চারদলীয় জোট সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের অংশ হিসেবে ২০০৪ সালে সমমনা দলগুলোকে নিয়ে ১৪ দলীয় জোট গঠন করেছিল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। পরবর্তী সময়ে ভাঙাগড়ার মধ্য দিয়ে কিছু দল জোট ছেড়েছে, আবার নতুন করে যুক্তও হয়েছে কিছু দল।
দুঃসময়ের পর সুসময়েও ধরে রাখা এসব জোটসঙ্গীর বিষয়ে এবার নতুন করে ভাবছে আওয়ামী লীগ। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে আওয়ামী লীগ ভোটের যে কৌশল সাজাচ্ছে, তাতে জোটগতভাবে করার সম্ভাবনা কম বলে জানিয়েছেন দলটির নেতারা।
গতকাল শনিবার রাজধানীর ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনার রাজনৈতিক কার্যালয়ে জোটের বিষয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেন, ‘শরিকদের আমাদের প্রয়োজন আছে কি না, সেটা এখনো ঠিক করিনি। কারণ, জোটের বিপরীতে জোট হবে। এখানে আমাদের প্রতিপক্ষ যদি একটা বড় জোট করে, সেখানে তার বিপরীতে আমাদের জোট হবে, তা ছাড়া আমাদের কেন অহেতুক জোট করতে হবে? প্রয়োজন না থাকলে তো জোট করব না। আর জোট করব যাদের নিয়ে, তাদের গ্রহণযোগ্যতা তো মানুষের কাছে থাকতে হবে।’
ওবায়দুল কাদেরের এমন বক্তব্যকে ব্যক্তিগত অভিমত বলে মন্তব্য করেছেন জোটের শরিকেরা। বিষয়টি নিয়ে ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমরা জানি প্রধানমন্ত্রী জোটগতভাবে নির্বাচনের কথা বলেছেন। নির্বাচন কমিশনে জোটগত নির্বাচনের কথা বলা হয়েছে। এখন যদি তারা বাদ দেয়, সেটা দিতেই পারে। এতে কিছু করার নেই।’ তিনি বলেন, ‘আমরা জোটনেত্রীর সঙ্গে আলোচনা করার জন্য সময় চেয়েছি। এখন সময় না দিলে আমরা কী করব?’
গত তিনটি জাতীয় নির্বাচন জোটগতভাবে করেছে আওয়ামী লীগ। এরই ধারাবাহিকতায় এবারও একই পথে হাঁটার কথা বলেছিল দলটি। গত ১৯ জুলাই গণভবনে ১৪ দলীয় জোটের নেতাদের সঙ্গে আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বৈঠক হয়। সেখানে সিদ্ধান্ত হয়, বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করলেও তারা ১৪ দলীয় জোটগতভাবে নির্বাচন করবে। এরপর ১৮ নভেম্বর নির্বাচন কমিশনকেও আওয়ামী লীগ জানায়, তারা নির্বাচনে জোটবদ্ধ ও এককভাবে অংশ নেবে। শরিকেরাও সেই অনুযায়ী নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। কিন্তু এর মধ্যেই আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের বক্তব্যে জোট নিয়ে দলটির দ্বিধার বিষয়টি উঠে আসায় এ নিয়ে ক্ষোভ জানিয়েছেন ১৪ দলীয় জোটের শরিকেরা। যেকোনো অবস্থাতেই জোটগতভাবে আগামী নির্বাচনে যাওয়ার কথা বলেছেন দলগুলোর নেতারা।
তরীকত ফেডারেশনের চেয়ারম্যান নজিবুল বশর মাইজভান্ডারি ‘উনি (ওবায়দুল কাদের) এ ধরনের কথা বলতেই পারেন। এটা ওনার ব্যাপার। যদিও আমাদের এ নিয়ে কিছু বলা হয়নি, এটা ওনাদের কৌশল হতে পারে। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে আমরা ১৪ দলীয় জোটগতভাবে নির্বাচন করব। সেটা এখনো ঠিক আছে।’
বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করল কি করল না, তার সঙ্গে আদর্শিক ১৪ দলীয় জোটের কোনো সম্পর্ক নেই বলে জানিয়েছেন জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু। তিনি আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘শেখ হাসিনার সঙ্গে সর্বশেষ বৈঠকে এবং নির্বাচন কমিশন তফসিল ঘোষণার পরে ইসিতে সব দলের চিঠি গেছে, ১৪ দলীয় জোটগতভাবে ভোট করব। তাই এখানে বিভ্রান্ত হওয়ার কিছু নেই।’
৩০০ আসনে দলীয় প্রার্থী জোটগত নির্বাচনের কথা থাকলেও এরই মধ্যে জোটের কয়েকটি আসনে আওয়ামী লীগ তাদের দলীয় প্রার্থী চূড়ান্ত করেছে বলে জানিয়েছে দলটির একটি সূত্র। সূত্রটি বলছে, বিএনপি অংশ না নিলেও যাতে নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক হয়, এ জন্য ৩০০ আসনে প্রার্থী দেওয়া হচ্ছে। একই সঙ্গে শরিকদেরও প্রার্থী দিতে বলা হচ্ছে। পরিস্থিতি বিবেচনা করে শেষ সময়ে জোটের প্রার্থীকে কিছু আসনে নৌকা দেওয়া হবে। না হলে নির্দিষ্ট কিছু আসনে তাদের বিপরীতে দুর্বল প্রার্থী দিয়ে বিজয়ী হতে সাহায্য করা হবে।
আওয়ামী লীগের নেতারা বলছেন, দলীয় সরকারের অধীনে বিএনপিসহ যুগপৎ আন্দোলনে অংশ নেওয়া দলগুলো নির্বাচন না করার ঘোষণা দিয়েছে। আবার বিরোধী দল জাতীয় পার্টির আচরণও সন্দেহজনক। শেষ পর্যন্ত তারাও নির্বাচনে অংশ না নিলে ২০১৪ সালের মতো বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ের সম্ভাবনা এড়াতে জোটগত নির্বাচন না-ও করতে পারে আওয়ামী লীগ। এ ক্ষেত্রে পরিস্থিতি বিবেচনায় সিদ্ধান্ত নেবে দলটি।
আওয়ামী লীগের একাধিক সূত্র দাবি করেছে, জাতীয় পার্টি দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ঘোষণা দিয়ে মনোনয়ন ফরম বিক্রি করলেও শেষ পর্যন্ত দলটি অংশ নেবে কি না, তা নিয়ে তাদের সন্দেহ আছে। কারণ, তফসিল ঘোষণার পরে তাদের আচরণ সন্দেহজনক।এ কারণে শেষ সময়ে নির্বাচন থেকে তারা সরেও দাঁড়াতে পারে বলে মনে করছেন আওয়ামী লীগের নেতাদের কেউ কেউ।
ওই নেতারা জানিয়েছেন, জাতীয় পার্টির সন্দেহজনক কর্মকাণ্ডের কারণে এখন ১৪ দলীয় জোটের আসনে প্রার্থী দিচ্ছে আওয়ামী লীগ। জাতীয় পার্টি শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে থাকলে জোটকে ছেড়ে দেওয়া আসনে নৌকা প্রতীক দেওয়া হবে। আর না হলে আওয়ামী লীগের প্রার্থী থাকবে। কিন্তু কৌশলে ১৪ দলীয় জোটের শরিক দলগুলোর প্রার্থীদের বিজয়ী করতে কাজ করা হবে। এ ক্ষেত্রে সংসদেও জোটের প্রার্থীরা বিরোধী দলের ভূমিকা নিতে পারবে এবং গঠনমূলক আলোচনা করতে পারবে।