দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করার দুই মাস সময়ও নেই। এই নির্বাচন সামনে রেখে ঘোষিত রোডম্যাপও (কর্মপরিকল্পনা) সময়মতো পুরোপুরি বাস্তবায়ন করতে পারেনি কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন (ইসি)। নির্বাচনী কেনাকাটার কাজও এখনো শেষ করতে পারেনি ইসি। এমন পরিস্থিতিতেও ইসি তৎপর গত ১৫ বছরের সফলতা নিয়ে প্রতিবেদন বানাতে। ইসি সম্প্রতি এই প্রতিবেদন বানাতে উদ্যোগ নিয়েছে। এ ছাড়া স্মার্টকার্ড বিতরণ এবং প্রবাসী ভোটার নিবন্ধনের কাজও চলছে। ইসির সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
সূত্রমতে, সফলতার বিষয়ে তথ্য দিতে ইসির সব অনুবিভাগ, ইনস্টিটিউট, শাখা, অধিশাখার প্রধানদের এরই মধ্যে দুই দফা নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। প্রথমবার নির্দেশনা দেওয়া হয় গত ৯ আগস্ট। কিন্তু তাতে শাখাপ্রধানদের কাছ থেকে তেমন সাড়া পাওয়া যায়নি। মাত্র তিনটি শাখা প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। ফলে ১৭ সেপ্টেম্বর আবার এ বিষয়ে তাগাদা দেওয়া হয়। শেষ দফা নির্দেশনায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন ও সচিবালয়ের ২০০৯-২০২৩ সময়ের সাফল্যজনক প্রতিবেদন প্রকাশের লক্ষ্যে সকল শাখা ও অধিশাখা থেকে প্রতিবেদন আকারে প্রয়োজনীয় তথ্যাদি চাওয়া হলেও তিনটি শাখা ব্যতীত কোনো শাখা ও অধিশাখা থেকে তথ্য পাওয়া যায়নি। প্রয়োজনীয় তথ্যাদি না পাওয়ায় বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন ও সচিবালয়ের ২০০৯-২০২৩ সময়ের সাফল্যজনক প্রতিবেদন প্রকাশের কাজ ব্যাপকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। তথ্যাদি ২৫ সেপ্টেম্বরের মধ্যে জরুরি বিবেচনায় জমা দেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ইসি সচিবালয়ের অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘এটি শুধু সফলতার বিষয়ে প্রতিবেদন নয়, ২০০৯ সাল থেকে নির্বাচন কমিশন কী কী কাজ করেছে, সেগুলো নিয়ে এরই মধ্যে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে প্রতিবেদন তৈরি করতে বলা হয়েছে। সেই প্রতিবেদন তৈরির কাজ চলছে।’
জানা যায়, ইসি সংবিধান অনুযায়ী যথাসময়ে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজন করতে চায়। কিন্তু এখনো কর্মকর্তাদের মধ্যে সংসদ নির্বাচনের মতো বিশাল কর্মযজ্ঞের আমেজই নেই। ভোটকেন্দ্রের নীতিমালা, জাতীয় পরিচয়পত্র স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে নেওয়ার উদ্যোগ, ভোট গ্রহণ কর্মকর্তার প্যানেল প্রস্তুতসহ নানা কারণে ইসি কর্মকর্তাদের মধ্যে অসন্তোষ বাড়ছে। অন্যবারের মতো এবার সংসদ নির্বাচন নিয়ে কর্মকর্তাদের মধ্যে আলাদা কোনো উদ্যম নেই।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ইসি তিনবার দরপত্র দিয়েও ৮ লাখ ১৫ হাজার স্ট্যাম্প প্যাড কিনতে পারেনি। প্রথমবার দরপত্রে অংশ নেওয়া সবাই পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ হয়েছে। তৃতীয়বার চারটি প্রতিষ্ঠান অংশ নিলেও কেউ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারেনি। তাই সেই দরপত্রও বাতিল করা হয়েছে। এখন সময়মতো স্ট্যাম্প প্যাড পাওয়া নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। নির্বাচনের কয়েক মাস আগে একটি চেকলিস্ট তৈরি করতে হয়। এটি দেখে বোঝা যায় কোন কাজ সম্পন্ন হয়েছে, কোনটি হয়নি, কোন সময়ের মধ্যে করতে হবে। সেই চেকলিস্ট এখনো নির্বাচন কমিশনারদের টেবিলে নেই।
২০২৪ সালের ২৯ জানুয়ারির মধ্যে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্য নির্ধারণ করে ইসি গত বছরের সেপ্টেম্বরে রোডম্যাপ প্রকাশ করে। ওই রোডম্যাপ অনুযায়ী গত ফেব্রুয়ারির মধ্যে আইনি কাঠামো পর্যালোচনা ও সংস্কার করার কথা ছিল। ইসি সময়মতো সেটিও করতে পারেনি। আগস্টের মধ্যে দেশি পর্যবেক্ষক সংস্থার নিবন্ধন কার্যক্রম শেষ করার কথা থাকলেও এখনো তা করতে পারেনি। এখনো চূড়ান্ত হয়নি বিদেশি পর্যবেক্ষক নীতিমালা। ১০ লাখের মতো ভোট গ্রহণ কর্মকর্তার (প্রিসাইডিং, সহকারী প্রিসাইডিং ও পোলিং অফিসার) প্যানেল প্রস্তুতির নীতিমালার কারণে এই তালিকা তৈরির কাজ আটকে আছে। ইসি প্রথমে এটিতে ডিসি-এসপিসহ অন্যদের সম্পৃক্ত করে নীতিমালা সংশোধন করতে চেয়েছিল। কিন্তু পরে বিতর্ক এড়াতে সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছে। আগের নির্বাচনগুলোতে ইসি ভোট গ্রহণ কর্মকর্তাদের একটি তালিকা তফসিল ঘোষণার আগেই তৈরি করে রাখত। তফসিল ঘোষণার পর সেটির তথ্য হালনাগাদ করা হতো। মাঠপর্যায়ে এখনো এই বিষয়ে কোনো নির্দেশনা না দেওয়ায় কর্মকর্তারা কাজ শুরু করতে পারেননি।
ইসির একাধিক কর্মকর্তা জানান, এর আগে প্রতিটি সংসদ নির্বাচনের পর ইসি প্রতিবেদন তৈরি করত। কিন্তু কে এম নূরুল হুদার নেতৃত্বাধীন কমিশন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর বিজয়ীদের গেজেট প্রকাশ করেই দায়িত্ব শেষ করে। নির্বাচনের পর আর সেটি নিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করেনি। এই প্রতিবেদন তৈরির উদ্যোগ নেই বর্তমান কমিশনেরও। এই প্রতিবেদন না থাকায় একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বিষয়ে তথ্য আগামী দিনে পাওয়া যাবে না।
নির্বাচনী প্রস্তুতির কাজ রেখে ইসির সাফল্য খুঁজতে ব্যস্ততা প্রসঙ্গে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার আজকের পত্রিকাকে বলেন, এই কমিশন একটার পর একটা বিতর্ক সৃষ্টি করেই চলছে। এটি দুর্ভাগ্যজনক। এখন তাদের কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকার কথা, অকাজ নয়।