২৭ এপ্রিল ২০২৪, শনিবার, ১০:১২:৪৫ অপরাহ্ন
রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার লাগাম ধরতে পারছে না রুয়েট কর্তৃপক্ষ
  • আপডেট করা হয়েছে : ১৬-০১-২০২৪
রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার লাগাম ধরতে পারছে না রুয়েট কর্তৃপক্ষ

রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (রুয়েট) আইন অনুযায়ী কোনো শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারী রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়াতে পারবেন না। কোনো রাজনৈতিক পদে যাওয়া যাবে না। তবে আইনের তোয়াক্কা না করে রুয়েটের অর্ধশতাধিক শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারী ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের পদ গ্রহণ করেছেন। এসব পদ-পদবি ভাঙিয়ে তারা নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করছেন। অনেকের বিরুদ্ধে নিয়োগ বাণিজ্যের অভিযোগও রয়েছে। নামে-বেনামে বা পরিবারের সদস্যদের নামে কেউ কেউ ঠিকাদারি করছেন। এসব বেপরোয়া শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের লাগাম টানতে পারছে না রুয়েট কর্তৃপক্ষ।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক নজরুল ইসলাম মণ্ডল বর্তমানে রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির ১০ নম্বর উপদেষ্টা। ইলেকট্রনিক্স অ্যান্ড টেলিকমিউনিকেশন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক শ্যাম দত্ত মহানগর আওয়ামী লীগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক সম্পাদক। স্ত্রী মৌসুমী মণ্ডলের নামে তার ‘মেসার্স শব্দ এন্টারপ্রাইজ’ ঠিকাদারি লাইসেন্স রয়েছে। রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে ২০২০ সালে রুয়েটে ১৩ লাখ ২৬ হাজার টাকার এসি সরবরাহের কার্যাদেশ পায় প্রতিষ্ঠানটি।

রসায়ন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সিদ্ধার্থ শংকর সাহা মহানগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক। এর আগে তিনি ২০১৫-২০২০ মেয়াদে মহানগর আওয়ামী লীগের শিক্ষাবিষয়ক সম্পাদক ছিলেন। নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের অভিযোগে তিনি পদ হারান।

কেবল শিক্ষকরাই নন, রাজনীতিতে জড়িয়েছেন রুয়েটের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের অনেকে। অতিরিক্ত রেজিস্ট্রার দিলীপ কুমার ঘোষ মহানগর আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক। সাংস্কৃতিক সম্পাদক পদে থাকা অবস্থায় তিনি রুয়েটে যোগ দেন। উপপরীক্ষা নিয়ন্ত্রক শাহনেওয়াজ সরকার সেডু নগরীর ২২নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, ডেপুটি রেজিস্ট্রার রোকনুজ্জামান বোয়ালিয়া থানা (পশ্চিম) আওয়ামী লীগের কমিটির সহসভাপতি। মহানগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মীর তৌহিদুর রহমান কিটু সেকশন অফিসার পদে যোগ দিয়েও রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। পদোন্নতি পেয়ে বর্তমানে তিনি সহকারী পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক।

রুয়েট শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি থাকাকালে সহকারী প্রকৌশলী পদে নিয়োগ পান নাইম রহমান নিবিড়। জনসংযোগ দপ্তরের সেকশন অফিসার আ ফ ম মাহমুদুর রহমান দীপন সর্বশেষ মহানগর যুবলীগের উপপ্রচার সম্পাদক ছিলেন। নিরাপত্তা বিভাগের সেকশন অফিসার মামুনুর রশিদ জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সহসভাপতি। সেকশন অফিসার সোহেল রানা কাটাখালী পৌরসভার ২ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি। সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের জুনিয়র সেকশন অফিসার আবদুল ওয়াহেদ খান টিটু মহানগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে টিটু দীর্ঘদিন কর্মস্থলে অনুপস্থিত ছিলেন।

রিসার্চ অ্যান্ড এক্সটেনশন বিভাগের জুনিয়র সেকশন অফিসার মোহাম্মদ আলী রাজপাড়া থানা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। এর আগের কমিটিতে তিনি সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের ডাটা প্রসেসর মহিদুল ইসলাম বর্তমানে শাহ্ মখদুম থানা আওয়ামী লীগের বন ও পরিবেশবিষয়ক সম্পাদক, কেমিক্যাল অ্যান্ড ফুড প্রসেসিং ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ডাটা প্রসেসর ও রুয়েট কর্মচারী ইউনিয়নের সভাপতি আবদুল্লাহ আল মামুন শুভ ২৫ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। জুনিয়র সেকশন অফিসার আবদুল্লাহ আল মামুন ২৮ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের তথ্য ও প্রযুক্তিবিষয়ক সম্পাদক। সেন্ট্রাল লাইব্রেরির অ্যাটেনডেন্ট সাইফুল ইসলাম সানি বোয়ালিয়া থানা (পূর্ব) আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক এবং বিল্ডিং ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন ম্যানেজমেন্ট বিভাগের অফিস সহকারী জুয়েল রানা ২৫ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের সাধারণ সাম্পাদক।

অভিযোগ-রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীরা প্রায় অফিস ফাঁকি দিয়ে ব্যক্তিগত কাজ ও রাজনৈতিক কর্মসূচিতে ব্যস্ত থাকেন। সিটি করপোরেশন ও জাতীয় নির্বাচনের প্রচার-প্রচারণায় তারা প্রকাশ্যে অংশ নিয়েছেন। অনেকেই আবার নিয়োগ ও টেন্ডার বাণিজ্যে জড়িত। পরিবারের সদস্য বা আত্মীয়-স্বজনের নামে ঠিকাদারি লাইসেন্সে অনেকে রুয়েটের কেনাকাটার কাজ করছেন। কেউ কেউ আবার টেন্ডারের কমিশন বাণিজ্য করছেন। কর্তৃপক্ষের অনাপত্তিপত্র না নিয়ে অনেকে বিদেশ ভ্রমণ করছেন। ফলে রুয়েটে শৃঙ্খলা ভেঙে পড়েছে। এমন পরিস্থিতিতে ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার আরিফ আহমেদ চৌধুরী স্বাক্ষরিত নির্দেশনা জারি করা হয়েছে। কিন্তু এ নির্দেশনা কেউ পাত্তাই দেয় না।

এ বিষয়ে রুয়েটের কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক ও রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা নজরুল ইসলাম মণ্ডলের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে পরে কথা বলবেন বলে জানান। কিন্তু পরে একাধিকবার ফোন করা হলেও আর রিসিভ করেননি। ইলেকট্রনিক বিভাগের সহকারী অধ্যাপক এবং মহানগর আওয়ামী লীগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক সম্পাদক শ্যাম দত্ত বলেন, কখনো বিষয়টি ওভাবে ভাবিনি। রসায়ন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মহানগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক সিদ্ধার্থ শংকর সাহার দাবি-চাকরির আগে রাজনৈতিক পদে ছিলেন। ৬-৭ বছর ধরে আর কোনো পদে নেই। তবে নেতাকর্মীরা জানান, ২০২২ সালে মহানগর আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত স্বেচ্ছাসেবক লীগের সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটি ও বর্ধিতসভায় বক্তব্য দিয়েছেন সিদ্ধার্থ শংকর। আর অতিরিক্ত রেজিস্ট্রার ও মহানগর আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক দিলীপ কুমার ঘোষ জানান, তিনি পদত্যাগ করেছেন। কিন্তু পদত্যাগপত্র গৃহীত হয়েছে কিনা তা জানেন না।

ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার আরিফ আহমেদ চৌধুরী বলেন, কতিপয় শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারী দাপ্তরিক প্রক্রিয়ায় ছুটি না নিয়ে বড় নেতাদের নাম ভাঙিয়ে অফিস ফাঁকি দিয়ে রাজনৈতিক কর্মসূচিতে চলে যান। অনেকেই আবার রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে অফিসও ঠিকমতো করেন না। এ কারণে নোটিশ দিয়ে সতর্ক করা হয়েছে। কিন্তু এ পর্যন্ত কেউ রাজনৈতিক পদ-পদবি ছেড়েছেন কিনা তা জানা নেই। এ বিষয়ে রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা আলী কামাল বলেন, দিলীপ ঘোষের পদত্যাগের চিঠি পাইনি। তবে আইনে বাধা থাকলে পদধারী সবার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ন্ত্রক সংস্থা ইউজিসির সচিব অধ্যাপক ফেরদৌস জামান জানান, সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেবে ইউজিসি। আইন সবার জন্যই সমান। কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়।

শেয়ার করুন