দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর অনেকটা হতাশায় ভুগছে বিএনপি ও অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা। এজন্য নেতাকর্মীদের সক্রিয় রাখার পথ খুঁজছে বিএনপি। এরই অংশ হিসেবে ফের লিফলেট বিতরণের কর্মসূচি পালনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে দলটি। আপাতত দুই অথবা তিন দিনের এই কর্মসূচি দেওয়ার কথা রয়েছে। পরে সমমনাদের সঙ্গে কথা বলে নতুন ধারাবাহিক কর্মসূচি ঠিক করবে। বৃহস্পতিবার স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এ কর্মসূচি চূড়ান্ত করা হয়। তা সফলে শুক্রবার সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব, সাংগঠনিক সম্পাদক, ঢাকা মহানগর ও অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে ভার্চুয়াল বৈঠক করে স্থায়ী কমিটির দুই সদস্য। সেই বৈঠকে শান্তিপূর্ণ এ কর্মসূচিতে সর্বোচ্চসংখ্যক নেতাকর্মীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে নানা নির্দেশনা দেওয়া হয়। একই সঙ্গে সারা দেশে সাংগঠনিক সফর ও রমজানের আগে ঢাকায় সমাবেশের কথাও প্রস্তাব করেন নেতারা। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে এসব তথ্য।
সূত্রমতে, স্থায়ী কমিটির বৈঠকে চলমান পরিস্থিতিতে আন্দোলন কর্মসূচি চালিয়ে নেওয়ার বিষয়ে একমত হন নেতারা। সেখানে সমাবেশ, সাংগঠনিক সফরসহ আরও কিছু কর্মসূচি প্রস্তাব করা হলেও সে বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। আপাতত লিফলেট বিতরণ করা হবে। এর মাধ্যমে নির্বাচন, দ্রব্যমূল্যসহ নানা ইস্যুতে সম্প্রতি ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের বক্তব্যের সারাংশ সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে চায় দলটি। সারা দেশের মহানগর, জেলা, উপজেলা, পৌর, ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড সব পর্যায়ে এই কর্মসূচি পালন করবে। আগামী ১২ অথবা ১৩ ফেব্রুয়ারি থেকে সারা দেশে দুই অথবা তিন দিনের এ কর্মসূচি পালনের কথা রয়েছে। যা দু-একদিনের মধ্যে ঘোষণা দেবে দলটি।
দলীয় সূত্র আরও জানায়, বিএনপি এখন বড় ধরনের কোনো কর্মসূচিতে যেতে চাইছে না। এজন্য ধীরনীতি অবলম্বন করছে দলটি। কারণ হিসাবে নেতারা জানান, সামনে ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হচ্ছে এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা, মার্চে পবিত্র রমজান শুরু, পরে ঈদুল ফিতর রয়েছে। এছাড়া বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ শীর্ষ নেতারা এখনো কারাগারে বন্দি। তাদের মুক্তির বিষয়টিকে এখন প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। এসএসসি পরীক্ষার ফাঁকে ফাঁকে কর্মসূচি পালন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে মার্চেই হচ্ছে ময়মনসিংহ সিটি নির্বাচন ও কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের মেয়র পদে উপনির্বাচন। মে মাসে হচ্ছে উপজেলা পরিষদ নির্বাচন। যদিও বর্তমান সরকার ও নির্বাচন কমিশনের (ইসি) অধীনে কোনো ভোটে অংশ না নেওয়ার সিদ্ধান্তে অটল বিএনপি। তাই এসব নির্বাচনের কথা ভাবছে না দলটি। সরকার পদত্যাগের একদফা আন্দোলনেই মনোযোগ তাদের। তবে প্রতীক ছাড়া দলের কেউ নির্বাচনে অংশ নিলে তাদের বিরুদ্ধে নমনীয় নাকি কঠোর হবে সে বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত এখনো নেয়নি। তৃণমূলের অনেকে ভোটে যেতে আগ্রহী বলে নীতিনির্ধারকদের জানিয়েছেন। সে বিবেচনায় স্বতন্ত্রভাবে কেউ অংশ নিলে তাদের বিরুদ্ধে দল নমনীয় হতে পারে। তবে এই সময়ে তারা মূলত নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ঊর্ধ্বগতি, মানুষের অভাব, নাগরিক হয়রানির ঘটনাসহ জনস্বার্থ গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে মাঠে থাকবে। একই সঙ্গে নতুন কোনো ঘটনা সামনে এলে তা নিয়ে তাৎক্ষণিক কর্মসূচিও দেওয়া হতে পারে।
জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, জনগণকে সঙ্গে নিয়ে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার প্রতিশ্রুতিতে আমরা চলমান আন্দোলনে আছি। আন্দোলনের গতি একেক সময় একেক রূপ নেয়। অপেক্ষা করুন, নিশ্চয়ই আন্দোলনে দেখতে পাবেন। তিনি আরও বলেন, বিএনপিসহ সমমনা ৬২টি রাজনৈতিক দলের ৭ জানুয়ারির ‘একতরফা’ নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত সঠিক ও যৌক্তিক ছিল। বিএনপির আবেদনে সাড়া দিয়ে, নির্বাচন বর্জন ও ফল প্রত্যাখ্যানের মাধ্যমে জনগণ প্রমাণ করেছে যে, বিএনপি ও যুগপৎ আন্দোলনের প্রতিটি রাজনৈতিক দলের অবস্থান গণআকাঙ্ক্ষারই প্রতিফলন। বিএনপির সঙ্গে একত্র হয়ে গণমানুষের এই নীরব প্রতিবাদ ও স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন সত্যিকার অর্থে বিএনপির রাজনীতির সফলতা তথা বিজয়ের বহিঃপ্রকাশ।
এদিকে দলটির একাধিক নেতা জানান, আন্দোলনের এই সময়ে আবার একটি ‘বিশেষ সিন্ডিকেট’ অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের কমিটি ভেঙে দেওয়ার ষড়যন্ত্রে নেমেছে। এ তিন সংগঠনের শীর্ষ নেতাদের নামে নানা অপ্রচারও চালাচ্ছেন তারা। সংগঠনের মেয়াদ শেষ হলে নতুন কমিটি হবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল, যুবদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলের কমিটির মেয়াদ এখনো রয়েছে। যদিও এ নিয়ে এখন পর্যন্ত স্থায়ী কমিটি বা কোনো ফোরামের বৈঠকে কোনো আলোচনা হয়নি। নেতারা জানান, মেয়াদ শেষের আগেই কমিটি ভাঙলে তা হবে আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। কেননা চলমান আন্দোলনে মূল দল বিএনপির চেয়ে এসব অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের সারা দেশে ভূমিকা ছিল চোখে পড়ার মতো। এখন কমিটি ভাঙলে তাদের ভূমিকাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হবে। এতে মনোবল হারাবে নেতাকর্মীরা। যার প্রভাব পড়তে পারে সামনের আন্দোলনে। কেননা পুনর্গঠনে হাত দিলে নেতাকর্মীরা আন্দোলনমুখী না হয়ে সেদিকে মনোযোগ থাকবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে ওই বিশেষ সিন্ডিকেটের কী উদ্দেশ্যে বা কাদের এজেন্ডা বাস্তবায়নে এসব করছেন তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন নেতারা। এ নিয়ে অঙ্গসংগঠনে ক্ষোভ বিরাজ করছে।
নেতারা আরও জানান, নির্বাচন শেষ হলেও নেতাকর্মীরা এখনো আশাবাদী বর্তমান সরকার মেয়াদ পূর্ণ করতে পারবে না। আন্দোলন চলতে থাকলে আগামী ছয় মাস বা এক বছরের মধ্যে ফলাফলও ঘরে আনা সম্ভব। সেক্ষেত্রে অন্যদিকে মনোযোগ দেওয়ার অর্থ হলো আন্দোলনকে ভেস্তে দেওয়া। অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিশেষ করে যুবদল, ছাত্রদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলের বর্তমান কমিটি সিন্ডিকেটমুক্ত। কারণ এসব কমিটি সরাসরি ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করেছেন। সেজন্য নেতারা তার নির্দেশ মতোই সব কাজ করছে। কিন্তু এখন নিজেদের হাতে এসব কমিটি নেওয়ার জন্য ওই সিন্ডিকেট উঠেপড়ে লেগেছে। বাস্তবতা হলো অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরাই সারা দেশে মূলত আন্দোলন জোরদার করেছে, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের নানা নির্দেশনা তৃণমূলে পৌঁছে দিয়েছে। আর সিন্ডিকেটের উদ্দেশ্য হলো-সংগঠন দুর্বল করা, যাতে পদ বাণিজ্য করতে সুবিধা হয়।
ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক সাইফ মাহমুদ জুয়েল যুগান্তরকে বলেন, ছাত্রদল আন্দোলনে ছিল এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও ভোটাধিকার ফিরে না আসা পর্যন্ত আন্দোলনে থাকবে। চলমান আন্দোলনে সবচেয়ে বেশি ছাত্রদলের নেতাকর্মী কারান্তরীণ এবং নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়েছে। মামলা-হামলা, নির্যাতন সত্ত্বেও পিছপা হয়নি নেতাকর্মীরা। যে কোনো সংকটে দৃশ্যমান চিত্রে সবার সম্মুখভাবে দাঁড়িয়ে সর্বোচ্চ ভূমিকা রাখার ইতিহাস বা ঘটনা আমার রয়েছে। সংগঠন করি ওয়ার্ড ছাত্রদল থেকে। দলের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশে আন্দোলনে অবদান রাখার চেষ্টা করেছি এবং করছি।
তিনি আরও বলেন, কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক থাকাকালে জাতীয় প্রেস ক্লাবে যখন প্রথম প্রতিরোধ ছিল, সবার সামনে থেকে করেছি। ভেতরে যদি আবেগ না থাকে কেউ কিন্তু সবার সামনে থেকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যুদ্ধে অবতীর্ণ হবে না। কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক হিসাবে সামনে থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ সন্ত্রাসীদের প্রতিরোধ করেছি। ২৮ অক্টোবর ঢাকায় মহাসমাবেশের দিন গুলিবিদ্ধ হয়েছি, মাতুয়াইলে সম্মুখসারিতে ছিলাম। রাজপথে মিছিল করেছি, মশাল মিছিল করেছি, সারা দেশে নেতাকর্মীদের সংগঠিত করেছি। আন্দোলনের প্রথম ভাগ শেষে ইতোমধ্যে সারা দেশের জেলা মর্যাদার সব ইউনিটের সঙ্গে বৈঠক হয়েছে। তাদের সীমাবদ্ধগুলো বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার চেষ্টা করছি। ছাত্রদল শক্তিশালীই আছে এবং সরকারের পতন না হওয়া পর্যন্ত রাজপথের প্রতিটি কর্মসূচিতে সর্বশক্তি নিয়ে থাকবে।