শহর ছাড়িয়ে প্রত্যন্ত অঞ্চলেও এবার ছড়িয়ে পড়েছে ডেঙ্গু। এডিস মশাবাহিত এ রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রতিদিনই মারা যাচ্ছে মানুষ। রাজধানীর বাইরে হাসপাতালগুলো ডেঙ্গু রোগীদের সেবা দিতে হিমশিম খাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে মশা নিধন বা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে থাকা স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রম নিয়ে সমালোচনামুখর বিশেষজ্ঞ থেকে শুরু করে জনপ্রতিনিধিরাও। প্রশ্ন আছে সিটি করপোরেশন, পৌরসভার মতো স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর ভূমিকা নিয়েও।
জানা গেছে, স্থানীয় সরকার বিভাগ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ডেঙ্গু মোকাবিলা, পরিচ্ছন্নতা ও প্রচার খাতে (স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব ব্যয়ের বাইরে) ৪০ কোটি টাকা বরাদ্দ রেখেছে। এরই মধ্যে ৩২৫টি পৌরসভাকে প্রথম কিস্তির মোট ৪ কোটি ৯৯ লাখ ৯৭ হাজার ৫০০ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এর আগে সিটি করপোরেশনগুলোকে দেওয়া হয়েছে মোট ১০ কোটি টাকা। বিশেষজ্ঞরা ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা বলছেন, এই বরাদ্দ একেবারেই অপ্রতুল।
নগর-পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘সারা দেশে ডেঙ্গু যে বিপজ্জনক অবস্থায় গেছে, এর দায় কোনোভাবেই স্থানীয় সরকার বিভাগ এড়াতে পারে না। স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোকে ডেঙ্গু মোকাবিলায় সেভাবে প্রস্তুত করা হয়নি। দেশের পৌরসভাগুলো তাদের নিজস্ব অর্থ দিয়ে বেতন-ভাতাই দিতে পারে না, সেখানে আবার তাদের বলা হচ্ছে নিজস্ব তহবিল থেকে মশা নিধন বা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতায় অর্থ ব্যয় করতে। এতে আসলে কাজের কাজ কিছুই হবে না। স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোতে অর্থ বরাদ্দের পাশাপাশি মন্ত্রণালয় থেকে মনিটরিং বাড়াতে হবে।’
নরসিংদী জেলার মনোহরদী পৌরসভার মেয়র আমিনুর রহমান সুজন বলেন, ‘মশকনিধনের জন্য আমরা যে অর্থ বরাদ্দ পাচ্ছি, তা যথেষ্ট নয়।’
স্থানীয় সরকার বিভাগের যুগ্ম সচিব মোহাম্মদ নুরে আলম ছিদ্দিকী অবশ্য বলেন, ‘এডিস মশা যখন শহর থেকে গ্রামগঞ্জে ছড়িয়ে পড়েছে, তখন সঙ্গে সঙ্গে আমরা নানা ধরনের কার্যক্রম হাতে নিয়েছি। জরুরি বিবেচনায় অন্য খাত থেকে অর্থ এনে ইউনিয়ন পরিষদগুলোকে দেওয়া হচ্ছে। যেহেতু ডেঙ্গু মোকাবিলায় ইউনিয়ন পর্যায়ে এ বছরই প্রথম টাকা দেওয়া হচ্ছে; তাই এখনো এ টাকা খরচের বিষয়ে কোনো গাইডলাইন তৈরি করা সম্ভব হয়নি।
তবে স্থানীয় সরকার বিভাগ এ বিষয়ে জেলা প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে একাধিকবার সভা করেছে। তাদের সঙ্গে নিয়েই কাজ করা হচ্ছে।’
কয়েকজন জনপ্রতিনিধি জানান, অর্থের অভাবে যেখানে মশা নিধন কার্যক্রম চালানো যাচ্ছে না, সেখানে এখনো করোনা মোকাবিলার নামে ২০২২-২৩ অর্থবছরেও ২২৮টি পৌরসভাকে ১০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এই অর্থ দিয়ে সাবান, হ্যান্ড স্যানিটাইজার ও থার্মাল স্ক্যানার কেনা এবং টিকা বুথ স্থাপন করতে বলা হয়েছে।
স্থানীয় সরকার বিভাগের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, রাজধানীর বাইরে সিটি করপোরেশন, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ অর্থের অভাবে হিমশিম খাচ্ছে; সেখানে করোনা মোকাবিলার নামে এখনো স্থানীয় সরকার বিভাগ নিয়মিত অর্থ বরাদ্দ দিয়ে যাচ্ছে। এসব অর্থ মাস্ক, হ্যান্ড স্যানিটাইজার, সিলিন্ডার, থার্মাল স্ক্যানার এবং টিকার বুথ স্থাপনের জন্য খরচ করতে বলা হচ্ছে। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী এ খাতগুলো ছাড়া অন্য কোথাও এসব অর্থ খরচ করা যাবে না। দুই-তিন বছর ধরেই এসব অর্থ দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু দেশে এখন সিটি করপোরেশন এলাকায়ও করোনার বিষয়ে সরকারি কোনো কার্যক্রম চলতে দেখা যায় না। সেখানে ইউনিয়ন ও পৌরসভায় এই অর্থ মূলত বিল ভাউচার করে হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে।
ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে মশা নির্মূল করার ওপর বারবার গুরুত্বারোপ করছেন স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক। ১২ সেপ্টেম্বরও রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, প্রতিদিন সারা দেশের হাসপাতালগুলোতে ৩ হাজার রোগী ভর্তি হচ্ছে। এ অবস্থায় মশা নিধন জরুরি। মশা নিধন যাদের দায়িত্ব, তাদের যথাযথভাবে কাজ করতে হবে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, স্থানীয় সরকার বিভাগের কাজ বৈঠক করা ও নির্দেশনা দেওয়ার মধ্যেই সীমিত। বৈঠকে নেওয়া সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হচ্ছে কি না, নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ হচ্ছে কি না, তা তদারকিও করা হচ্ছে না। ফলে মশাও নিয়ন্ত্রণে আসছে না।
সরকারি হিসাবে এ বছর ডেঙ্গুতে এ পর্যন্ত মারা গেছে ৮৬৭ জন। এর মধ্যে শেষ ২৪ ঘণ্টায় মারা গেছে ২১ জন। আগের দিন সকাল ৮টা থেকে গতকাল বুধবার সকাল ৮টা পর্যন্ত এই ২১ জনের মৃত্যু হয়। চলতি মাসের প্রথম ১৫ দিনে প্রতিদিন গড়ে মারা গেছে ১৩ জনের বেশি।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও কীটতত্ত্ববিদ অধ্যাপক কবিরুল বাশার জানান, স্থানীয় সরকার বিভাগের একটি কমিটিতে তিনি আছেন। মাঝেমধ্যে কমিটির সভা হয়। তিনি বলেন, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ও তার অঙ্গপ্রতিষ্ঠানগুলোতে মশা নিধনে অভিজ্ঞ জনবল তৈরি করতে হবে।
ডিএনসিসির কাগুজে টাস্কফোর্স
ডেঙ্গু প্রতিরোধে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) পক্ষ থেকে নানা পদক্ষেপের কথা বলা হলেও উদাসীনতা ও সমন্বয়হীনতায় তা অনেকাংশে ব্যর্থ হয়েছে।
ডিএনসিসির ৪৭ নম্বর ওয়ার্ডের দক্ষিণখান গণকবরস্থান রোডের বাসিন্দা বশির আহমেদ বলেন, ‘আমরা কাউন্সিলরের কোনো চিঠি পাইনি। মেয়র তো অনেক কথা বলেন, কিন্তু কার্যক্রম তো কিছু দেখি না।’
ডিএনসিসির ১৩ নম্বর ওয়ার্ডের মিরপুর পশ্চিম কাজীপাড়ার বাসিন্দা নাজমুস সাকিব বলেন, ‘স্থানীয় বাসিন্দাদের নিয়ে কোনো কার্যক্রম দেখিনি। ডেঙ্গু প্রতিরোধে কাউন্সিলরের কোনো চিঠিও পাইনি।’
ডিএনসিসির একাধিক কর্মকর্তা জানান, গত জুলাই মাসে ডেঙ্গু প্রতিরোধে কাউন্সিলরদের ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে টাস্কফোর্স গঠন করার নির্দেশনা দিলেও, তাঁরা তা শোনেননি। ডিএনসিসির ৫৪টি ওয়ার্ডের মধ্যে দু-একটি ওয়ার্ড টাস্কফোর্স গঠন করলেও মাঠপর্যায়ে কোনো কাজ করেনি।
তবে ডিএনসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সেলিম রেজা আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘টাস্কফোর্স গঠনের প্রক্রিয়াটা চলমান। কিছু ওয়ার্ডে হচ্ছে। দু-একটা জায়গায় যদি ঝামেলা থাকে, আমরা দেখব।’
টাস্কফোর্স নিয়ে কথা হয় ডিএনসিসির সাতজন কাউন্সিলরের সঙ্গে। এর মধ্যে মাত্র দুজন কমিটি গঠন করেছেন বলে জানিয়েছেন।
ডিএনসিসির ৪৮ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মো. আলী আকবর বলেন, ‘সিটি করপোরেশন থেকে নির্দেশনা দিয়েছে। কমিটি করতে পারিনি, বাড়ি বাড়িতে চিঠিও দিতে পারিনি। তবে ডেঙ্গু প্রতিরোধে যা যা করা লাগে, সবই করেছি।’ ৪৭ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মোতালেব মিয়া বলেন, ‘কমিটি এখনো জমা দিইনি। নাগরিকদের বাড়িতে চিঠি এখনো দিইনি, তবে সবাইকে মুখে মুখে বলেছি।’ তবে ১২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মুরাদ হোসেন বলেন, ‘কমিটি করে দিয়েছি। তারা ঘুরে ঘুরে দেখবে কোথায় মশা আছে। নাগরিকদের চিঠি দেওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘চিঠি দিব কেন? এটা তো জানি না।’
কীটতত্ত্ববিদ ও ডিএনসিসি মেয়রের উপদেষ্টা ড. কবিরুল বাশার বলেন, ‘প্রতিটি বাড়ি ধরে যদি মশা নির্মূল করা না যায়, তাহলে এডিস মশা বা ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ হবে না। এর জন্য মাঠ প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের সক্রিয় হতে হবে, জনগণকে সম্পৃক্ত করতে হবে।’
রাজধানীর বাইরেও শুধু প্রচার
কয়েকটি জেলা থেকে আমাদের প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্যে দেখা গেছে, ঢাকার বাইরে মৃত্যুর বড় কারণ সঠিক সময়ে মশা নিধন কার্যক্রম পরিচালনা না করা। ডেঙ্গুর ভরা মৌসুমেও কার্যক্রম শুধু প্রচারেই সীমিত। নাগরিকদের অভিযোগ, বেশির ভাগ সিটি করপোরেশন, জেলা ও পৌরসভায় সঠিক সময়ে ঠিকভাবে মশা নিধন করা হয়নি।
গাইবান্ধা সামাজিক সংগ্রামের পরিষদ আহ্বায়ক জাহাঙ্গীর কবির তনু বলেন, ডেঙ্গু মোকাবিলায় পৌরসভার কোনো উদ্যোগ নাগরিকের কাছে দৃশ্যমান হয়নি।
সাতক্ষীরা, যশোর, গাজীপুর, কক্সবাজার, চট্টগ্রাম ও রাজশাহী জেলায় মশা নিধনের দাবি তুলেছেন নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা। এসব জেলায় গত তিন মাসে মশা নিধনে সিটি করপোরেশন বা পৌরসভার কোনো উদ্যোগ চোখে পড়েনি।
গাজীপুর নাগরিক অধিকার ফোরামের সাধারণ সম্পাদক জালাল উদ্দিন বলেন, গাজীপুর মহানগরীতে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, মশার ওষুধ ছিটানো ও লার্ভা নিধনে অভিযান জোরদার হয়নি।
কীটতত্ত্ববিদ মনজুর আহমেদ চৌধুরী বলেন, বছরের শুরুতেই ঢাকা ও ঢাকার বাইরে ডেঙ্গু নিয়ে কাজ করতে হতো। এখন অক্টোবরের মাঝামাঝি পর্যন্ত এভাবেই যেতে হবে।