২১ নভেম্বর ২০২৪, বৃহস্পতিবার, ১০:৫৫:১০ অপরাহ্ন
সুনামগঞ্জের বন্যা পরিস্থিতির অবনতি, কয়েক লাখ মানুষ পানিবন্দি
  • আপডেট করা হয়েছে : ১৬-০৬-২০২২
সুনামগঞ্জের বন্যা পরিস্থিতির অবনতি, কয়েক লাখ মানুষ পানিবন্দি

উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও টানা বৃষ্টিতে সুনামগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতি চরম অবনতি হয়েছে। এতে ভয়াবহ বন্যার আশঙ্কা করা হচ্ছে। জেলার সদরসহ ছাতক, দোয়ারাবাজার, তাহিরপুর, বিশ্বম্ভরপুর ও শান্তিগঞ্জ এই ছয়টি উপজেলা বন্যাকবলিত হয়ে পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন কয়েক লাখ মানুষ। পানিবন্দি লোকজন চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন। 


সুনামগঞ্জ জেলা সদরে বন্যার পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। ইতোমধ্যে সুনামগঞ্জ শহরেরর ৬০ ভাগ বাসাবাড়িতে বন্যার পানি ঢুকে পড়ায় চরম বিপাকে পড়েছেন শহরবাসী। শহরের অধিকাংশ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে বন্যার পানি ঢুকে পড়ায় অনেকেই ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখতে বাধ্য হয়েছেন। সুনামগঞ্জ শহরে ৩টি, দোয়ারাবাজার উপজেলায় ৩টি এবং ছাতকে ১৭টি বন্যা আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এতে সহস্রাধিক বন্যার্ত মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন। পরিস্থিতির উন্নতি না হলে আশ্রয় কেন্দ্রের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। জেলা সদরের সঙ্গে পাঁচ উপজেলার সড়ক যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে। 


বন্যাকবলিত হওয়ায় জেলার ৫২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠদান বন্ধ রয়েছে। সুনামগঞ্জে সুরমা নদীর পানি বিপৎসীমার ৫৫ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢল অব্যাহত থাকায় নদ-নদীতে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে।


সুনামগঞ্জ শহরের ট্রাফিক পয়েন্ট ছাড়া গোটা শহরের রাস্তা-ঘাট ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে বন্যার পানি ঢুকে পড়েছে। পানিতে ডুবে যাওয়ায় শহরের অনেক রাস্তায় যান চলাচল বন্ধ রয়েছে। সুনামগঞ্জ পৌর শহরের অন্তত ৩০টি আবাসিক এলাকায় পাহাড়ি ঢলের পানি প্রবেশ করেছে। ঘরবাড়ি দোকানপাটে পানি উঠে যাওয়ায় চরম দুর্ভোগের মধ্যে পড়েছেন সাধারণ মানুষ। 


পৌর এলাকার শান্তিবাগ আবাসিক এলাকার বাসিন্দা সেলিনা আবেদিন বলেন, যেভাবে পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে, এটা আগে কোনো সময়ে দেখিনি। আমাদের আশপাশে এমন কোনো বাসাবাড়ি নেই, যাদের ঘরে পানি ঢোকেনি। 


তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, যেভাবে পানি বাড়ছে এটা অব্যাহত থাকলে ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে।

 

শহরের নবীনগর এলাকার বাসিন্দা রহমান মিয়া বলেন, ‘বাসাবাড়িত পানি আইছে, বাচ্চা-কাচ্চা লইয়া বেশি চিন্তাত আছি। ঘরের ভেতরে পানি, বাইরেও পানি। সবকিছু মিলে চরম আতঙ্কের মধ্যে আছি।’


সুনামগঞ্জ ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক জাহেদ হাসান বলেন, ‘সুনামগঞ্জ শহরের ৮০ ভাগ দোকানপাট পাহাড়ি ঢলের পানিতে নিমজ্জিত। দোকান ঘরে পানি ঢুকায় ব্যবসায়ীরা চরম বিপাকে পড়েছেন। এমন অবস্থায় অনেকে দোকানপাট বন্ধ করে রেখেছেন। এতে ক্রেতা সাধারণ পড়েছেন দুর্ভোগে।’




সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজার উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। ভারি বৃষ্টিপাত ও পাহাড়ি ঢলের পানি বাড়তে থাকায় যতই সময় যাচ্ছে, বন্যা পরিস্থিতির ততই অবনতি হচ্ছে। উপজেলার সব ইউনিয়ন বন্যাকবলিত হয়ে লাখো মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। বুধবার রাতে বন্যার পানির স্রোতের তোড়ে ভেঙে গেছে উপজেলার দোহালিয়া-বাজিতপুর সড়কের একটি পাকা সেতু। এদিকে নতুন করে আমবাড়ী-কাটাখালী সড়ক বন্যার পানিতে প্লবিত হয়েছে। বন্যা পরিস্থিতির মধ্যেই উপজেলায় এসএসসি ও দাখিল পরীক্ষা নেওয়া হচ্ছে। 


উপজেলার সাতটি পরীক্ষা কেন্দ্রে প্রায় চার হাজার পরীক্ষার্থী অংশগ্রহণ করেছে। বন্যা পরিস্থিতির মধ্যে সড়ক যোগাযোগ বন্ধ থাকায় বিপাকে পড়েছেন পরীক্ষার্থীরা। এদিকে বন্যার পানির কারণে গ্রাম এলাকায় বিশুদ্ধ খাওয়ার পানির সরবরাহ ও স্যানিটেশনের অসুবিধা দেখা দিয়েছে।


দোয়ারাবাজার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ফারজানা প্রিয়াঙ্কা জানান, বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। সব এলাকায় স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্তদের খোঁজ খবর নেওয়া হচ্ছে। যাদের ঘরে পানি উঠেছে, তাদের স্থানীয় আশ্রয় কেন্দ্রে পুনর্বাসন করা হচ্ছে এবং ত্রাণ কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে।


ছাতকে  বন্যায় প্লাবিত হয়েছে উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকা। লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। ইতোমধ্যে বন্যায় তলিয়ে গেছে সড়ক, ঘরসহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। পৌরসভাসহ উপজেলার ১৩টি ইউনিয়ন বন্যার পানিতে প্লাবিত হয়েছে। শহরের নিচু এলাকার বাসাবাড়িতে বন্যার পানি ঢুকেছে।


ছাতকের ইউএনও মো. মামুনুর রহমান বলেন, ছাতকে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। ছাতকের সঙ্গে সিলেট ও সুনামগঞ্জের সরাসরি সড়ক যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে। ছাতকের সঙ্গে সিলেট ও সুনামগঞ্জের সরাসরি সড়ক যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে উপজেলা প্রশাসন কাজ করছে। ইতোমধ্যে উপজেলায় ১৭টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। প্রায় ৪শ পরিবার আশ্রয় নিয়েছে। তাদের শুকনো খাবার সরবরাহ করা হয়েছে। 


এদিকে, টানা বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে সৃষ্ট বন্যায় সুনামগঞ্জের এখন পর্যন্ত ৫২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠদান বন্ধ আছে। এর মধ্যে ৪০টি প্রাথমিক আর ১২টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়। পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র নিরাপদে রাখার নির্দেশনা দিয়েছে শিক্ষা অফিস।

জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা এসএম আব্দুর রহমান বলেন, বিদ্যালয়ে পানি ঢুকলে পাঠদান বন্ধ করে এলাকাবাসীকে আশ্রয় দেওয়ার জন্য উপজেলা অফিসারদের নির্দেশনা দেওয়া আছে। তারা তাদের প্রধান শিক্ষকদের মাধ্যমে প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত প্রাথমিকে ৪০টি বিদ্যালয়ে পাঠদান বন্ধ করা হয়েছে।


সুনামগঞ্জ পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. শামছুদ্দোহা বলেন, সুনামগঞ্জে টানা বৃষ্টিপাত এবং ওপার থেকে নেমে আসা ঢলে সুনামগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। বৃহস্পতিবার দুপুরে সুরমা নদীরপানি সুনামগঞ্জ শহরের ষোলঘর পয়েন্টে বিপৎসীমার ৫৫ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। একই সময়ে ছাতকে ২০৩ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। 


তিনি বলেন, উজানে বৃষ্টিপাত কমলে সুনামগঞ্জের বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হবে। কিন্তু ঢলের পানি আসা অব্যাহত থাকলে বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। 


তিনি বলেন, মঙ্গলবার সকাল ৯টা থেকে বুধবার সকাল ৯টা পর্যন্ত ৮৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। ভারতের চেরাপুঞ্জিতে গেল ২৪ ঘণ্টায় ৬৭৪ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে।


সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক জাহাঙ্গীর হোসেন জানান, টানা বর্ষণ ও চেরাপুঞ্জিতে বৃষ্টি অব্যাহত থাকায় সুনামগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। ইতোমধ্যে জেলার পাঁচটি উপজেলা বন্যা কবলিত হয়েছে। এর মধ্যে সুনামগঞ্জ সদর, ছাতক ও দোয়ারাবাজার উপজেলা বন্যায় বেশি আক্রান্ত হয়েছে। সুনামগঞ্জ শহরের ৬০ ভাগ এলাকা বন্যায় কবলিত হয়ে পড়েছে। এ তিনটি উপজেলায় ২৩টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। আশ্রয় কেন্দ্রে আসা বন্যার্তদের মাঝে রান্না করা ও শুকনো খাবার বিতরণ করা হচ্ছে। 


তিনি বলেন, পরিস্থিতি বিবেচনায় জেলায় প্রায় ২০০ আশ্রয় কেন্দ্র প্রস্তুত করা হয়েছে এবং প্রতি উপজেলায় চাল ও শুকনো খাবার পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। আমরা আরও ত্রাণসহায়তার জন্য চিঠি পাঠিয়েছি। আশা করি খাদ্যসহায়তার কোনো সমস্যা হবে না।

শেয়ার করুন