২৩ নভেম্বর ২০২৪, শনিবার, ০২:০৯:০১ অপরাহ্ন
পুঠিয়ার মাদ্রাসার অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে অপহরণের নাটক সাঁজানোর অভিযোগ
  • আপডেট করা হয়েছে : ১৮-১০-২০২৩
পুঠিয়ার মাদ্রাসার অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে অপহরণের নাটক সাঁজানোর অভিযোগ

স্বেচ্ছাচারিতা, আর্থিক অনিয়ম ও দুর্নীতি এবং তথ্য গোপন করে মাদ্রাসা পরিচালনা পর্ষদের কমিটি গঠন করে একাধিকবার বরখাস্ত হওয়া রাজশাহীর পুঠিয়া উপজেলার বিড়ালদহ সৈয়দ করম আলী দারুস-সুন্নাত ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ হাবিবুর রহমানের বিরুদ্ধে এবার অপহরণের নাটক সাঁজানোর অভিযোগ উঠেছে।


অপহরণ করা হয়েছে দাবি করে অধ্যক্ষ হাবিবুর রহমান যে অভিযোগ এনেছেন তা পুরোটাই পূর্বপরিকল্পিত ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ছিলো বলে জানা গেছে।


জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক সাংসদ আব্দুল ওয়াদুদ দারার ইন্ধনেই অধ্যক্ষ হাবিবুর রহমান বর্তমান সংসদ সদস্য এবং স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য প্রফেসর ডাঃ মনসুর রহমানকে জড়িয়ে অপহরণের অভিযোগ এনেছেন বলেও জানা গেছে।


কমিটি গঠণের বিষয়টিকে ইস্যু করে বর্তমান সাংসদ ডাঃ মনসুর রহমানকে রাজনৈতিক ভাবে দুর্বল করতে সাবেক সাংসদ আব্দুল ওয়াদুদ দারা ও তার অনুসারী নেতারা অধ্যক্ষ হাবিবুর রহমানকে অপহরণ করা হয়েছে বলে অভিযোগ তুলেন। এ বিষয়টি আরো পরিস্কার হয়েছে আব্দুল ওয়াদুদ দারার স্বাক্ষরিত একটি চিঠিতে। চলতি বছরের ২৭ সেপ্টেম্বর ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার বরাবর একটি চিঠিও দিয়েছিলেন আব্দুল ওয়াদুদ দারা। চিঠিটি এই প্রতিবেদকের কাছে সংরক্ষিত আছে।


ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠানো চিঠি ও পুঠিয়া উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তার তদন্ত প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, মাদ্রাসা পরিচালনা পর্ষদ গঠন সংক্রান্ত অনিয়মের অভিযোগের বিষয়ে সরেজমিনে তদন্ত করে পুঠিয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার বরাবর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহনের জন্য চলতি বছরের ২০ জুলাই প্রতিবেদন দাখিল করেন উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা লায়লা আখতার জাহান।


তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠানো নির্দেশনা পত্রের আলোকে গত ৫ জুন মাদ্রাসায় উপস্থিত হয়ে সরেজমিন তদন্ত করা হয়। তদন্তের সময় ২৭ জন শিক্ষক, ২ জন কর্মচারী ও মাদ্রাসা পরিচালনা পর্ষদের ৪ জন সদস্য উপস্থিত ছিলেন। তদন্ত চলাকালে ২৭ জন শিক্ষকের প্রত্যোকের আলাদা ভাবে সাক্ষ্য নেয়া হয়। এ সময় প্রত্যোকেই জানান, তফসীল ঘোষণা, মাদ্রাসা পরিচালনা পর্ষদ গঠণ কিছুই জানতেন না তারা। এমনকি খসড়া ভোটার তালিকা শ্রেণিকক্ষে কিংবা নোটিশ বোর্ডে টানানো হয়নি। খসড়া তালিকা প্রণয়ন না করেই চুড়ান্ত ভোটার তালিকা প্রণয়ন করা হয়েছে।


প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, ২০২২ সালের ১ ডিসেম্বর স্থানীয় সাংসদ প্রফেসর ডা. মনসুর রহমান সভাপতি হিসেবে স্থানীয় বাসিন্দা ও রাজশাহী মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ডা. নওশাদ আলীকে সভাপতি মনোনয়নের জন্য ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ে ডিও লেটার দেন। কিন্তু অধ্যক্ষ হাবিবুর রহমান সেই ডিও লেটার গোপন করে নিজের পছন্দ মতো ৩ জন ব্যাক্তির নাম প্রস্তাব করে পাঠান। তার প্রেক্ষিতে দেওয়ান আব্দুস সালেককে সভাপতি মনোনয়ন দেন যা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আগে থেকে অবগত ছিলেন না।


এ বিষয়ে তদন্ত কমিটির কাছে অধ্যক্ষ হাবিবুর রহমান ব্যাখা দেন যে, সভাপতির নাম তিনি প্রস্তাব করতে পারেন। এই এখতিয়ার তার আছে। এ ক্ষেত্রে লক্ষনীয় হলো, পূর্বের কমিটির সভাপতি এবং মাদ্রাসার অধ্যক্ষ স্বাক্ষরিত ৩ জন সভাপতি ও ৩ জন বিদ্যোৎসাহী প্রতিনিধির নাম মনোনয়ন প্রদানের জন্য আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বরাবর যে আবেদন করেন অধ্যক্ষ হাবিবুর রহমান সেটি গোপন করে সভাপতি হিসেবে তার পছন্দমতো এবং ব্যাক্তিস্বার্থ চরিতার্থের জন্য ৩ জন ব্যাক্তির নাম উপচার্য বরাবর

প্রেরণ করেন।


তদন্ত প্রতিবেদন পর্যালোচনায় উল্লেখ করা হয়েছে, মাদ্রাসা পরিচালনা পর্ষদের নির্বাচনের যে তফসীল ঘোষণা করা হয় সে মোতাবেক খসড়া ভোটার তালিকা পেশ বা অনুমোদন করা হয়নি। তালিকার উপর আপত্তি থাকলেও তার উপর নোটিশ টানানো হয়নি। সরাসরি চুড়ান্ত ভোটার তালিকা তৈরি করা হয়েছে যা শ্রেণিকক্ষে কিংবা নোটিশ বোর্ডে টানানো হয়নি। অধ্যক্ষ হাবিবুর রহমান গোপনে একক সিদ্ধান্তে সবকিছু করে থাকেন। অধিকাংশের মতামতকে তিনি উপেক্ষা করেন।


তদন্ত প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, জীব বিজ্ঞাণের একজন শিক্ষক ছুটি ছাড়াই চলতি বছরের ১২ ফেব্রুয়ারি থেকে মাদ্রাসায় অনুপস্থিত রয়েছেন। অথচ তার বেতন-ভাতা ঠিকই উত্তোলন হচ্ছে। তদন্ত কমিটির কাছে মাদ্রাসার অন্যান্য শিক্ষকরা বলেন, গত ৬ মার্চ মোটরসাইকেল শোডাউন দিয়ে নতুন সভাপতি দলবল নিয়ে মাদ্রাসায় আসেন। এরপর শিক্ষকরা জানতে পারেন কমিটি গঠণের বিষয়টি।


পুঠিয়া উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা লায়লা আখতার জাহান বলেন, অধ্যক্ষ হাবিবুর রহমানের স্বেচ্ছাচারিতা, আর্থিক অনিয়ম-দুর্নীতির কারনে ইতোপূর্বে একাধিকবার বরখাস্ত হয়েছিলেন বলে তদন্ত কমিটিকে জানান উপস্থিত শিক্ষকরা। মাদ্রাসা পরিচালনা পর্ষদের নির্বাচনের সকল কাজে ব্যাপক অনিয়ম ও গোপনীয়তা অবলম্বন করা হয়েছে। সুতরাং নতুন কমিটিতে সভাপতির পদ সহ অন্যান্য পদ বিধি মোতাবেক হয়নি বলে তদন্ত কমিটি মতামত দিয়েছেন।


এদিকে, এই তদন্ত প্রতিবেদন পক্ষপাতমুলক দাবি করে বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীন কর্মকর্তা দিয়ে পুণরায় তদন্তের জন্য ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার বরাবর গত ২৭ সেপ্টেম্বর চিঠি দেন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক এমপি আব্দুল ওয়াদুদ দারা। আর এতেই ঘটে বিপত্তি। মাদ্রাসা পরিচালনা পর্ষদকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক দ্বন্দ প্রকট হয়ে উঠে। মাদ্রাসা পরিচালনা কমিটির সাবেক সভাপতি ডা. নওশাদ আলীর অভিযোগটি সঠিক নয় দাবি করে দারা ওই চিঠিতে উল্লেখ করেন প্রতিষ্ঠানটি আমার পিতার হাতে প্রতিষ্ঠিত। এছাড়া মাদ্রাসার অধ্যক্ষ, সভাপতি ও শিক্ষকদের মৌখিক অভিযোগের প্রেক্ষিতে ধর্মীয় এই প্রতিষ্ঠানকে রক্ষার জন্য অনুরোধ করেন।


স্থানীয় বাসিন্দা মাইনুল ইসলাম মুহিন বলেন, আব্দুল ওয়াদুদ দারা এমপি থাকাকালীন ২০১১ সালে পাবনা থেকে ডেকে এনে মোটা অংকের টাকা নিয়ে জামায়াত নেতা হাবিবুর রহমানকে নিয়োগ দেন। স্থানীয় অনেক যোগ্য প্রার্থী থাকা সত্বেও স্থানীয় প্রার্থীর কাছ থেকে টাকা নিলে এলাকায়া জানাজানি হয়ে যাবে এলাকার কাউকেই নিয়োগ দেননি সাবেক এমপি দারা। তিনি সাবেক এমপি; এই সব বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার এখন কে? তিনি জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জেলায় গিয়ে রাজনীতি করবেন। সব কিছুতে তারা রাজনৈতিক প্রভাব খাটাচ্ছে। তাছাড়া এই এলাকায় দলীয় সংসদ সদস্য আছেন। তিনিই ভালোমন্দ দেখবেন এটাই স্বাভাবিক।


অধ্যক্ষ হাবিবুর রহমানের সাথে কথা বলা হলে সাময়িক বহিস্কার হয়েছিলেন স্বীকার করে বলেন, আমাকে বিধি বহির্ভুত ভাবে বরখাস্ত করা হয়েছিল। জামায়াতের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত নন বলেও দাবি করেন তিনি। তাঁকে অপহরনের বিষয়ে কথা বলতে চাইলে তিনি মুঠোফোনে মন্তব্য না করে এ ব্যাপারে সাক্ষাতে কথা বলবেন বলে জানান।


এ ব্যাপারে কথা বলতে সাবেক সাংসদ ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল ওয়াদুদ দারার মুঠোফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি কল ধরেননি।


শেয়ার করুন