চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) আবাসিক হল থেকে অছাত্র ও বহিষ্কৃতদের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে বের হয়ে যেতে গত ২৪ সেপ্টেম্বর বিজ্ঞপ্তি দেয় প্রশাসন। এ সময়ের মধ্যে হল ত্যাগ না করলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ারও হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়। তবে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের এক সপ্তাহ পার হলেও অছাত্র ও বহিষ্কৃতদের হল ছাড়তে দেখা যায়নি। উল্টো বহিষ্কৃত এক ছাত্রলীগ নেতার কক্ষ সিলগালা করতে গিয়ে হেনস্তার শিকার হয়েছেন কয়েকজন আবাসিক শিক্ষক।
হলে নিয়ন্ত্রণ না থাকার বিষয়টি স্বীকার করেছেন দুটি আবাসিক হলের প্রাধ্যক্ষ। তাঁরা জানিয়েছেন, দাপ্তরিক কাজ ছাড়া তাঁদের আর কিছুই করার নেই। হলের কক্ষ নিয়ন্ত্রণ করেন ছাত্রলীগের বিভিন্ন পক্ষের নেতারা। বিশেষ অনুরোধে কাউকে আসন দিতে হলে ছাত্রনেতাদের কাছ থেকে চেয়ে নিতে হয়।
গত সোমবার সন্ধ্যায় ছাত্রলীগের উপপক্ষ বিজয়ের কর্মী বহিষ্কৃত শিক্ষার্থী শহিদুল ইসলামের কক্ষ সিলগালা করতে গিয়েছিলেন আলাওল হলের আবাসিক শিক্ষক সেলিমুল হক, সাঈদ বিন কামাল চৌধুরী ও সদরুল আমিন। কিন্তু বিজয়ের কর্মীরা তাঁদের বাধা দেন। এ কারণে সিলগালা না করেই ফিরতে হয় শিক্ষকদের। শিক্ষার্থীদের দাবি, আবাসিক হলে প্রাধ্যক্ষদের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। এ কারণে প্রশাসন বিজ্ঞপ্তি দিলেও আদতে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছে না।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশাসনের পক্ষ থেকে সব শেষ আসন বরাদ্দ দেওয়া হয় ২০১৭ সালে। এরপর কয়েক দফা আসন বরাদ্দের বিজ্ঞপ্তি দিলেও তা কার্যকর হয়নি। দীর্ঘদিন ধরে কর্তৃপক্ষ আসন বরাদ্দ না দেওয়ায় আবাসিক হলের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ এখন ছাত্রলীগের হাতে। তাই সাধারণ শিক্ষার্থীদের বাধ্য হয়ে ক্যাম্পাসের আশপাশের কটেজে থাকতে হচ্ছে। তাঁদের ভাষ্য, শিক্ষাবর্ষ শেষেও অনেক নেতা হলে থাকছেন। প্রশাসন তাঁদের বের করতে পারলে নিয়মিত শিক্ষার্থীরা হলে ওঠার সুযোগ পাবেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের ২০১০-১১ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী প্রদীপ চক্রবর্তী দুর্জয়। শাখা ছাত্রলীগের সাবেক এই সহসভাপতি ভিএক্স গ্রুপের নেতা। প্রায় এক যুগ ধরে তিনি আছেন সোহরাওয়ার্দী হলের একটি কক্ষে। দুর্জয় আজকের পত্রিকাকে বলেন, তিনি নিয়মিত হলে থাকেন না। মাঝেমধ্যে সাংগঠনিক কর্মসূচি থাকলে থাকতে হয়। তবে প্রশাসন যদি শতভাগ আসন বরাদ্দ দিয়ে দেয়, তাহলে কোনো অবৈধ ছাত্র হলে থাকবেন না।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সাবেক প্রক্টর বলেন, হলে আসন বরাদ্দ দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হলেই ছাত্রলীগের বিভিন্ন উপপক্ষ থেকে চাপ আসে। কক্ষের ওপর যেসব নেতার দখল বেশি, তাঁরা মনে করেন, প্রশাসন আসন বরাদ্দ দিলে তাঁদের নিয়ন্ত্রণ কমে যাবে। এ ক্ষেত্রে প্রশাসনের উচিত নির্দিষ্ট কোনো পক্ষের স্বার্থ না দেখে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী হল পরিচালনা করা।
বিভিন্ন হলের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পড়াশোনা শেষেও ছাত্রলীগের অন্তত ৩০ নেতা-কর্মী আবাসিক হলগুলোর কক্ষ দখল করে আছেন। তাঁদের ক্ষমতার কারণে বহিষ্কৃত ও অছাত্ররা হলে অবস্থান এবং প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ালেও প্রশাসন ব্যবস্থা নেয় না।
বর্তমান প্রশাসনও বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগে জর্জরিত হওয়ায় সবকিছুতে নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে পারে না বলে মনে করেন শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক আবদুল হক। তিনি বলেন, বর্তমান প্রশাসনের বিরুদ্ধে নিয়োগে লেনদেনসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ আছে। এগুলো এত বেশি জমেছে যে অনেকটা প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। প্রশাসনের কর্মকর্তাদের অনেক কর্মকাণ্ড এসব অনিয়মকে সমর্থন জুগিয়েছে। তাই ‘নতজানু’ এই প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ সব জায়গায় নেই।
প্রক্টর নুরুল আজিম সিকদার বলেন, ‘আবাসিক হল থেকে বহিষ্কৃত ও অছাত্রদের বের করতে আমরা কাজ করছি। আসন বরাদ্দের প্রক্রিয়াও চলছে। আশা করি, দুটি একসাথে হবে।’
প্রাধ্যক্ষরা থাকেন শহরে
বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের ৯টি ও ছাত্রীদের ৫টি হলে নিয়োগকৃত প্রাধ্যক্ষ আছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক প্রাধ্যক্ষ জানিয়েছেন, এর মধ্যে অন্তত ১০টি হলের প্রাধ্যক্ষ ক্যাম্পাসে থাকেন না। কারণ, ক্যাম্পাসে হলের পাশে থাকার জন্য কোনো কোয়ার্টার নেই। তাই অনেক প্রাধ্যক্ষ ও হলের আবাসিক শিক্ষক শহরে বাসা ভাড়া নিয়ে থাকেন।
আলাওল হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক ফরিদুল আলম বলেন, পারিবারিক, ব্যক্তিগত ও বিভিন্ন কারণে অনেক প্রাধ্যক্ষ ক্যাম্পাসে অবস্থান করেন না। তবে হলের কাজে তাঁরা সর্বদা সচেষ্ট থাকেন। অধিকাংশ আবাসিক শিক্ষক ক্যাম্পাসে থাকেন। অফিস সময়ে যাঁকে যখন দরকার পাওয়া যায়।
হলে আসন বরাদ্দ ও প্রাধ্যক্ষদের না থাকার বিষয়ে জানতে মোবাইল ফোনে গত শনিবার উপাচার্য অধ্যাপক শিরীণ আখতারের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। তবে তিনি কল রিসিভ করেননি।