক দিবস উপলক্ষ্যে নিজস্ব ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা এক প্রতিবেদনে এ আহ্বান জানিয়েছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকারবিষয়ক সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ। 


ইংরেজিতে তারা যে শিরোনাম করেছে, তার বাংলা অর্থ— বাংলাদেশ: জোরপূর্বক গুমের তদন্ত উন্মুক্ত করতে হবে। জাতিসংঘের তদন্তে সহযোগিতা করতে হবে। (গুমের শিকার) পরিবারগুলো দীর্ঘদিন উত্তরের জন্য অপেক্ষায় আছে। 


এতে বলা হয়েছে, নিরাপত্তা রক্ষাকারীদের হাতে জোরপূর্বক গুমের অভিযোগ বরাবরই অস্বীকার করে আসছে কর্তৃপক্ষ। পক্ষান্তরে তারা প্রহসনমূলকভাবে দাবি করে, ওইসব মানুষ আত্মগোপন করে আছেন। 


বাংলাদেশি মানবাধিকার মনিটরদের তথ্যমতে, ২০০৯ সাল থেকে নিরাপত্তা রক্ষাকারীরা কমপক্ষে ৬০০ মানুষকে জোরপূর্বক গুম করেছে। কিছু মানুষকে পরে মুক্তি দেওয়া হয়েছে, আদালতে তোলা হয়েছে অথবা বলা হয়েছে, নিরাপত্তা রক্ষাকারীদের সঙ্গে গুলির লড়াইয়ে নিহত হয়েছেন তারা। এখনো প্রায় ১০০ মানুষ নিখোঁজ আছেন। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী জোরপূর্বক গুমের অভিযোগ তদন্তের জন্য একটি স্পেশালাইজড মেকানিজম প্রতিষ্ঠায় সাহায্যের প্রস্তাব দিয়েছে জাতিসংঘ।


হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়াবিষয়ক সিনিয়র গবেষক জুলিয়া ব্লেকনার বলেন, জোরপূর্বক গুমের বাস্তবতাকে অব্যাহতভাবে অস্বীকার করে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ কাউকেই বোকা বানাতে পারছে না। পক্ষান্তরে তারা গুমের শিকার ব্যক্তিদের পরিবারের দুর্ভোগকে প্রলম্বিত করছে। এসব পরিবার জানে না তাদের প্রিয়জনরা কোথায় আছেন। এসব নির্যাতনের সমাধানের জন্য জোরপূর্বক গুমের তদন্তে জাতিসংঘ যে একটি নিরপেক্ষ তদন্ত কমিশন উন্মুক্ত করায় সহাযোগিতার কথা বলেছে, তার প্রতি খাঁটি প্রতিশ্রুতি প্রদর্শন করা উচিত সরকারের। 



সম্প্রতি এক বিক্ষোভে ১২ বছরের আদিবা ইসলাম রিদি বলেছে, প্রতিটি মুহূর্ত আমি আশায় থাকি যে, আমার বাবা ফিরে আসবেন এবং অন্যদের মতো আমাকেও জড়িয়ে ধরবেন। এটি যে কতটা বেদনার তা প্রকাশ করতে পারব না। এরই মধ্যে ১০ বছর পেরিয়ে গেছে। কিন্তু আমার অপেক্ষার কোনো শেষ হয়নি। 


তার বাবা পারভেজ হোসেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির একজন কর্মী ছিলেন। আদিবার বয়স যখন ২ বছর, তখন ২০১৩ সালের ২ ডিসেম্বর জোরপূর্বক তার বাবাকে গুম করা হয়। ওই দিন পারভেজ হোসেন এবং বিএনপির অন্য তিনজন কর্মী বন্ধুদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে একটি বিনোদনমূলক পার্কে যাচ্ছিলেন হেঁটে। এ সময় একটি সাদা ভ্যান উপস্থিত হয় এবং তাদের তুলে নিয়ে যায়। এ চারজনকে তুলে নিয়ে যাওয়ার পর পরই একজন বলেন, তিনি তাদেরকে পুলিশের ডিটেকটিভ ব্রাঞ্চের অফিসে নিরাপত্তা হেফাজতে দেখেছেন। কিন্তু তাদের আটক রাখার কথা অস্বীকার করে কর্তৃপক্ষ। অন্য কয়েক ডজন মানুষের মতো পারভেজ হোসেন কোথায় আছেন তা আজও অজানা। 


২০২১ সালের ১০ ডিসেম্বর মানবাধিকারবিষয়ক গ্লোবাল ম্যাগনিটস্কির অধীনে র্যাব ও এর শীর্ষ কয়েকজন কমান্ডারের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে যুক্তরাষ্ট্র। অভিযোগ করা হয় তারা আইন লঙ্ঘন, বিশেষ করে জোরপূর্বক গুম এবং বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত। 


হিউম্যান রাইটস ওয়াচ আরও বলেছে, এখন পর্যন্ত জোরপূর্বক গুমের অভিযোগ নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ তদন্তের পরিবর্তে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ ভিকটিমের পরিবারকে হয়রান এবং ভীতি প্রদর্শন করছে। পরিবারগুলো বলেছে, তাদের প্রিয়জন নিখোঁজ হওয়ার বিষয়ে পুলিশে অভিযোগ দিয়েছেন। তা সত্ত্বেও তাদের ওইসব প্রিয়জন কোথায় আছেন, সে সম্পর্কে তাদেরকে বার বার জিজ্ঞাসাবাদ করে কর্তৃপক্ষ। পরিবারগুলোকে কর্মকর্তারা হুমকি ও চাপ দেন অভিযোগ প্রত্যাহার করে নিতে অথবা পুলিশের রিপোর্টে ঘটনা ‘রিভাইজ’ করতে বলেন। এর মধ্য দিয়ে নিরাপত্তা রক্ষাকারী বাহিনী যে গুমের সঙ্গে জড়িত তার প্রমাণ মুছে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। 


পরিবারগুলো আরও বলছে, কর্তৃপক্ষ তাদের বাড়িতে যায় এবং তাদের  মিথ্যা বিবৃতিতে স্বাক্ষর দিতে বাধ্য করে। ওইসব বিবৃতিতে বলা হয়, তাদের পরিবারের সদস্যদের জোরপূর্বক গুম করা হয়নি এবং তারা পুলিশকে বিভ্রান্ত করতে ইচ্ছাকৃতভাবে লুকিয়ে আছেন।  


হিউম্যান রাইটস ওয়াচ আরও বলেছে, জোরপূর্কক গুমের শিকার পরিবারগুলোর সঙ্গে সাক্ষাতে বারবার কূটনীতিকদের বাধা দেয় ক্ষমতাসীন দলের সমর্থকরা ও কর্তৃপক্ষ। এক্ষেত্রে উদাহরণ হিসেবে ২০২২ সালের ১৪ ডিসেম্বরের ঘটনা তুলে ধরা হয়েছে। ওই দিন ভিকটিম পরিবারগুলোর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন বাংলাদেশে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাস। কিন্তু সেখানে জোর করে ঢোকার চেষ্টা করে ক্ষমতাসীন দলের সমর্থকরা। এতে নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়। ফলে তিনি সেই মিটিংয়ের ইতি টানেন। ক্ষমতাসীন দলের সমর্থকদের পক্ষ অবলম্বন করে কথা বলে সরকার এবং তারা বলে এমন মিটিং করা উচিত হয়নি রাষ্ট্রদূতের। 



নিরাপত্তা রক্ষাকারীদের হাতে জোরপূর্বক গুম সমস্যার অর্থপূর্ণ একটি সমাধানের জন্য সরকারের প্রতি বারবার আহ্বান জানিয়ে আসছে দাতা সরকার, জাতিসংঘ, মানবাধিকারবিষয়ক সংগঠনগুলো এবং নাগরিক সমাজ। কিন্তু সেসব আহ্বান উপেক্ষা করছে সরকার। 


হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছে, জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক জোরপূর্বক গুম বাদে মৌলিক সব চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী বাংলাদেশ। ২০২২ সালের আগস্টে বাংলাদেশ সফর করেন জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার মিশেল ব্যাশেলে। তিনি বাংলাদেশকে এই কনভেনশনে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানান। জাতিসংঘের জোরপূর্বক গুমবিষয়ক ওয়ার্কিং গ্রুপকে বাংলাদেশ সফরে আমন্ত্রণ জানাতে, যাতে এই সমস্যার নিষ্পত্তিমূলক সমাধানে প্রতিশ্রুতি প্রদর্শন করা যায়।


ব্লেকনার বলেন, যদি নির্যাতনকারীদের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘন বিষয়ক নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার গুরুত্ব দিয়ে চায় বাংলাদেশ সরকার, তাহলে জবাবদিহিতার দিকে তাদেরকে দৃঢ় পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। 


জোরপূর্বক গুম হচ্ছে, অভিযোগের স্বচ্ছ ও পক্ষপাতিত্বহীন তদন্ত হচ্ছে- এটা স্বীকার করার মধ্য দিয়েই শুরু হয় জবাবদিহিতা।


শেয়ার করুন