২৭ এপ্রিল ২০২৪, শনিবার, ০৪:১১:০১ অপরাহ্ন
বিএনপি ফয়সালা চায় মাঠেই
  • আপডেট করা হয়েছে : ০২-১১-২০২৩
বিএনপি ফয়সালা চায় মাঠেই

সরকারের পদত্যাগসহ বিভিন্ন দাবিতে কঠোর কর্মসূচি থেকে পিছু হটছে না বিএনপি। আরও হার্ডলাইনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দলটির নেতারা। সেক্ষেত্রে দেশব্যাপী সর্বাত্মক অবরোধের কর্মসূচি অব্যাহত রাখতে ইতোমধ্যে হাইকমান্ডকে পরাপর্শ দিয়েছেন কেন্দ্রীয় নেতারা। সব পর্যায়ের নেতাকর্মীকে কর্মসূচি সফলে জোরালোভাবে মাঠে নামতে দেওয়া হয়েছে কঠোর নির্দেশনা। একজন গ্রেফতার হলে বিকল্প আরেকজনকে নেতৃত্ব দিতে হাইকমান্ড থেকে তৃণমূলে বার্তা দেওয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে এসব তথ্য।


দেশব্যাপী টানা তিন দিনের সর্বাত্মক অবরোধের শেষ দিন আজ। নীতিনির্ধারকদের মতে, পনেরো নভেম্বরের মধ্যে যে কোনো সময় দ্বাদশ নির্বাচনের তফশিল ঘোষণা হতে পারে। তাই এখন পেছনে ফেরার কোনো উপায় নেই। ‘ডু অর ডাই’ মনোভাব নিয়েই কঠোর কর্মসূচি দেওয়া হয়েছে। এখন পর্যন্ত অবরোধ কর্মসূচি অব্যাহত রাখার বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত আছে। আবার আরও কঠোর কর্মসূচি ঘোষণার বিষয়েও তারা হাইকমান্ডকে পরামর্শ দিয়েছেন। সেক্ষেত্রে ‘অসহযোগ’ নাম দিয়ে দেশব্যাপী অবরোধ ও হরতাল কর্মসূচি দেওয়া হতে পারে।


বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে বুধবার রাতেও ভার্চুয়ালি সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে কথা বলেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। নেতাদের জানান, তাদের পর্যবেক্ষণ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিএনপিকে চাপে রাখার কৌশল হিসাবে মামলা ও গ্রেফতার করা হচ্ছে। একটা আতঙ্ক তৈরি করতে চাচ্ছে সরকার। তবে এতে তারা বিচলিত নন। কঠোর কর্মসূচি অব্যাহত রাখতে তারা পরামর্শ দিয়েছেন। কেউ কেউ শুক্রবার না দিয়ে শনিবার থেকে ফের কর্মসূচি চালিয়ে যেতে বলেছেন। তবে বেশিরভাগ নেতা মাঠে নেমে আবার বিরতি দিয়ে কর্মসূচি না পালনের পরামর্শ দিয়েছেন। এক্ষেত্রে তাদের যুক্তি, বিরতি দিলে তৃণমূলের নেতাকর্মীদের কাছে নেতিবাচক বার্তা যেতে পারে, মনোবল ভেঙে যেতে পারে। এখন চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেবেন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। বৃহস্পতিবার (আজ) কর্মসূচি ঘোষণা করার কথা রয়েছে।


বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য বেগম সেলিমা রহমান যুগান্তরকে বলেন, সরকারের পদত্যাগ না হওয়া পর্যন্ত নেতাকর্মীরা রাজপথ ছাড়বে না। কঠোর কর্মসূচির মাধ্যমেই সরকারকে পদত্যাগে বাধ্য করা হবে। মহাসচিব বলেছিলেন আন্দোলনের মহাযাত্রা শুরুর কথা। সেটিই শুরু হয়েছে।


জানা গেছে, নেতাকর্মীদের নামে নতুন মামলা ও গ্রেফতার এড়ানো নিয়েও বিএনপির নীতিনির্ধারকরা নানা হিসাব কষছেন। সরকারের কঠোর মনোভাবে বিএনপির নেতাকর্মীদের মধ্যে নতুন করে গ্রেফতার আতঙ্ক বিরাজ করছে। কেন্দ্রীয় নেতারা রয়েছেন আত্মগোপনে। তৃণমূলের নেতাকর্মীরাও ঘরছাড়া। তাই ইউনিয়ন থেকে শুরু করে জেলা-মহানগর পর্যন্ত সব পর্যায়ের নেতাকর্মীদের সর্বোচ্চ সতর্ক থেকে আন্দোলন কর্মসূচি সফলের জন্য বলা হয়েছে।


বেগম সেলিমা রহমান বলেন, ১৫ বছর ধরে দেশের মানুষ সরকারের হাতে নির্যাতিত। এবার যখন জনগণ ঘুরে দাঁড়িয়েছে, নিরস্ত্র হাতে প্রতিবাদ জানাচ্ছে, তখন সরকার মিথ্যা মামলা দিয়ে বিএনপি নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষকে হয়রানি করছে। বিরোধী দলের নেতাকর্মীরা এখন গ্রেফতার আতঙ্কে ভুগছেন। বাসাবাড়িতে থাকতে পারছেন না। তবুও এবার তারা সরকারের পতন নিশ্চিত করতে নানা কৌশলে হরতাল-অবরোধ পালন করছেন। শীর্ষ নেতাদের গ্রেফতার করে আন্দোলন দমানো যাবে না। কারণ একজন গ্রেফতার হলে বিকল্প আরেকজন নেতৃত্ব দেবেন।


নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থায়ী কমিটির একাধিক সদস্য যুগান্তরকে বলেন, যে কোনো বিষয়ে এখন কথা বলার ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বনের পরামর্শ দিয়েছেন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। ক্ষমতাসীন দল যেমন হার্ডলাইনে, বিএনপিকেও হার্ডলাইনে যেতে বাধ্য করেছে। ২৮ অক্টোবর সমাবেশ কেন্দ্র করে যেহেতু একটি পরিবেশ সরকার সৃষ্টি করেছে, এখন এর শেষ দেখতে চায় বিএনপিও। তৃণমূল থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত সব পর্যায়ের নেতারা এখন বাড়িতে ঘুমাতে পারছেন না। এমনকি তাদের আত্মীয়স্বজনদের বাড়িতে গিয়েও গ্রেফতারের জন্য অভিযান চালানো হচ্ছে। নেতাকর্মীদেরও মনোভাব গ্রেফতার হতে হলে মাঠে থেকেই হবেন।


সূত্রমতে, কর্মসূচি সফলে একটি গুচ্ছ পরিকল্পনা ইতোমধ্যে হাইকমান্ডকে দেওয়া হয়েছে। গত স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এ পরিকল্পনা দিয়ে হাইকমান্ডকে জানানো হয়, সরকার ক্ষমতায় থাকার জন্য চেষ্টা করবে এটাই স্বাভাবিক। এজন্য নেতাকর্মীদের গ্রেফতার, সাজা দেওয়াই হচ্ছে তাদের শেষ অস্ত্র। স্থায়ী কমিটির সদস্য ও কেন্দ্রীয় নেতাদের গ্রেফতার করা হলেও কোনো সমস্যা নেই। আর কোনো বৈঠক না হলেও চলবে। একাধিক নীতিনির্ধারক জানান, কর্মসূচি সফলে যা যা করা দরকার তাই করা হবে। নানা ধাপে নেতাদের নেতৃত্ব, করণীয়সহ নানা বিষয়ে ইতোমধ্যে দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তৃণমূলে বার্তা দেওয়া হয়েছে, যে কোনো জায়গার নেতৃত্বে থাকা নেতা গ্রেফতার হলে পরবর্তী নেতা আন্দোলনের নেতৃত্ব দেবেন।


ইতোমধ্যে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, সাংগঠনিক সম্পাদক রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলুসহ বেশ কয়েকজন সিনিয়র নেতাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। আরও নেতাদের গ্রেফতারে বাসায় বাসায় অভিযান চালানো হচ্ছে।


বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী জানান, মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে গত ৭ দিনে গ্রেফতার করা হয়েছে ৪২৮৩ জনের অধিক নেতাকর্মী।


মিথ্যা মামলা হয়েছে ৮০টির অধিক। মৃত্যু হয়েছে একজন সাংবাদিকসহ ৯ জনের। জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে সরকার আবারও দেশে একটি একদলীয় নির্বাচন করার পাঁয়তারা করছে। এজন্যই তারা বিএনপিসহ বিরোধী নেতাকর্মীদের গ্রেফতার-নির্যাতনের পথ বেছে নিয়েছে। সরকার রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে বিএনপির সক্রিয় নেতাদের টার্গেট করে নতুন নতুন মামলা দিচ্ছে। নেতাকর্মীদের মাঝে ভীতি সৃষ্টির লক্ষ্যে এসব করছে। মামলা-হামলা-গ্রেফতার করে ক্ষমতাকে দীর্ঘায়িত করা যাবে না। জনগণ এবার তাদের ভোটাধিকার রক্ষায় ছাড় দেবে না।


খুলনা মহানগর বিএনপির সাবেক সভাপতি নজরুল ইসলাম মঞ্জু যুগান্তরকে বলেন, কয়েকদিন ধরেই গ্রেফতার আতঙ্ক ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। এখন বাড়িতে বাড়িতে পুলিশ। দিনের মধ্যে একাধিকবার অভিযান চালাচ্ছে। বিএনপি নেতাকর্মীদের পরিবারকে হয়রানি করা হচ্ছে। নেতাদের না পেয়ে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটছে। সরকার এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে যে, নেতাকর্মীরা এলাকাছাড়া। তাদের পরিবারগুলো এখন নিরাপত্তাহীন। একটা কঠিন সময় পার করছে খুলনা বিএনপি কর্মীরা। একটি রাজনৈতিক দলের কর্মীদের সঙ্গে প্রশাসনের এমন ব্যবহার কোনোভাবেই কাম্য নয়। এসবের মধ্যেও হরতাল-অবরোধ কর্মসূচি সফল করতে নেতাকর্মীরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছেন।


জামালপুর জেলা বিএনপির সভাপতি ফরিদুল কবির তালুকদার শামীম বলেন, ২৮ অক্টোবরের পর পুলিশ ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা একজোটে বাড়িঘরে অভিযান চালাচ্ছে। এসব করেও একদফার আন্দোলন ঠেকানো যাবে না। নেতাকর্মীরা ঐক্যবদ্ধভাবে ঘোষিত কর্মসূচি পালন করছে। বাড়িঘরে যেতে না পারলেও তারা এলাকায় রয়েছেন।


চাঁদপুর জেলা বিএনপির সভাপতি শেখ ফরিদ আহমেদ মানিক বলেন, কয়েকদিন ধরে এলাকায় গ্রেফতার আতঙ্ক বেড়েছে। কয়েকটি গায়েবি মামলা হয়েছে। এক একটা মামলায় ৮০-৯০ জনকে আসামি করা হয়েছে। তবুও নেতাকর্মীরা মাঠে আছেন। তারা ঘরে ঘুমাতে পারছেন না। পুলিশ বাড়িতে আসামি ধরতে গেলে এখন সঙ্গে ছাত্রলীগ ও যুবলীগ নিয়ে যায়। সরকারদলীয় নেতাকর্মীরা এলাকায় পুলিশের ভূমিকা পালন করছে। গ্রেফতার নিয়ে এখন আর চিন্তত নয়, নেতৃত্বে বিকল্প ব্যবস্থা রয়েছে। একজন গ্রেফতার হলে বিকল্প আরেকজন আন্দোলনের নেতৃত্ব দেবেন। নেতৃত্ব নিয়ে কারও আপত্তিও নেই।


শেয়ার করুন