বিশাল বাজেটের জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এতে সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছে ২২৭৬ কোটি ২২ লাখ টাকা। ভোটে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় ব্যয় হবে প্রায় ১২২৫ কোটি ৬২ লাখ টাকা। বাকি ১০৫০ কোটি ৬০ লাখ টাকা ব্যয় হবে নির্বাচন পরিচালনা কার্যক্রমে। একক হিসাবে প্রতিটি আসনের নির্বাচন আয়োজন করতে ইসির (নির্বাচন কমিশন) ব্যয় হচ্ছে ৭ কোটি ২২ লাখ ৬১ হাজার টাকা। ইসিসংশ্লিষ্টরা জানান, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজন করতে যে অঙ্কের টাকা ব্যয় হচ্ছে, তা বিগত সব নির্বাচনের ব্যয়কে ছাড়িয়ে যাবে। এ নির্বাচন অনুষ্ঠানে ব্যয়ের নতুন রেকর্ড সৃষ্টি হতে যাচ্ছে। ইসি সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য বরাদ্দ ছিল ৭০০ কোটি টাকা। যদিও পরে তা অনেক বেড়েছিল। এর আগে ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে খরচ হয় প্রায় তিনশ কোটি টাকা। যদিও ওই সময়ে ১৫৩টি আসনে ভোটগ্রহণ করা হয়। বাকি আসনগুলোতে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংসদ-সদস্য নির্বাচিত হন। ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইসির ব্যয় হয় প্রায় দুইশ কোটি টাকা।
ইসি সূত্রে আরও জানা গেছে, জাতীয় সংসদের মতো আসন্ন উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের ব্যয়ও অনেক বাড়বে। আগামী বছর অনুষ্ঠেয় ৫২০টি উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের ব্যয় ধরা হয়েছে ১৬১৬ কোটি ১৬ লাখ টাকা। প্রতিটি উপজেলা পরিষদ নির্বাচন করতে ইসির খরচ ধরা হচ্ছে তিন কোটি ১০ লাখ টাকার বেশি। চলতি অর্থবছরে ইসির জন্য সংস্থান করা বাজেটে জাতীয় সংসদ ও উপজেলা মিলিয়ে ১৪৫৪ কোটি ৪৯ লাখ টাকা বরাদ্দ রয়েছে। সংশোধিত বাজেট প্রস্তাবে ২৪৩৭ কোটি ৮৯ লাখ টাকা বাড়িয়ে ৩৮৯২ কোটি ৩৯ লাখ টাকা বরাদ্দ চেয়েছে নির্বাচন কমিশন। সম্প্রতি নির্বাচনের সম্ভাব্য ব্যয়ের এ বাজেট অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে ইসি। নির্বাচন আয়োজনে চলতি অর্থবছরে বাড়তি টাকা চেয়েছে সাংবিধানিক এ প্রতিষ্ঠান। চলতি অর্থবছরেই জাতীয় সংসদ ও উপজেলা নির্বাচন হবে।
ইসির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, এ নির্বাচনে ভোটকেন্দ্রে সিসি ক্যামেরা বসানো ও ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোটগ্রহণ না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে নির্বাচন কমিশন। শুধু সিসি ক্যামেরা না থাকায় নির্বাচনের বাজেট থেকে ২০৬ কোটি ৪৪ লাখ টাকা খরচ কমছে। অন্যথায় ব্যয় আরও বাড়ত।
নির্বাচনে ব্যয় বাড়ার বিষয়ে জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনের সচিব মো. জাহাংগীর আলম যুগান্তরকে বলেন, এ বিষয়ে কর্মকর্তারা কাজ করছেন। তারা অর্থমন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট পর্যায়ে যোগাযোগ রাখছেন।
নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতপার্থক্যের মধ্যে ১৫ নভেম্বর দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফশিল ঘোষণা করেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল। এ নির্বাচনে ২৭টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল অংশ নিয়েছে। বিএনপিসহ ১৫টি রাজনৈতিক দল নির্বাচনে আসেনি। এ নির্বাচনে ৩০০ আসনে ১৮৯৫ প্রার্থী চূড়ান্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রয়েছেন। ৭ জানুয়ারি ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, জাতীয় সংসদ ও উপজেলা নির্বাচনে এবার ‘পরিচালন’ এবং ‘আইনশৃঙ্খলা রক্ষা’-এই দুই খাতেই ব্যয় আগের চেয়ে অনেক বেশি ধরা হয়েছে। দুই খাতের ব্যয় এবার কাছাকাছি রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। বিগত নির্বাচনগুলোতে নির্বাচন পরিচালনা খাতের প্রায় দ্বিগুণ ব্যয় হতো আইনশৃঙ্খলা রক্ষার কাজে। এবার নির্বাচন পরিচালনা কার্যক্রমের ব্যয় সে অনুপাতে অনেক বেড়েছে। এছাড়া জ্বালানি তেলের দাম, ভোটকেন্দ্র ও ভোটকক্ষের সংখ্যা বৃদ্ধি, মূল্যস্ফীতিসহ কয়েকটি কারণে খরচ বাড়ছে।
ইসির কর্মকর্তারা জানান, নিয়ম অনুযায়ী, ২০টি অর্থনৈতিক কোড থেকে নির্বাচনের সামগ্রিক ব্যয়ের টাকা ছাড় করে থাকে নির্বাচন কমিশন। ইসির প্রস্তাবিত বাজেটে ওই ২০টি অর্থনৈতিক কোডের ১৭টিতেই ব্যয় বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। একটিতে ব্যয় কমানো ও দুটিতে বিদ্যমান বাজেট বহাল রাখার কথা বলা হয়েছে।
জানা গেছে, ২০টি অর্থনৈতিক কোডের মধ্যে ‘সম্মানি’ খাতে সবচেয়ে বেশি ব্যয় ধরা হয়েছে। চলতি বছরের বাকি ৬ মাসের জন্য এ খাতে ইসি ব্যয় ধরেছে ১১৯৬ কোটি ৮০ লাখ টাকা। চলতি অর্থবছরে এ খাতে সংস্থান রয়েছে ৫৩৩ কোটি ৬২ লাখ টাকা। ইসি এ কোডেই ৬৬৩ কোটি ১৮ লাখ টাকা বরাদ্দ বাড়ানোর জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব করেছে। সম্মানি খাতের ১১৯৬ কোটি ৮০ লাখ টাকা জাতীয় ও উপজেলা নির্বাচনে ব্যয় হবে। চলতি অর্থবছরে অন্যান্য যেসব নির্বাচন বা উপনির্বাচন হবে সেখানকার ব্যয়ও এ খাত থেকে বহন করবে ইসি।
ভোটের কাজে নিয়োজিতদের সম্মানি বাড়ার কারণে এ খাতে ব্যয় বেড়েছে। চলমান দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রায় নয় লাখ প্রিসাইডিং, সহকারী প্রিসাইডিং ও পোলিং কর্মকর্তা দায়িত্ব পালন করবেন। গত নির্বাচনে ভোটগ্রহণ কর্মকর্তারা ১ দিনের সম্মানি পেয়েছিলেন। এবার তাদের ২ দিনের সম্মানি ও যাতায়াত ভাতা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে নির্বাচন কমিশন। গত নির্বাচনে একজন প্রিসাইডিং কর্মকর্তা ৪ হাজার টাকা পেয়েছিলেন। নতুন হিসাব অনুযায়ী, এবার নির্বাচনে প্রিসাইডিং কর্মকর্তারা ৯ হাজার টাকা পাবেন। একইভাবে সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তা ৭ হাজার টাকা ও পোলিং কর্মকর্তারা ৫ হাজার টাকা হারে পাবেন। গত নির্বাচনে সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তা তিন হাজার এবং পোলিং কর্মকর্তারা দুই হাজার টাকা হারে ভাতা পেতেন।
নির্বাচনে দায়িত্ব পালনকালে খোরাকি ভাতা পান বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য এবং নির্বাহী ও জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটদের সহায়ক ও পেশকাররা। তাদের খোরাকি ভাতাও বাড়ানো হয়েছে। রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নির্বাচনি মাঠে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর সদস্যদেরও আগের চেয়ে বেশি দিন রাখা হবে। ভোটকেন্দ্র বাড়ায় তাদের বেশি সংখ্যক সদস্যও মোতায়েন করতে হবে। চলতি অর্থবছরে বাকি সময়ের জন্য খোরাকি ভাতা খাতে ৬৪৭ কোটি ৯১ লাখ টাকা ধরেছে নির্বাচন কমিশন। যদিও চলতি অর্থবছরের বাজেটে এ খাতে ১৫০ কোটি ১১ লাখ টাকার সংস্থান রয়েছে। ইসি এ কোডেই ৪৯৭ কোটি ৮০ লাখ টাকা বাড়াতে অর্থ মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠিয়েছে। এছাড়া যাতায়াতের কাজে ব্যবহৃত যানবাহন খাতে ব্যয় বাড়িয়ে ২২৯ কোটি ৬২ লাখ টাকা করেছে।
জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আনসার সদস্যদের আপ্যায়ন ভাতা দ্বিগুণ করা হয়েছে। রিটার্নিং ও সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা, ম্যাজিস্ট্রেট, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন স্তরের কার্যালয় ও সংস্থার আপ্যায়ন ভাতার পরিমাণ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। চলতি অর্থবছরে এ খাতে ৩৯৩ কোটি ৭২ লাখ টাকা ব্যয় ধরেছে ইসি।
ভোটকেন্দ্রে ব্যবহারের জন্য চার্জার লাইট, ক্যালকুলেটর, স্ট্যাপলার পিনসহ বিভিন্ন দ্রব্যাদি কেনাকাটা হয়। চলতি অর্থবছরে অন্যান্য মনিহারি খাতে ৩১৮ কোটি ৬৭ লাখ টাকা চাওয়া হয়েছে। একইভাবে প্রচার ও বিজ্ঞাপন কোডে ৯৫ কোটি ১২ লাখ টাকা, ব্যবস্থাপনা ব্যয় কোডে ২৩৯ কোটি ২৬ লাখ টাকা, পেট্রোল, অয়েল ও লুব্রিকেন্ট কোডে ২১৭ কোটি ২১ লাখ টাকা চেয়েছে নির্বাচন কমিশন।