২৮ এপ্রিল ২০২৪, রবিবার, ০১:৩৭:৫০ অপরাহ্ন
কম সময়ে আন্দোলন সফল করতে চায় বিএনপি
  • আপডেট করা হয়েছে : ৩০-১২-২০২৩
কম সময়ে আন্দোলন সফল করতে চায় বিএনপি

টানা কর্মসূচি দিয়ে ভোটকেন্দ্রিক আন্দোলনে যাচ্ছে বিএনপি। সবকিছু ঠিক থাকলে কয়েক দিনের মধ্যেই তা ঘোষণা দেওয়ার কথা রয়েছে। এ কর্মসূচি সফল করতে মাঠ সাজাচ্ছে দলটি। সরকার পদত্যাগের একদফা এবং নির্বাচন বর্জন ও অসহযোগ আন্দোলনের লক্ষ্যে জনমত তৈরিতে সারা দেশে লিফলেট বিতরণ করা হচ্ছে। এতে সারা দেশে ব্যাপক সাড়া পেয়েছে দলটি। 


এ সুযোগে অনেক কেন্দ্রীয় নেতা এখন নিজ এলাকায় অবস্থান করছেন। বাকিদেরও এলাকায় যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সক্রিয় ও জনপ্রিয় নেতাদের বহিষ্কারাদেশও প্রত্যাহারের প্রক্রিয়া চলছে। ইতোমধ্যে অন্তত ৩০ নেতাকে আগের পদে পুনর্বহাল করা হয়েছে। 


এছাড়া ভোটে কোনো ধরনের সহযোগিতা ও কেন্দ্রে যাওয়ার প্রমাণ পেলে নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে-এমন বার্তা দেওয়া হয়েছে সব সাংগঠনিক জেলায়। এজন্য মনিটরিংয়ে সংশ্লিষ্ট আসনের নেতাদের দায়িত্বও দেওয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে এসব তথ্য।


সূত্র আরও জানায়, কূটনৈতিক তৎপরতাও বাড়িয়েছে বিএনপি। চলমান পরিস্থিতি ঢাকার বিদেশি দূতাবাস ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থাকে অবহিত করছে দলটি। ২৮ অক্টোবরের পর থেকে ২৪ হাজারের বেশি নেতাকর্মীকে গ্রেফতার ও ২৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। এরমধ্যে কারান্তরীণ থাকা অবস্থায় ১০ জনের মৃত্যুর তথ্যসহ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশের চলমান অবস্থা সম্পর্কে দূতাবাসগুলোতে সর্বশেষ চিঠি দিয়ে জানিয়েছে। এছাড়া গণসংযোগ ও লিফলেট বিতরণ কর্মসূচি আজ শেষ হচ্ছে। এদিন ফের নতুন কর্মসূচি ঘোষণা দেওয়া হতে পারে। 


জানা গেছে, ভোটের আগে টানা কর্মসূচি নিয়ে নেতাদের মধ্যে দুই মত রয়েছে। একটি পক্ষ বলছে, গণসংযোগ ও লিফলেট বিতরণ কর্মসূচিতে যেভাবে সাড়া পড়েছে তাতে আরও কয়েকদিন একই কর্মসূচি দেওয়া হলে আন্দোলনে জনসম্পৃক্ততা আরও বাড়বে। সেক্ষেত্রে তারা ভোটের দিনসহ ৪ অথবা ৫ দিনের টানা ‘অলআউট’ কর্মসূচি চান। অসহযোগের মধ্যে তা হরতাল বা অবরোধ হতে পারে। তাদের যুক্তি, কম সময়ে সর্বশক্তি নিয়ে রাজপথে নামলে আন্দোলন সফল হবে। বেশি দিন টানা কর্মসূচি থাকলে ধরপাকড় যেমন বাড়বে, তেমন জনগণ তা ভালোভাবে নাও নিতে পারে। আরেকটি পক্ষ, পহেলা জানুয়ারি থেকে টানা অবরোধ বা হরতালের পক্ষে। তবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।


বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, একটি আন্দোলনের নানা পর্যায়ে কর্মসূচি বিভিন্ন ধরনের হয়। আমরা সরকারের পদত্যাগের একদফা দাবিতে হরতাল-অবরোধসহ প্রহসনের নির্বাচন বর্জনের আহ্বান জানিয়ে গণসংযোগ কর্মসূচি করছি। আমরা যে একটা দুর্বৃত্ত সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই করছি, সেটা আমরা লিফলেটে জনগণের কাছে তুলে ধরেছি। সাধারণ মানুষ তা মন থেকে গ্রহণ করছেন। এরপর পরিস্থিতিই বলে দেবে, কর্মসূচি কী হওয়া উচিত।


তিনি আরও বলেন, ভোটারদের ন্যূনতম আগ্রহ না থাকলেও গণতান্ত্রিক বিশ্বকে তথাকথিত ভোটের উৎসব দেখানোর জন্য জনগণের ওপর অত্যাচার-নিপীড়ন শুরু হয়েছে। ভোট না দিলে সাধারণ মানুষকে এলাকা ছাড়া করার ভয় দেখানো হচ্ছে। ভোটের উৎসবের বদলে আতঙ্ক আর উৎকণ্ঠা চলছে। পুরো রাষ্ট্রযন্ত্রকে নামানো হয়েছে ‘আমি আর ডামি’র এই ভোট নাটকে। তবে এসব করে কোনো লাভ হবে না। দেশপ্রেমিক কোনো ভোটার পাতানো নির্বাচনকে জায়েজ করতে ওইদিন ভোটকেন্দ্রে যাবেন না।


দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, টানা কর্মসূচি সফল করতে ইতোমধ্যে দলীয় শৃঙ্খলা পরিপন্থি কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে বহিষ্কৃত নেতাদের বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার শুরু করেছে বিএনপি। আবেদনের প্রেক্ষিতে যারা সক্রিয় এমন নেতাদের পদ ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। সম্প্রতি কুমিল্লা উত্তর জেলা বিএনপির সাবেক সহসভাপতি কেএমআই খলিল, গাজীপুর মহানগর সদর মেট্রো থানা বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক হান্নান মিয়া হান্নু ও সদস্য সচিব হাসান আজমল ভূঁইয়া, গাজীপুর মহানগর শ্রমিক দলের সাবেক সভাপতি ফয়সাল আহামেদ সরকার, চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলাধীন আনোয়ারা উপজেলা বিএনপির সাবেক সদস্য সচিব লায়ন মো. হেলাল উদ্দিন ও উপজেলা ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি জিয়াউল কাদের জিয়া, উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের সাবেক সদস্য সচিব গাজী ফোরকান, জেলা ছাত্রদলের সাবেক নেতা মো. ইসমাইল ও মো. হাসান, চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক লিয়াকত আলী চেয়ারম্যানসহ অন্তত ৩০ নেতার বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করা হয়। বিএনপির একাধিক নীতিনির্ধারক জানান, সক্রিয় ও স্থানীয়ভাবে জনপ্রিয় নেতাদের বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহারের জন্য স্থায়ী কমিটির সিদ্ধান্ত রয়েছে। খুলনার নজরুল ইসলাম মঞ্জুসহ সক্রিয় ও জনপ্রিয়দের মধ্যে যাদের অব্যাহতি ও বহিষ্কার করা হয়েছে, তাদের দলে ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া চলছে। দ্রুত সময়ের মধ্যে তা করা হবে।


এদিকে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট বর্জনে উদ্বুদ্ধ করতে সব ধরনের উদ্যোগ নিয়েছে বিএনপি। একইসঙ্গে সমমনা অন্যান্য দল ও জোটের উদ্যোগেও চলছে ভোট বর্জনের ডাক। ভোটারদের কাছে এই নির্বাচনকে তামাশার নির্বাচন হিসাবে তুলে ধরতে একদিকে যেমন চলছে লিফলেট বিতরণের মতো গণসংযোগ কর্মসূচি, তেমনি বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও চলছে প্রচারণা। আগামীতে এই কর্মসূচিকে আরও বেগবান করা হবে। সঙ্গে একদফার আন্দোলনকেও কঠোর করার সিদ্ধান্ত রয়েছে। যেখানে দলের প্রত্যেক নেতাকর্মীকে নিজ নিজ এলাকায় গিয়ে ভোটারদের ভোটদানে বিরত রাখার পাশাপাশি রাজপথের আন্দোলনকে বেগবান করতে বলা হয়েছে বলে জানা গেছে।


সূত্রমতে, ভোটে কোনো প্রার্থীর পক্ষে কাজ বা কোনো ধরনের সহযোগিতার প্রমাণ পেলে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি। ইতোমধ্যে এমন অন্তত ৩৫ নেতাকে বহিষ্কারও করা হয়েছে। এমনকি ভোটের দিন নেতাকর্মীদের কেউ ভোটকেন্দ্রে গেলেও তা মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা করেছে। আসনভিত্তিক নেতাদের দায়িত্ব দিয়ে বলা হয়েছে, দলীয় নেতাকর্মীরা কেউ ভোটে সহযোগিতা ও কেন্দ্রে গেলে তাদের নাম কেন্দ্রীয় দপ্তরে পাঠাতে। অথবা জেলা ও উপজেলা বা থানাসহ সংশ্লিষ্ট ইউনিটও ব্যবস্থা নিতে পারবে। এ নির্দেশনা বিএনপির পাশাপাশি অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের জন্যও দিয়েছে।


জানা গেছে, লিফলেট ছাড়াও বিএনপি দু-এক দিনের মধ্যে ভোটবিরোধী স্টিকার তৈরি করবে। ওইসব স্টিকার যানবাহন ও বিভিন্ন স্থাপনা এবং হাটে বাজারে লাগানো হবে। আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভোটের বিরুদ্ধে এরই মধ্যে শুরু হয়েছে ব্যাপক প্রচার। বিভিন্ন গান তৈরি করে, নিমো তৈরি করে দলের নেতাকর্মীরা এই প্রচারে অগ্রণী ভূমিকা রাখছেন।


বিএনপির একাধিক নেতা জানান, নির্বাচনের আগেই স্পষ্ট হয়েছে- আওয়ামী লীগই আবার ক্ষমতায় আসছে। তারাই সরকার গঠন করছে। তাতে ভোটারদের ভোটদানে তেমন গুরুত্ব বহন করে না বলে আওয়ামী লীগেরও অনেক সমর্থক ভোটদানে উৎসাহ হারিয়ে ফেলছেন। প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনে জনগণ ভোটের উৎসব যেমনটা পালন করেন, সেরকমটা না হওয়ায় নির্বাচন নিয়ে কারও কোনো আগ্রহ নেই। এর পুরো প্রভাব পড়বে নির্বাচনের দিন।


জানা গেছে, বিএনপিসহ গণতন্ত্র মঞ্চ, ১২ দলীয় জোট, এলডিপি, গণফোরাম, সমমনা জাতীয়তাবাদী জোট, বাম গণতান্ত্রিক জোট, গণঅধিকার পরিষদ (দুই অংশ) ছাড়াও যুগপৎ আন্দোলনের বাইরে থাকা জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন, আমার বাংলাদেশ পার্টিসহ (এবি পার্টি) অন্তত ৬৩টি রাজনৈতিক দলও প্রায় একই কর্মসূচি পালন করতে পারে।


বিএনপি নেতাকর্মীরা জানান, ২৮ অক্টোবর ঢাকায় বিএনপির সমাবেশ পণ্ড হয়ে যাওয়ার পর সারা দেশে ব্যাপক ধরপাকড় চলে, যা এখনো অব্যাহত আছে। তখন থেকে বিএনপির কেন্দ্রীয়সহ সাংগঠনিক জেলার শীর্ষ নেতা এবং অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের শীর্ষ নেতারা আত্মগোপনে চলে যান। তারপরও তাদের তত্ত্বাবধানে নেতাকর্মী ও সমর্থকরা রাজপথে আন্দোলন করছেন। তাদের পরিবার-পরিজনও আতঙ্কে রয়েছেন। দেশের মোট জনসংখ্যার একটি বড় অংশ এমন দুর্বিষহ জীবন পার করছেন। তারা কোনো কিছুতেই ভোটকেন্দ্রে যাবেন না। তাদের আত্মীয়-স্বজনদেরও ভোটদানে বিরত রাখার কৌশল নেওয়া হয়েছে।


শেয়ার করুন