আওয়ামী লীগ সরকারের উদ্যোগে ২০১৩ সালে গাজীপুরের শ্রীপুরে নির্মাণ করা হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্ক। দেশি-বিদেশি নানা প্রাণী এ পার্কে বেশ কয়েক বছর ধরেই মানুষের চিত্তবিনোদনের খোরাক জোগাচ্ছে। চলতি বছরের ৩০ জুন প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর পার্কটির ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পেয়েছে বন বিভাগের বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ।
কিন্তু নানা প্রতিকূলতায় স্বকীয়তা হারাচ্ছে পার্কটি। অবহেলা, দায়িত্বহীনতায় প্রাণী মারা যাওয়ার পাশাপাশি অর্থনৈতিকভাবেও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। পার্কের অরক্ষিত সীমানা দিয়ে প্রাণী বের হয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। জাতির পিতার নামে প্রতিষ্ঠিত পার্কটির জৌলুশ ফিরিয়ে আনতে সরকারের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০২২ সালের ২ জানুয়ারি থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ১১টি জেব্রা, ১টি বাঘ ও ১টি সিংহের মৃত্যু হয়। এ ঘটনার পর
নানা আলোচনা ও সমালোচনা হয় পার্কের ব্যবস্থাপনা নিয়ে। পরে ২১ ডিসেম্বর কর্তৃপক্ষের অবহেলায় পার্কে একটি হাতি মারা যাওয়ার অভিযোগ ওঠে। এর পাঁচ দিন আগে মারা যায় একটি সিংহী ও ওয়াইল্ডবিস্ট।
চলতি বছরের গত আগস্টে পার্কে মারা যায় একটি ম্যাকাও পাখি ও একটি ওয়াইল্ডবিস্ট। পার্কে কোনো প্রাণী মারা গেলে ময়নাতদন্ত ও শ্রীপুর থানায় সাধারণ ডায়েরি করেই দায় সারে কর্তৃপক্ষ। পুরো প্রক্রিয়াটি পার্ক কর্তৃপক্ষ নিজেই করায় প্রাণীর মৃত্যুর ঘটনাগুলোতে তাদের অবহেলার বিষয়টি আর সামনে আসে না।
প্রথম দফায় জেব্রা মারা যাওয়ার পরপর বিশেষজ্ঞরা প্রাণীর মৃত্যু রোধ ও পার্ক ব্যবস্থাপনা উন্নয়নে করণীয় বিষয়ে ১১টি স্বল্পমেয়াদি, ৪টি মধ্যমেয়াদি এবং ৯টি দীর্ঘমেয়াদি সুপারিশ বাস্তবায়নের কথা বলেন। কিন্তু সেগুলো বাস্তবায়নে কোনো উদ্যোগ নেয়নি পার্ক কর্তৃপক্ষ। জবাবদিহি নিশ্চিত না থাকায় কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের স্বেচ্ছাচারিতায় পার্কটি জৌলুশ হারাচ্ছে।
এদিকে পুরো পার্কের সীমানার মধ্যে এখনো ৮০০ মিটার এলাকায় প্রাচীর নেই। অরক্ষিত এই এলাকা দিয়ে পার্ক থেকে প্রাণী বের হয়ে যাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে ২০২১ সালে। পার্ক থেকে বের হয়ে যাওয়া একটি নীলগাই টাঙ্গাইলের মধুপুর থেকে উদ্ধার করা হয়। এ ছাড়া পার্কের ভেতরে থাকা স্থানীয় বাসিন্দাদের জমি অধিগ্রহণ না করায় তাঁরা অনায়াসেই সেখানে প্রবেশ করেন।
এতে অনেকটা নিরাপত্তাহীনতা রয়েছে পার্কে। অরক্ষিত এই এলাকা দিয়ে পার্কের ভেতর থেকে গজারিগাছ পাচারের ঘটনাও ঘটেছে। পার্কটি ৩ হাজার ৬৯০ একর ভূমি নিয়ে গঠিত হলেও এখন জমি রয়েছে প্রায় ৩ হাজার ২০০ একর। ৪০০ একর ভূমির কোনো হদিস মিলছে না।
নানা অভিযোগ পার্কের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে
বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কের বর্তমান দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম দুই মেয়াদে এই পার্কের দায়িত্বে আছেন। তাঁর বিরুদ্ধে অব্যবস্থাপনা ও পার্কের পার্কিং এলাকার ভেতর দোকান বসিয়ে বাণিজ্যের অভিযোগ রয়েছে। চলতি মেয়াদের আগে তিনি আরও দুই বছর এই পার্কের দায়িত্বে ছিলেন।
এ বিষয়ে পার্কের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, পার্কিং এলাকা ইজারা দেওয়া আছে। সেখানে কোনো দোকান বসালে এর দায় ইজারাদারের। টাকা নেওয়ার অভিযোগ শতভাগ মিথ্যা। দুই মেয়াদে দায়িত্ব পালনের বিষয়ে তিনি বিভাগীয় অফিসে যোগাযোগের পরামর্শ দেন।
রোদ-বৃষ্টিতে ভোগান্তি
প্রতিদিন হাজারো পর্যটক আসেন বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কে। কিন্তু বিশাল আয়তনের এ পার্কে এত বছরেও বিশ্রামাগার নির্মাণ করা হয়নি। রোদ-বৃষ্টির ভোগান্তিতে পড়তে হয় দর্শনার্থীদের। কিন্তু এই সমস্যার সমাধানে পার্ক কর্তৃপক্ষের নেই কোনো নজরদারি। এ নিয়ে পর্যটকদের অভিযোগের শেষ নেই।
বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের ঢাকা বিভাগীয় বন কর্মকর্তা শারমীন আক্তার জানান, তাঁর বিভাগ চিঠির মাধ্যম সাফারি পার্ক ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পেলেও এখনো পুরো দায়িত্ব বুঝে নেননি। এসব বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগের পরামর্শ দেন তিনি।
বন্য প্রাণী প্রকৃতি সংরক্ষণ অঞ্চলের প্রধান বন সংরক্ষক ইমরান আহমেদ বলেন, পার্কসংশ্লিষ্ট ইজারার কার্যক্রম চলমান আছে। শিগগির দরপত্র আহ্বান করা হবে। পার্কের বিভিন্ন অনিয়মের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘প্রাণী ব্যবস্থাপনা নিয়ে কাজ চলছে। আশা করছি, অনিয়ম থাকবে না।’