২৮ এপ্রিল ২০২৪, রবিবার, ১২:৫২:৩৮ পূর্বাহ্ন
ভেষজ ওষুধের ফাঁদে নিঃস্ব প্রবাসীরা
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৩-০১-২০২৪
ভেষজ ওষুধের ফাঁদে নিঃস্ব প্রবাসীরা

গোপালগঞ্জের ইমতিয়াজ ফকির উন্নত জীবনের স্বপ্ন নিয়ে ৯ মাস আগে কুয়েতের ফরানিয়া ডিসট্রিকে যান। যাওয়ার কিছুদিন পর হঠাৎ করেই মুটিয়ে যান তিনি। শরীরের ওজন কমাতে ‘অর্গানিক হারাবল’ নামে বাংলাদেশি একটি ই-কমার্স কোম্পানির ফেসবুক পেইজ থেকে ওষুধের অর্ডার করেন এই প্রবাসী। অগ্রিম টাকাও পরিশোধ করেন তিনি।


ডিএইচএল ইন্টারন্যাশনাল ব্রাঞ্চ নামের একটি কুরিয়ার কোম্পানির মাধ্যমে কুয়েতে পার্সেলে ওই ওষুধ পাঠানোর কথা বলে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানটি। ওষুধ অর্ডার করার পরই প্রতারকচক্রের ফাঁদে পড়েন ইমতিয়াজ। কৌশলে ইমতিয়াজের কাছ থেকে তার আকামার ছবিও নেয় প্রতারকরা। পরে কুরিয়ারে নিষিদ্ধ ওষুধ কুয়েতে এসেছে এবং কুয়েত পুলিশ আটক করেছে-এমন দাবি করে কয়েক ধাপে ইমতিয়াজের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নিয়েছে চক্রটি। এখন মামলা ও গ্রেফতারের ভয় দেখিয়ে ইমতিয়াজের কাছে ১০ লাখ টাকা দাবি করেছে তারা। ইমতিয়াজের মতো অনেক প্রবাসীই ওই চক্রের ফাঁদে পা দিয়ে বিপদে আছেন।


‘অর্গানিক হারাবল’-এর মতো শত শত নামসর্বস্ব ফেসবুক পেইজ গজিয়ে উঠেছে সামাজিক যোগাযোগের জনপ্রিয় মাধ্যম ফেসবুকে। ওইসব পেইজ ঘেঁটে দেখা গেছে, ‘শতভাগ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াহীন ও বিফলে মূল্য ফেরতে’র ঘোষণা দিয়ে বিভিন্ন হারবাল, হোমিও, আয়ুর্বেদিক বা ইউনানি ওষুধ বিক্রি করা হচ্ছে। চাহিদার শীর্ষে রয়েছে শরীরের অতিরিক্ত ওজন কমানোর ওষুধ। এসব ওষুধ কিনে প্রতারিত হওয়ার অভিযোগ উঠছে অহরহ। আয়ুর্বেদিক ওষুধের কারখানায় দেশের নামিদামি ব্র্যান্ডের ওষুধও নকল হচ্ছে। এখন প্রতারকচক্রটি দেশের সীমা অতিক্রম করে প্রবাসীদের ফাঁদে ফেলছে।


ফেসবুক পেইজে দেওয়া তাদের চটকদার বিজ্ঞাপনে আকৃষ্ট হচ্ছেন প্রবাসী বাংলাদেশিরা। চক্রগুলো প্রবাসীদের কাছে কুরিয়ারে ওষুধ পাঠানোর কথা বলে নানা কৌশলে জিম্মি করছে তাদের। ওইসব দেশের কাস্টমস কর্মকর্তা সেজে প্রতারকচক্রগুলো হাতিয়ে নিচ্ছে টাকা। যোগাযোগের জন্য তারা ব্যবহার করছে এনক্রিপটেড অ্যাপস হোয়াটসঅ্যাপ। ফেসবুকে প্রচারণা চালানোর এসব হারবাল ওষুধের প্রতিষ্ঠানেরও কোনো অস্তিত্ব নেই। এসব চক্র খাগড়াছড়ি, ছট্টগ্রাম, ফেনি, বাগেরহাট, খুলনা ও লক্ষ্মীপুরের প্রত্যন্ত অঞ্চলে অবস্থান করে প্রতারণা করছে বলে জানিয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।


এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের উপপরিচালক ও আইন কর্মকর্তা মো. নুরুল আলম যুগান্তরকে বলেন, ‘ভুক্তভোগী ব্যক্তি তথ্যপ্রমাণসহ আমাদের কাছে অভিযোগ করলে অবশ্যই আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’


তিনি আরও বলেন, গত ৭ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদে ‘ওষুধ ও কসমেটিকস আইন-২০২৩’ পাশ হয়েছে। আইন অনুসারে কেউ ওষুধ প্রশাসনের অনুমতি ছাড়া ফেসবুক, ওয়েবসাইট ইন্টারনেট মিডিয়ায় বিজ্ঞাপন আকারে ওষুধের প্রচার করলে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এজন্য সাত লাখ টাকা জরিমানা এবং পাঁচ বছরের জেল বা উভয় দণ্ডের বিধান রয়েছে।


যেভাবে ফাঁদে পড়ছেন প্রবাসীরা : প্রবাসী ভুক্তভোগী ইমতিয়াজ ফকির যুগান্তরকে জানান, গত ১৯ ডিসেম্বর কুয়েত থেকে পেটের চর্বি কাটার একটি হারবাল ওষুধ অর্ডার করেন। ফেসবুক পেইজ থেকে হোয়াটসঅ্যাপের নম্বর নিয়ে অর্গানিক হারবাল নামের একটি কোম্পানির কাছে অর্ডারটি করেন তিনি। তাকে জানানো হয়, প্রডাকটির জন্য ৪ হাজার ৭০০ টাকা দিলে পার্সেলে কুয়েতে পাঠিয়ে দেবে। মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসের মাধ্যমে টাকা পরিশোধের দুই থেকে তিন দিনের মধ্যে পার্সেলটি পাঠিয়ে দেবে বলেও জানানো হয় তাকে। টাকা পরিশোধের পর ডিএইচএল ইন্টারন্যাশনাল ব্রাঞ্চ নামের কুরিয়ার কোম্পানির একটি হোয়াটসঅ্যাপ নম্বর দেওয়া হয় ইমতিয়াজকে।


ইমতিয়াজ বলেন, ‘ওই নম্বরে যোগাযোগ করা হলে তারা জানায়, প্রডাকটি কুয়েত বিমানবন্দরে আসছে, তবে কুয়েত কাস্টমস জব্দ করেছে। আপনি পার্সেলে বিপুল পরিমাণ নিষিদ্ধ যৌন উত্তেজক ওষুধ এনেছেন। ওই চক্রের সদস্য আপনি।’ এ কথা শুনে ঘাবড়ে যান ইমতিয়াজ। তিনি বলেন, ওই কুরিয়ার কোম্পানির প্রতিনিধিকে জানান, শরীরের ওজন কমানোর ভেষজ ওষুধ অর্ডার করেছেন। সেটাই কুয়েতে আসার কথা।’ তখন কুরিয়ার কোম্পানি ডিএইচএল ইন্টারন্যাশনালের কর্মী পরিচয় দেওয়া ব্যক্তি বলেন, চার হাজার টাকা দিলে কুয়েতের কাস্টমস থেকে পার্সেল নিয়ে ইমতিয়াজকে পৌঁছে দেবে। কাঙ্ক্ষিত টাকা পাঠিয়ে দেন ইমতিয়াজ।


এরপরও ইমতিয়াজকে বলা হয়, মালামাল ছোটাতে হলে আপনার আকামার ছবি লাগবে, আপনি বৈধভাবে কুয়েতে আছেন কিনা তার প্রমাণ হিসাবে। ফলে আকামার ছবিও পাঠান তিনি। এরপর ফের প্রতারকচক্র বলে, যেহেতু কুয়েত পুলিশ জব্দ করেছে এবং মামলা দিয়েছে সেহেতু ৪৪ দিনার দিতে হবে (বাংলাদেশি টাকায় ১৬ হাজার ৬২৬ টাকা)। টাকা দিলে ভবিষ্যতে এ বিষয়ে আর কোনো সমস্যা হবে না।


ইমতিয়াজ জানান, যেহেতু তিনি অনেকগুলো টাকা খরচ করে নতুন আসছেন সেহেতু ঝামেলা এড়াতে ৪৪ দিনার পাঠিয়ে দেন। এর পর তাকে বলা হয়, ওই ওষুধ কোম্পানিকে ১০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। সেই টাকা ইমতিয়াজকে দিতে হবে।


হারবাল ওষুধের নামে প্রতারণা : ফেসবুকে বিভিন্ন হারবাল (ভেষজ) ওষুধের বিজ্ঞাপন দিয়ে ক্রেতাদের সঙ্গে প্রতারণার ঘটনা প্রায়ই ঘটছে। এসব হারবাল ওষুধের অধিকাংশের তৈরিতে নেই কোনো অনুমোদন। মানা হচ্ছে না চিকিৎসা বিজ্ঞানের কোনো নিয়ম-কানুন। ফলে ক্ষতিকর এসব ওষুধ, ফুড সাপ্লিমেন্ট ও কসমেটিকস কিনে প্রতারিত হচ্ছেন অনেকে। বিভিন্ন হারবাল ওষুধের আড়ালে রাজধানীসহ সারা দেশে সক্রিয় রয়েছে অজ্ঞান পার্টি। হকারের বেশ ধরে বাসে উঠে বা বাসাবাড়িতে ঠুকে হারবাল ওষুধ বিক্রির নামে মানুষকে চেতনানাশক ওষুধ খাইয়ে সর্বস্ব ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনাও ঘটছে। তবে প্রবাসীদের জিম্মি করে টাকা আদায়ের ঘটনা নতুন করে উদ্বেগ ছড়াচ্ছে।


ই-কমার্সের আড়ালে বিভিন্ন প্রতারকচক্র নিয়ে তদন্তকারী ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের উত্তরা বিভাগের সহকারী কমিশনার (এসি) মো. ইমরান হোসেন মোল্লা যুগান্তরকে বলেন, এসব চক্র খাগড়াছড়ি, চট্টগ্রাম, ফেনী, বাগেরহাট, খুলনা ও লক্ষ্মীপুর এলাকার প্রত্যন্ত অঞ্চলে অবস্থান করে। তাদের ব্যবহৃত ফোন নম্বর ও বিকাশ অ্যাকাউন্টের নম্বরগুলোও অন্যদের নামে রেজিস্ট্রেশন করা। ফলে প্রকৃত অপরাধীদের সহজে খুঁজে বের করা যায় না।


শেয়ার করুন