বড় বাজেটের বড় রাজস্ব লক্ষ্য পূরণ থেকে ক্রমেই সরে যাচ্ছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। অর্থবছরের ছয় মাসেই ঘাটতি ছাড়িয়েছে ২৩ হাজার কোটি টাকা। তবে ঘাটতি বাড়তে থাকলেও লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে গতানুগতিক পথেই হাঁটছে সরকারের রাজস্ব আদায়ের শীর্ষ এ সংস্থাটি; বিশেষ সময়ে বেশি রাজস্ব আয় করে সরকারের তহবিলকে সমৃদ্ধ করতে যে ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া দরকার, সেখানে কার্যকর কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। এরই মধ্যে আরেকটি বাজেটের প্রস্তুতি চলছে।
বিশ্লেষকেরা মনে করেন, দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি, বেসরকারি খাতের প্রসারের সঙ্গে রাজস্ব আয়ের প্রবৃদ্ধি মিলছে না; বরং যাঁরা সব সময় কর দেন, তাঁরাই দিয়ে যাচ্ছেন। নতুন সম্ভাবনাময় করদাতারা করজালে আসছেন না কাঙ্ক্ষিত হারে। এ অবস্থার উন্নতি না হলে এনবিআরের রাজস্ব লক্ষ্য পূরণ সম্ভব হবে না।
জানা যায়, বেসরকারি খাতের দ্রুত প্রসারের ওপর ভর করে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনে বিশ্বের অন্য অনেক দেশের চেয়ে এগিয়ে থাকায় বাংলাদেশের অগ্রগতি নিয়ে আশাবাদী বিশ্বমহল। তবে এখানে ব্যবসা-বাণিজ্য, আমদানি-রপ্তানি, শিল্প ও সেবা খাতের ঈর্ষণীয় সাফল্য থাকলেও তাদের কাছ থেকে কাঙ্ক্ষিত রাজস্ব পাচ্ছে না এনবিআর। অথচ প্রতিবছরই বড় অঙ্কের রাজস্ব আয়ের লক্ষ্য ঠিক করা হয়। কয়েক বছর ধরে লক্ষ্য পূরণ দূরে থাক, বরং বড় অঙ্কের ঘাটতি নিয়ে শেষ হয় অর্থবছর।
সরকারের রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষার অংশ হিসেবে প্রতিবছরই বড় বাজেট দেওয়া হয়। তবে কাঙ্ক্ষিত রাজস্ব আয় না হওয়ায় শেষ পর্যন্ত উচ্চাভিলাষী বাজেটটি বাস্তবায়ন হয় না। এবারও সেই আশঙ্কাই করছেন বিশ্লেষকেরা। এমনিতেই সরকার দৈনন্দিন খরচ মেটানোর জন্য তহবিল-সংকটে রয়েছে। সামনে উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন ও এসব প্রকল্পে অর্থ বরাদ্দের তাগাদা আসবে। তখন সরকারের ওপর বাড়তি চাপ তৈরি হবে। এখনই অভ্যন্তরীণ খাতসহ উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে খরচ মেটাতে বাজেট সহায়তা নিতে হচ্ছে। সামনে এই চাহিদা আরও বাড়বে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
এ ব্যাপারে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, রাজস্ব আয়ে ঘাটতি পড়ছে বরাবরের মতো। সামনে উন্নয়ন প্রকল্পে বরাদ্দের চাপ বাড়বে। তখন সরকারের তহবিলের চাহিদা বাড়বে। এটা সরকারের ওপর চাপ তৈরি করবে।
তথ্য-উপাত্ত বলছে, অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে ছয় মাসে বার্ষিক লক্ষ্যমাত্রার মাত্র সাড়ে ৩৮ শতাংশ রাজস্ব আদায় হয়েছে। আর এ সময়ে ঘাটতি পড়েছে ২৩ হাজার ২২৭ কোটি টাকা। গত জুলাই-ডিসেম্বরে সব মিলিয়ে ১ লাখ ৬৫ হাজার ৬৩০ কোটি টাকার শুল্ক-কর আদায় হয়েছে। এই সময়ে সংস্থাটির রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য ছিল ১ লাখ ৮৮ হাজার ৮৫৬ কোটি টাকা। গত ৬ মাসে মাসওয়ারি হিসাবে গড়ে ২৭ হাজার ৬০৫ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় হয়েছে। চলতি অর্থবছরে সব মিলিয়ে ৪ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য দেওয়া হয়েছে এনবিআরকে।
বিশ্লেষকেরা মনে করেন, দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ভালো এবং বেসরকারি খাতের অগ্রগতিও সন্তোষজনক। কিন্তু এর প্রতিফলন নেই রাজস্ব আয়ে। দেশে একটি সক্ষম করদাতা শ্রেণি তৈরি হয়েছে—এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু এনবিআর এসব করদাতাকে খুঁজে বের করে তাঁদের কাছ থেকে কাঙ্ক্ষিত কর আদায়ে বিশেষ কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার খবর পাওয়া যায়নি। স্বাভাবিকভাবে যেভাবে কর আদায় হয়, ওইভাবে চলছে সংস্থাটির কার্যক্রম।