ইউএস অ্যাগ্রিমেন্ট অ্যাপে বিনিয়োগ করে রাজশাহীর প্রতারিত ব্যক্তিরা মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেছেন। শনিবার দুপুর ১২টা থেকে ১টা পর্যন্ত নগরীর কাদিরগঞ্জে এ কর্মসূচি পালিত হয়। এতে প্রতারিত প্রায় শতাধিক নারী-পুরুষ অংশগ্রহণ করেন। তারা বিনিয়োগ করা টাকা ফেরত পেতে সরকারের সুদৃষ্টি কামনা করেন। একইসঙ্গে দ্রুত প্রতারকদের গ্রেপ্তারের দাবি জানান।
ভুক্তভোগীরা বলছেন, ইউএস অ্যাগ্রিমেন্টের মাধ্যমে ফরেক্স মার্কেটে বিনিয়োগের নামে তাদের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে। এ জন্য তাদের এক লাখ টাকার বিপরীতে প্রতিমাসে রেমিটেন্স আকারে ১১ হাজার ২০০ টাকা করে মুনাফা দেওয়ার প্রলোভন দেওয়া হয়েছিল। বিদেশী অ্যাপের কথা বলে বিনিয়োগ করানো হলেও বাস্তবে এটি দেশীয় প্রতারকচক্রের একটি অ্যাপ।
এই অ্যাপে রাজশাহীর প্রায় শতাধিক ব্যক্তি অন্তত ৫০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেন। সারাদেশে বিনিয়োগকারী প্রায় দুই হাজার জন। আর প্রতারকদের হাতিয়ে নেওয়া টাকার পরিমাণ প্রায় ২০০ কোটি। এই প্রতারণার ঘটনায় রাজশাহীতে সম্প্রতি দুটি মামলা দায়ের হয়েছে। এরপর আসামিদের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা চেয়ে ইমিগ্রেশন বিভাগে চিঠি দিয়েছে পুলিশ।
ভুক্তভোগীদের দেওয়া তথ্যমতে, ঢাকায় থিতু হওয়া নোয়াখালীর মাইজদির প্রতারক সজীব কুমার ভৌমিক ওরফে মাহাদি হাসান (৩৩) এই প্রতারকচক্রের হোতা। তার সঙ্গে কান্ট্রি লিডার হিসেবে ছিলেন মোতালেব হোসেন ভুঁইয়া (৩৫)। কান্ট্রি ডিরেক্টর ছিলেন ফারুক হোসাইন সুজন। এছাড়া রাজশাহী বিভাগীয় প্রধান হিসেবে ছিলেন মো. ওয়াহেদুজ্জামান সোহাগ (৩৮), বিভাগীয় ব্যবস্থাপক হিসেবে ছিলেন সোহাগের স্ত্রী ফাতেমা তুজ জহুরা ওরফে মিলি (৩২) এবং জেলা এজেন্ট হিসেবে ছিলেন মিঠুন মন্ডল (৩৬)। তারা সবাই পলাতক।
মানববন্ধন কর্মসূচিতে নগরীর শিরোইল এলাকার বাসিন্দা সুফী আবদুল নাঈম বলেন, তিনি একটি ব্যাংকে দীর্ঘদিন চাকরি করে অবসর নিয়েছেন। হাতে টাকা ছিল। এক মামার মাধ্যমে বিভাগীয় প্রধান ওহেদুজ্জামান সোহাগের সঙ্গে তার পরিচয় হয়েছিল। সোহাগ তাকে বেশি মুনাফার লোভ দেখিয়ে এই অ্যাপে বিনিয়োগ করান। তিনি নিজে বিনিয়োগ করেছিলেন ৩৫ লাখ টাকা। আত্মীয়-স্বজনের মিলিয়ে বিনিয়োগ করা টাকার পরিমাণ ৯৮ লাখ। তারা সবাই নিঃশ^ হয়ে গেছেন। তিনি টাকা ফেরতে সরকারের সুদৃষ্টি কামনা করেন।
রাজশাহীর গোদাগাড়ীর ইউসুফ আলী বলেন, বিদেশী প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগের নামে আমাদের এই অ্যাপে বিনিয়োগ করানো হয়। প্রথমে আমি ৬ লাখ টাকা বিনিয়োগ করি। পরে ট্রাক্টর বিক্রি করে ২৭ লাখ টাকা বিনিয়োগ করি। আমার বন্ধু-বান্ধবেরা আরও প্রায় কোটি টাকা বিনিয়োগ করে। এটি কোন বিদেশী প্রতিষ্ঠান না। এটা দেশী প্রতারক চক্র। আমাদের টাকা বিদেশে পাচার হয়নি। এখন দেখছি ওহেদুজ্জামান সোহাগ ২ কোটি ৫৫ লাখ টাকায় একটা জমি কিনেছে। নামে-বেনামে আরও সম্পদ গড়েছে। আমরা ভুক্তভোগী, আমরা চাই সরকার আমাদের পাশে দাঁড়াক এবং আমাদের টাকাগুলো ফেরতের ব্যবস্থা করুক।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের শরিফুল ইসলাম বলেন, ‘আমি নিজে ৯ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছিলাম। আরও কয়েকজনকে আমি বিনিয়োগ করিয়েছিলাম ৩৫ লাখ টাকা। কেউ এক টাকাও লাভ পাইনি। যাদের আমি বিনিয়োগ করার কথা বলেছিলাম, পরে তাদেরকে আমার জরিমানা দিতে হয়েছে। জায়গা-জমি বিক্রি করে আমি জরিমানা দিয়ে নিঃশ^ হয়ে গেছি।’
মানববন্ধনে এসেছিলেন নগরীর ডাসমারী এলাকার বাসিন্দা হলুদ-মরিচের ব্যবসায়ী গিয়াস উদ্দিন। তিনি বলেন, ওহেদ্জ্জুামান সোহাগ তাকে এক লাখ টাকা বিনিয়োগ করিয়েছিলেন। তিনি ব্যবসা থেকে টাকা টেনে এতে বিনিয়োগ করেন। এখন নিজের ভুল বুঝতে পারছেন।
নগরীর বহরমপুর এলাকা থেকে এসেছিলেন গৃহবধূ রেবেকা সুলতানা। তিনিও বিনিয়োগ করেছিলেন এক লাখ টাকা। রেবেকা জানান, তার ১০-১২ জন আত্মীয়-স্বজনও বিনিয়োগ করেছিলেন। তারাও মানববন্ধনে এসেছিলেন। টাকা উদ্ধারে তিনিও প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করেন।
মানববন্ধনে ভুক্তভোগীরা জানান, টাকা উদ্ধারে তাদের পক্ষ থেকে রাজশাহীর রাজপাড়া ও গোদাগাড়ী থানায় দুটি মামলা করা হয়েছে। এই মামলায় আদালতে হাজির হয়ে জামিন নিয়েছেন ওহেদুজ্জামান সোহাগের স্ত্রী ফাতেমা তুজ জহুরা মিলি। এরপর হুমকি-ধামকি দেওয়ার অভিযোগে মিলি উল্টো বাদী হয়ে ভুক্তভোগীদের বিরুদ্ধে আদালতে একটি মামলা করেছেন। তারা হয়রানিমূলক এ মামলা প্রত্যাহারের দাবি জানান। পাশাপাশি তাদের মামলার আসামিদের গ্রেপ্তারের দাবি জানান। তাদের মামলার আসামিদের মধ্যে মিলি ছাড়া সবাই পলাতক।
গোদাগাড়ী থানার মামলাটি তদন্ত করছেন উপপরিদর্শক (এসআই) শিহাব উদ্দিন। তিনি জানান, মামলার এক আসামি জামিন নিয়েছেন বলে তিনি শুনেছেন। অন্য আসামিদের নাম-ঠিকানা যাচাইয়ের জন্য সংশ্লিষ্ট থানায় কাগজ পাঠানো হয়েছে। তাদের গ্রেপ্তারের জন্যও অনুরোধ জানানো হয়েছে। অবস্থান শনাক্ত করামাত্র তাদের গ্রেপ্তার করা হবে বলেও জানান তিনি।