০৩ মে ২০২৪, শুক্রবার, ০৩:৩৬:৪১ পূর্বাহ্ন
শাহ আমানতে দুর্নীতির শক্তিশালী সিন্ডিকেট
  • আপডেট করা হয়েছে : ২৮-০১-২০২৪
শাহ আমানতে দুর্নীতির শক্তিশালী সিন্ডিকেট

চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের স্টেকহোল্ডার দুই এয়ারলাইন্সসহ সাত সংস্থার ব্যাপক দুর্নীতির চিত্র উঠে এসেছে এক প্রতিবেদনে। এর মধ্যে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) অ্যাভিয়েশন সিকিউরিটি (অ্যাভসেক) শাখা, বেবিচক এস্টেট শাখা, বেবিচক ইএম শাখা, বেবিচক সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং শাখা, আনসার, কাস্টমস এবং শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর, এপিবিএন ও পুলিশের অসাধু কর্মকর্তারা জড়িয়েছেন নানা অপকর্মে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। প্রতিবেদনে উঠে এসেছে বেবিচকের ১০ কর্মকর্তার নাম। এর মধ্যে চারজনকে বদলি করা হলেও বাকিরা রয়ে গেছেন বহাল তবিয়তে।  


গত ১৫ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পরিচালক-৮ মোহাম্মদ রফিকুল আলম স্বাক্ষরিত এক প্রতিবেদনে শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে কর্তব্যরত বিভিন্ন সংস্থার কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিভিন্ন দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ার চিত্র তুলে ধরা হয়। প্রতিবেদনে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স ও ফ্লাই দুবাইসহ সাত সংস্থার অপকর্মের কথা উল্লেখ রয়েছে। এসব সংস্থার কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীর দুর্নীতির কারণে বিমানবন্দরের সার্বিক কার্যক্রম ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি যাত্রীসেবা ও নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা করা হয়েছে। 


বেবিচকের দুর্নীতি : প্রতিবেদনে বলা হয়েছে বিমানবন্দরের মূল স্টেকহোল্ডার হলো বেবিচক। বেবিচকের বিভিন্ন বিভাগের কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েছেন। বেবিচক অ্যাভিয়েশন সিকিউরিটি (অ্যাভসেক) শাখার সদস্যরা বিমানবন্দরের বিভিন্ন পয়েন্টে যাত্রীদের কাছ থেকে বকশিশের নামে টাকা নেওয়া, স্বর্ণ ও ইয়াবা চোরাচালান, হুন্ডি পাচার, বিভিন্ন শিল্প গ্রুপের কর্ণধার ও তাদের পরিবারের সদস্যদের প্রটোকল দেওয়ার নামে অর্থ আদায়সহ নানা রকম অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েছে। অ্যাভসেক শাখার সহকারী পরিচালক মো. নজরুল ইসলামের প্রশ্রয়ে এসব অনিয়ম হচ্ছে। 


বেবিচকের এস্টেট শাখা : চট্টগ্রাম বিমানবন্দরের এস্টেট শাখার সাবেক প্রধান মো. মশিউর রহমানের দায়িত্ব পালনের সময়ে এই শাখায় সাতটি ক্ষেত্রে অনিয়ম-দুর্নীতি করা হয়েছে। বিমানবন্দর টার্মিনালের কোনো স্পেসের ইজারা নিতে বা নবায়ন করতে ঘুস নেওয়া, ইজারাপ্রাপ্তদের কাছ থেকে মাসোহারা আদায়, চট্টগ্রাম বিমানবন্দর নির্মাণকালে ভূমি অধিগ্রহণে ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনে বরাদ্দ করা প্লটের রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়ায় ঘুস বাণিজ্য, রেন্ট-এ-কার ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে মাসোহারা আদায়, টেন্ডার প্রক্রিয়ায় আর্থিক সুবিধা গ্রহণের মতো অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন মশিউর রহমান। তাকে ঢাকা বিমানবন্দরে বদলি করা হলেও তার সহযোগীরা এখনও একই কর্মকাণ্ড অব্যাহত রেখেছেন। এ ছাড়া এস্টেট শাখার বর্তমান সহকারী পরিচালক মো. ইব্রাহিম খলিল বিভিন্ন ভাবে ঘুস নিচ্ছেন।


বেবিচক ইএম শাখা চট্টগ্রাম বিমানবন্দরের ইলেকট্রিক্যাল যন্ত্রপাতির রক্ষণাবেক্ষণ করে। ইএম শাখার সিনিয়র উপ-সহকারী প্রকৌশলী মো. আজিম উদ্দীন এবং মো. আশরাফুল হোসেন শাহিন শাখার কাজে টেন্ডারে কাজ পাইয়ে দিতে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে নিয়মিত ঘুস নেন। এ ছাড়াও এই শাখার মেকানিকস দেবপ্রিয় সিংহ, সহকারী মেকানিকস মো. ইউনুস, ওয়্যারম্যান মো. আবদুল কাদের, হেলপার মো. ফিরোজ, অফিস সহায়ক ওসমানের সহায়তায় অনিয়ম-দুর্নীতির শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে তোলা হয়েছে।


বেবিচক সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং শাখার দায়িত্বপ্রাপ্ত সহকারী প্রকৌশলী আবদুল আলিম বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েছেন। তিনি বিমানবন্দরে যেকোনো উন্নয়ন কাজে নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী ব্যবহারের সুযোগ দিয়ে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের ঘুস নেন।


আনসার সদস্যের দুর্নীতি : চট্টগ্রাম বিমানবন্দর টার্মিনালের আগমন/বহির্গমনের গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলোতে অন্তত ২০০ আনসার সদস্য নিরাপত্তার কাজে নিয়োজিত থাকেন। বর্তমানে তারা নিরাপত্তার চেয়ে যাত্রীদের কাছ থেকে বকশিশ আদায়ে ব্যস্ত। কোনো কোনো সময় বিমানবন্দরের ড্রাইভওয়েতে প্রবেশের জন্য যাত্রীদের কাছ থেকে ১০০-২০০ টাকা আদায় করা হয়। বকশিশের টাকার অংশ শাখার ইনচার্জও পেয়ে থাকেন। আনসার সদস্যরা দায়িত্বে নিয়োজিতদের সংখ্যা বাড়িয়ে বা বেশি দেখিয়ে ভুয়া বেতন বিল তৈরি করে টাকা উত্তোলন করেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। 


কাস্টমস, শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের দুর্নীতি : প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, বর্তমানে কাস্টমস সদস্যরা অবৈধ স্বর্ণ চোরাচালানে জড়িয়ে পড়েছেন। কাস্টমসের কয়েকজন সদস্য চোরাচালানকারীদের মালামাল বিমানবন্দর থেকে বিনা ট্যাক্সে বের করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বাড়তি টাকা আদায় করছেন। 


এপিবিএনের দুর্নীতি : এপিবিএনের সদস্যরা বিমানবন্দর ও সংলগ্ন এলাকায় ছিনতাই ও চাঁদাবাজিতে জড়িয়ে পড়েছেন। এপিবিএনের একজন ইন্সপেক্টরের নেতৃত্বে স্বর্ণ চোরাচালানকারীদের কাছ থেকে নিয়মিত চাঁদা আদায় করা হচ্ছে। এছাড়াও যাত্রীদের ভয়ভীতি দেখিয়ে তাদের মূল্যবান মালামাল আত্মসাৎ করা হয়। এসব ঘটনায় অভিযুক্ত সদস্যদের শাস্তি দেওয়া হয়েছে। তবে বর্তমানে বিমানবন্দরে এপিবিএন ইন্টেলিজেন্স টিমের কার্যক্রম নিয়েও প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।


পুলিশ ফাঁড়ির দুর্নীতি : চট্টগ্রাম বিমানবন্দরের পতেঙ্গা মডেল থানার পুলিশ ফাঁড়ি থেকে কোনো আইনি সহায়তা পাওয়া যায় না। ফাঁড়ির সদস্যরা যাত্রীদের মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে স্বর্ণের বার নিয়ে আসেন। পুলিশ ফাঁড়ির সদস্যরা চোরাচালানকারীদের কাছ থেকে নিয়মিত মাসোহারার বিনিময়ে তাদের মালামালের নিরাপত্তা দেন। মামলা তদন্তে তাদের অগ্রহ নেই। 


বিমানের দুর্নীতি : বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের কয়েকজন অসাধু সদস্য মধ্যপ্রাচ্য থেকে আসা ফ্লাইটগুলোকে স্বর্ণ চোরাচালানের ‘নিরাপদ’ মাধ্যমে পরিণত করেছেন। বিমানবন্দরের নিরাপত্তা বাহিনী প্রায়ই বিমানের সিট, টয়লেট, বিভিন্ন ইঞ্জিনিয়ারিং ইক্যুইপমেন্ট, এমনকি পরিত্যক্ত চাকার ভেতর হতেও প্রচুর স্বর্ণ উদ্ধার করে। এসব কাজে বিমানের এক বা একাধিক সদস্যের প্রত্যক্ষ সম্পৃক্ততা ও সহযোগিতা রয়েছে। বিমানবন্দরের কার্গো দিয়ে নিষিদ্ধ পণ্য চোরাচালানেও জড়িত এরা।


ফ্লাই দুবাই এয়ারলাইন্সের দুর্নীতি : ফ্লাই দুবাই এয়ারলাইন্সের বিরুদ্ধে ভিজিট ভিসায় লো-প্রোফাইল যাত্রী পাঠানোর মাধ্যমে মানব পাচারের অভিযোগ রয়েছে। চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে তাদের যাত্রীসেবার মান অত্যন্ত নিম্নমানের। তাদের বিরুদ্ধে যাত্রীদের ব্যাগেজের ওজন বাড়তি দেখিয়ে অতিরিক্ত চার্জ আদায়, অতিরিক্ত ভাড়া নেওয়া, যাত্রীদের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণের অভিযোগ রয়েছে। 


প্রতিবেদনে ৫ সুপারিশ : প্রতিবেদনে পাঁচটি সুপারিশ করা হয়েছে। এগুলো হলো-চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে বিভিন্ন দুর্নীতি, অনিয়মসহ নানা অপকর্মের সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চিহ্নিত করে বদলির পাশাপাশি দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা নেওয়া; রানওয়ে, অ্যাপ্রোনসহ পুরো বিমানবন্দর এলাকা থেকে বেবিচকের কোনো গাড়ি বের হওয়ার সময় এপিবিএন ও আনসার বাহিনী কর্তৃক নিয়মিত তল্লাশি কার্যক্রম চালু করা; কোনো মেশিনারিজ বের করে নেওয়ার সময় সংশ্লিষ্ট শাখা প্রধানের প্রত্যয়নপত্র বা এনওসি লাগবে; ইএম শাখার চুরি ঠেকাতে রেজিস্ট্রারের মাধ্যমে নষ্ট যন্ত্রপাতির হিসাব রাখা, আলাদা স্টোরে সংরক্ষণ করা; বিমানবন্দরের যন্ত্রপাতি রক্ষণাবেক্ষণে নিয়োজিত জনবল নিয়মিত পরিবর্তনের মাধ্যমে কার্যক্রম চালুর নির্দেশনা দেওয়া।


এ প্রসঙ্গে শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন তাসলিম আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, ‘প্রতিবছরই এ ধরনের প্রতিবেদন হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এবারও আমরা অভিযোগের বিষয়ে সাত কর্মদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিয়েছি। সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। এটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। বিষয়টি গোপনীয়। তাই বেশি কিছু বলা যাচ্ছে না।’


শেয়ার করুন