২৮ এপ্রিল ২০২৪, রবিবার, ০৮:১২:৪০ অপরাহ্ন
মাউশির আইসিটি প্রকল্প: শিক্ষার প্রশিক্ষণে দুর্নীতির পাঠ
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৪-০৯-২০২৩
মাউশির আইসিটি প্রকল্প: শিক্ষার প্রশিক্ষণে দুর্নীতির পাঠ

প্রশিক্ষণ ভেন্যুর ভাড়া দিতেই খরচ ৯ কোটি ৩০ লাখ ১৩ হাজার ৫০০ টাকা! এই খরচ দেখানো হয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা (মাউশি) অধিদপ্তরের একটি প্রকল্পের প্রশিক্ষণে। ১২টি প্রতিষ্ঠানে এই প্রশিক্ষণ হলেও একটি প্রতিষ্ঠানকে একক ভেন্যু না দেখিয়ে প্রতিটি কক্ষকে একেকটি ভেন্যু হিসেবে ভাড়া উত্তোলন করা হয়েছে। এমন অনিয়ম ধরা পড়েছে বাংলাদেশ মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের অধীন শিক্ষা অডিট অধিদপ্তরের নিরীক্ষা প্রতিবেদনে।


প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রাপ্য না হলেও কর্মকর্তা, প্রশিক্ষক, প্রশিক্ষণার্থী ও সহায়ক কর্মচারীদের সম্মানী এবং ভাতা দিয়ে সরকারের ৩ কোটি ১৪ লাখ ৯২ হাজার ২৮৮ টাকা আর্থিক ক্ষতি করা হয়েছে। ভেন্যুতে উপস্থিত না থেকেও এক কর্মকর্তার পক্ষে অন্যজনের স্বাক্ষরে এবং কর্মকর্তার নামের বিপরীতে ভুয়া স্বাক্ষরের মাধ্যমেও সম্মানী তোলা হয়েছে। এ ছাড়া মাল্টিমিডিয়া শ্রেণিকক্ষ স্থাপিত না হলেও সাড়ে ১৩ হাজারের বেশি ইন্টারনেট মডেম কিনে বিতরণ করা হয় এবং সেগুলো ব্যবহৃত না হওয়ায় ৩ কোটি ৪৩ লাখ ৩৭ হাজার ৭৩৬ টাকা অপচয় করা হয়েছে।


নয়ছয়ের এই ব্যয় হয়েছে মাউশির ‘আইসিটির মাধ্যমে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষার প্রচলন (দ্বিতীয় পর্যায়)’ শীর্ষক প্রকল্পে প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে। শিক্ষা অডিট অধিদপ্তরের প্রতিবেদনে এই প্রশিক্ষণের খরচে অনিয়ম তুলে ধরে ১২টি অডিট ফাইন্ডিংস উল্লেখ করা হয়েছে। এই অনিয়ম হয়েছে চার অর্থবছরে, ২০১৭-২০১৮ থেকে ২০২০-২০২১ অর্থবছর পর্যন্ত। পারফরম্যান্স অডিটের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রশিক্ষণে অনিয়মের মাধ্যমে সরকারের ১৭ কোটি ৩৮ লাখ ৫৩ হাজার ৪৮৫ টাকার আর্থিক ক্ষতি ও অপচয় হয়েছে। প্রতিবেদনটি গত ২০ আগস্ট মাউশিতে পাঠানো হয়। অনিয়ম হওয়া টাকা আদায়ের পাশাপাশি দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।


শিক্ষা অডিট অধিদপ্তরের পরিচালক মো. আমীমুল এহসান কবীর আজকের পত্রিকাকে বলেন, পারফরম্যান্স অডিট ইন্সপেকশন প্রতিবেদনটি সংশ্লিষ্ট দপ্তরে পাঠানো হয়েছে। তিন সপ্তাহের মধ্যে আপত্তিগুলোর জবাব দিতে অনুরোধ করা হয়েছে।


তবে প্রতিবেদনের বিষয়ে মাউশির পরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন উইং) অধ্যাপক ড. এ কিউ এম শফিউল আজম আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘বিষয়টি আমার জানা নেই, অবশ্যই খোঁজ নেব।’


দেশের মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরে শ্রেণিকক্ষের পাঠদান আধুনিকায়ন এবং আইসিটিভিত্তিক জ্ঞান বিকাশের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এর অংশ হিসেবে ২০১৬ সালের জুনে আইসিটির মাধ্যমে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরে শিক্ষার প্রচলন (দ্বিতীয় পর্যায়) শীর্ষক প্রকল্পটি নেওয়া হয়। এতে ব্যয় ধরা হয় মোট ১ হাজার ৩৫৩ কোটি টাকা। এই প্রকল্পের আওতায় ৫ লাখ ৭২ হাজার ৮৪০ জন শিক্ষককে প্রশিক্ষণ, ৪৬ হাজার ৩৪০টি মাল্টিমিডিয়া শ্রেণিকক্ষ তৈরি, ২ হাজার ১২০টি স্মার্ট শ্রেণিকক্ষ তৈরি, ৬৬৮টি মাল্টিমিডিয়া প্রশিক্ষণ কক্ষ ও কনফারেন্স রুম তৈরি, ৩৩টি সেমিনার আয়োজনের কথা। তবে প্রকল্প শুরুর পর সাড়ে ছয় বছরে অগ্রগতি মাত্র ৮ দশমিক ৬৪ শতাংশ। নতুন করে আবার প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৬ সালের জুন পর্যন্ত বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।


প্রতিবেদনের বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক অধ্যাপক ড. মো. মোরশীদুল হাসান ৩১ আগস্ট আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমি দায়িত্ব নেওয়ার আগে এই প্রশিক্ষণগুলো হয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী অডিট আপত্তিগুলোর জবাব দেওয়া হবে। এর আগেও কমপ্লায়েন্স অডিট আপত্তির জবাব দিয়েছি।’ 


প্রতিটি কক্ষই একেকটি ভেন্যু

শিক্ষা অডিট অধিদপ্তরের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১২টি সরকারি শিক্ষক প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান ও প্রকল্প কার্যালয়ে প্রশিক্ষণ হয়েছে। এতে ১২ ক্যাটাগরিতে অংশ নিয়েছেন ১ লাখ ৪৭ হাজার ৯১৩ জন শিক্ষক-প্রশিক্ষক ও কর্মকর্তা। প্রশিক্ষণ ভেন্যুগুলো হলো: সরকারি শিক্ষক প্রশিক্ষণ কলেজ, রাজশাহী; উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট, রাজশাহী; সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ, যশোর; সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ, বরিশাল; উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট, বরিশাল; সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ (পুরুষ), ময়মনসিংহ; সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ (মহিলা), ময়মনসিংহ; সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ, কুমিল্লা; উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট, কুমিল্লা; সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ, সিলেট; সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ, চট্টগ্রাম; সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ, ঢাকা। প্রতিষ্ঠানগুলোতে একই সময়ে একাধিক ব্যাচে ভিন্ন ভিন্ন কক্ষে একই প্রশিক্ষণ হয়েছে। অথচ প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে একক ভেন্যু হিসেবে বিবেচনা না করে প্রতিটি কক্ষকে একেকটি ভেন্যু দেখানো হয়েছে। এসব ভেন্যুর এবং মাউশির প্রকল্প কার্যালয়ের ভাড়া বাবদ খরচ দেখানো হয়েছে মোট ৯ কোটি ৩০ লাখ ১৩ হাজার ৫০০ টাকা। এর মধ্যে মাউশির প্রকল্প কার্যালয়ের ভাড়া দেখানো হয়েছে ১২ লাখ ৫৫ হাজার ৫০০ টাকা। তবে এসব ভাড়া নির্দেশনা অনুযায়ী সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়া হয়নি।


নিরীক্ষা প্রতিবেদনে এই অর্থ আদায় করে সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। 


প্রাপ্য না হলেও সম্মানী ভাতা

নিরীক্ষা প্রতিবেদন বলছে, ঢাকায় প্রধান কার্যালয়ে কর্মরত প্রকল্প পরিচালক, উপপরিচালক, সহকারী পরিচালক পদের একাধিক কর্মকর্তা প্রশিক্ষণ ভেন্যুতে না গিয়েও এক কর্মকর্তার পক্ষে অন্য কর্মকর্তার স্বাক্ষরে এবং কর্মকর্তার নামের বিপরীতে ভুয়া স্বাক্ষরের মাধ্যমে সম্মানী নিয়েছেন। এ ছাড়া প্রশিক্ষণ ভেন্যুতে কর্মরত প্রশিক্ষকেরা ভ্রমণ ভাতা, ভ্রমণ ভাতা-সংক্রান্ত নির্দেশনা লঙ্ঘন করে সব প্রশিক্ষণার্থীকে ভ্রমণ ভাতা এবং বাজেট না থাকলেও বিধিবহির্ভূতভাবে ডেটা এন্ট্রি অপারেটরদের সম্মানী দেওয়া হয়েছে। প্রাপ্য না হলেও এসব সম্মানী ও ভাতা দিয়ে সরকারের ৩ কোটি ১৪ লাখ ৯২ হাজার ২৮৮ টাকা ক্ষতি করা হয়েছে। চাকরিবিধি অনুযায়ী, ৫ মাইল বা ৮ কিলোমিটারের কম দূরত্বে ভ্রমণ ভাতা প্রাপ্য নয়। 


প্রশিক্ষণ উপকরণ কেনায়ও অনিয়ম 

নিরীক্ষা প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রশিক্ষণের জন্য উপকরণ কেনাকাটায়ও অনিয়ম হয়েছে। প্রয়োজন না থাকলেও প্রশিক্ষণ ম্যানুয়াল, সনদ ছাপানো হয়েছে। একটি ভাউচার একাধিকবার ফটোকপি করে প্রশিক্ষণ উপকরণ কেনা এবং খাবারের একাধিক বিলে সংযোজন করা হয়েছে। ভেন্যুগুলো সরবরাহকারীর কাছ থেকে নগদে প্রশিক্ষণ উপকরণ কিনলেও পরিবহন খরচ দেওয়া হয়েছে। একই পণ্য বারবার কেনা দেখানো হয়েছে। কোনো কোনো ভেন্যুতে কেনা পণ্যের সুনির্দিষ্ট আইটেমও উল্লেখ করা হয়নি। এসব অনিয়মে ক্ষতি ৫৮ লাখ ২৫ হাজার ৯৬১ টাকা।

 

মাল্টিমিডিয়া শ্রেণিকক্ষের আগেই মডেম কেনা

প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, মাল্টিমিডিয়া শ্রেণিকক্ষ স্থাপনের জন্য ল্যাপটপ, প্রজেক্টর, ইন্টারনেট মডেম, স্টেরিও স্পিকার নির্ধারিত ছিল। কিন্তু অন্য সামগ্রী না কিনে শুধু ১৩ হাজার ৫৭৪টি ইন্টারনেট মডেম কেনা ও বিতরণ করা হয়। কিন্তু মাল্টিমিডিয়া শ্রেণিকক্ষ স্থাপিত না হওয়ায় মডেমগুলো মাল্টিমিডিয়া শ্রেণিকক্ষ পরিচালনায় ব্যবহৃত হয়নি। এতে সরকারের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ৩ কোটি ৪৩ লাখ ৩৭ হাজার ৭৩৬ টাকা।


কনসালট্যান্সি ফি প্রদান

নিরীক্ষার তথ্য বলছে, প্রকল্পের কেনাকাটার জন্য অধ্যাপক খবিরুল হক চৌধুরীকে পরামর্শক (কনসালট্যান্ট) নিয়োগ করা হয়। ২৪ মাস মেয়াদ থাকলেও তিনি কাজ করেন ১৮ মাস ২২ দিন। তবে ডিপিপি অনুসারে নির্ধারিত কেনাকাটা সম্পন্ন না হওয়ায় পরামর্শক সম্মানী বাবদ অপচয় হয়েছে ৫৬ লাখ ২০ হাজার টাকা। 

জানতে চাইলে খবিরুল হক চৌধুরী আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘তাঁদের তথ্য সত্য নয়। উল্টো বেআইনিভাবে তাঁরা আমার প্রাপ্য সম্মানী আটকে রেখেছেন। এ জন্য তাঁদের চিঠিও দিয়েছি।’ 


ইন্টারনেট না থাকলেও বিল

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রশিক্ষণ কক্ষে ইন্টারনেট সংযোগ না থাকলেও ১৯ লাখ ৪১ হাজার টাকা ইন্টারনেটের বিল পরিশোধ করা হয়েছে বলে দেখানো হয়েছে। এ ছাড়া নির্দিষ্ট বরাদ্দের বাইরে ১৬ লাখ ২৩ হাজার ৬০০ টাকার অতিরিক্ত ইন্টারনেট বিল পরিশোধ দেখানো হয়েছে।


নিরীক্ষা প্রতিবেদনের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, এ প্রকল্পে প্রশিক্ষণের নামে যেভাবে রাষ্ট্রীয় অর্থ লুটপাট করা হয়েছে, তা নজিরবিহীন। এর সঙ্গে জড়িত সবাইকে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে; যাতে ভবিষ্যতে এ ধরনের অনিয়ম বন্ধ হয়।


শিক্ষা অডিট অধিদপ্তরের এই অডিট আপত্তিগুলোর বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের যুগ্ম সচিব (নিরীক্ষা ও আইন) মূকেশ চন্দ্র বিশ্বাস বলেন, এখনো প্রতিবেদনটি পাননি। অডিট আপত্তি হলে নিয়ম অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা ব্রডশিটে জবাব দেবেন। এরপর তা নিষ্পত্তির জন্য ত্রিপক্ষীয় বৈঠক ডাকা হবে। এতেও নিষ্পত্তি না হলে আইন অনুযায়ী পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।


শেয়ার করুন