০৬ অক্টোবর ২০২৪, রবিবার, ০৭:২৮:০০ অপরাহ্ন
বোরাক-সিটি করপোরেশন অসম চুক্তির অনুসন্ধানে দুদক
  • আপডেট করা হয়েছে : ১২-০২-২০২৪
বোরাক-সিটি করপোরেশন অসম চুক্তির অনুসন্ধানে দুদক

রাজধানীর বনানীতে সরকারি প্লটে ২৮তলা বিশিষ্ট ‘হোটেল শেরাটন’ নির্মাণে সরকারি স্বার্থ কতটা ক্ষুন্ন হয়েছে- সে বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। হাইকোর্টের নির্দেশনার আগেই অনুসন্ধানের এই সিদ্ধান্ত নেয় কমিশন। পরবর্তীতে যেহেতু এ বিষয়ে উচ্চ আদালত রুল জারি করেছেন, তাই আইনগত মতামতের জন্য দুদকের আইন শাখায় পাঠানো হয়েছে। মতামত পাওয়ামাত্র উপ-পরিচালকের নেতৃত্বে গঠিত টিম রেকর্ডপত্র সংগ্রহ শুরু করবে। তথ্য নির্ভরযোগ্য সূত্রের।


সূত্রটি জানায়, রাজধানীর অভিজাত এলাকা বনানীর ৪৪, কামাল আতাতুর্ক এভিনিউতে অবস্থিত ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৬০ কাঠার প্লটের ওপর ২৮ তলা ভবন নির্মাণ করে ‘বোরাক রিয়েল এস্টেট লিমিটেড’। সেখানে নির্মাণ করা হয়েছে পাঁচ তারকা হোটেল শেরাটন। ‘বোরাক রিয়েল এস্টেট’ ব্যবসায়ী নূর আলীর মালিকানাধীন ‘ইউনিক গ্রুপ’র একটি প্রতিষ্ঠান এটি। ২০০৬ সালে অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশনের সঙ্গে বোরাক রিয়েল এস্টেট প্রা:লি:’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক নূর আলীর সঙ্গে একটি চুক্তি হয়। চুক্তিতে বলা হয়, বনানী কাঁচাবাজারের পশ্চিম পাশে ও বনানী কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের উত্তর পাশে সিটি করপোরেশনের জমিতে ‘বনানী সুপার মার্কেট কাম হাউজিং কমপ্লেক্স’ নির্মাণ করা হবে। ভবনের ৩০ শতাংশ পাবে সিটি করপোরেশন, ৭০ শতাংশ নির্মাতা প্রতিষ্ঠান। ২০১৪ সালে ভবনটির নির্মাণ শেষ হয়। নির্মাণ শেষ হলেও সিটি করপোরেশনকে তার ন্যায্য হিস্যা বুঝিয়ে দিচ্ছিলো না ‘বোরাক রিয়েল এস্টেট’। গতবছর ১ জুন একটি জাতীয় দৈনিকে এ বিষয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ডিএনসিসি’র বরাত দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, বোরাক রিয়েল এস্টেটের সঙ্গে চুক্তি ছিল ১৪ তলা ভবন নির্মাণের। যার ৩০ শতাংশ পাবে সিটি করপোরেশন, বাকিটা বোরাক। সিটি করপোরেশনের হিসাব অনুযায়ী তাদের ভাগের সম্পদের মূল্য পায় ৫৫০ কোটি টাকা। কিন্তু সে হিস্যা গত প্রায় এক দশকেও বুঝে পায়নি সিটি করপোরেশন। উল্টো চুক্তির শর্ত লঙ্ঘন করে ১৪ তলার স্থলে ২৮ তলা ভবন নির্মাণ করে পুরোটাই নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রেখেছে বোরাক।


প্রতিবেদনটি যুক্ত করে ঘটনা অনুসন্ধানের নির্দেশনা চেয়ে গতবছর ১১ জুন রিট করেন ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন। শুনানিতে তিনি বলেন, ২০০৬ সালে চুক্তি হয়, ২০১০ সালে সেটি হস্তান্তর হওয়ার করার কথা ছিল। কিন্তু গত ১৪ বছর ধরে বোরাক রিয়েল এস্টেট শেরাটন হোটেলের মত একটি আন্তর্জাতিক মানের হোটেল তারা নিয়ে এসেছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত একটি টাকাও সিটি করপোরেশন বুঝে পায় নি। তিনি বলেন, সিটি করপোরেশন কিভাবে একটি বেসরকারি রিয়েল এস্টেটের মালিককে রাষ্ট্রের সম্পত্তির ৭০ ভাগ মালিকানা দিয়ে দিলো-এটি আমার বোধগম্য নয়। এমন অসম চুক্তি হতে পারে না।


প্রকাশিত প্রতিবেদন তুলে ধরে ব্যারিস্টার সুমন বলেন, আমার মনে হয় নূর আলীর মতো ব্যক্তির মুখোমুখি হবার মত শক্তি আমাদের সিটি করপোরেশনের নেই। নতুন বাজেটে যাদের শুধু টিআইএন নম্বর আছে তাদেরকেও ২ হাজার টাকা কর ধার্য করা হয়েছে। এই বিষয়ে আমি কিছু বলবো না। আমদের কষ্ট করে হলেও এই টাকা আমরা হয়তো দেবো, কিন্তু সেখানে ১৪ বছর ধরে কোটি কোটি টাকা পড়ে আছে আপনারা সেখানে কিছুই বলবেন না? এ কারণে আমার মনে হয়েছে একজন বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে আমার এ অভিযোগটি করা উচিৎ।


রিটে স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব, রাজউক, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন এবং বোরাক রিয়েল এস্টেট লি;কে বিবাদী করা হয়। শুনানিকালে বিচারপতি মো: নজরুল ইসলাম তালুকদার এবং বিচারপতি খিজির হায়াতের ডিভিশন বেঞ্চ প্রশ্ন রেখে বলেন, ২১ তলা ভবনের অনুমতি নিয়ে ২৮ তলা কীভাবে নির্মাণ করা হলো ? শুনানি শেষে ওই বছর ৯ অক্টোবর আদালত ভবনটির ২১ তলা থেকে ২৮ তলা পর্যন্ত কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না-এই মর্মে রুল জারি করেন। রুল নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত ভবনের ওপর স্থিতাদেশ (স্ট্যাটাসকো) দেন।


সংশ্লিষ্ট বিবাদীরা ওই বছর আগস্টে রুলের জবাব দাখিল করেন। বোরাক রিয়েল এস্টেট রুলের জবাবে জানায়, বোরাক রিয়েল এস্টেট লিমিটেড কর্তৃপক্ষের বৈধ কাগজপত্র রয়েছে। সিটি করপোরেশন থেকে এপ্রোভাল। পুরো বিল্ডিংটি একটি বৈধ বিল্ডিং। কোটি কোটি টাকা লস করেছি, ব্যাংক থেকে লোন নিয়েছি। যেহেতু সিটি করপোরেশেন গ্রহণ করছে না, তাই তারা রিভিনিউ লস করছে, এতে সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। রুলের চূড়ান্ত শুনানি শেষে গতবছর ২৯ আগস্ট আদালত সিটি করপোরেশনের জমির ওপর বোরাক রিয়েল এস্টেট লিমিটেডের নির্মিত বহুতল ভবন শেরাটন হোটেলের ২১ থেকে ২৮ তলার বণ্টনের চুক্তি চূড়ান্ত করার নির্দেশ দেন। পরে ডিএনসিসি ও বোরাক রিয়েল এস্টেটের সঙ্গে একটি সমঝোতা হয়। সে অনুযায়ী বোরাক রিয়েল এস্টেট ডিএনসিসিকে ৩০ শতাংশের স্থলে ৪০ শতাংশ বুঝিয়ে দেয়ার চুক্তি চূড়ান্ত হয়।


গত মধ্য নভেম্বর বোরাক রিয়েল এস্টেট এক বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, ডিএনসিসি কার্যালয়ে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের পক্ষে মেয়র মো: আতিকুল ইসলাম ও বোরাক রিয়েল এস্টেটের পক্ষে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহা: নূর আলী সমঝোতা চুক্তিতে সই করেছেন। এর মাধ্যমে হোটেল শেরাটনের অংশীদারত্ব বুঝে নিয়েছে দুই পক্ষ।


নতুন সমঝোতা চুক্তি অনুযায়ী ভবনের ২০ তলা পর্যন্ত হিস্যার প্রায় ৫শ’ কোটি টাকার সম্পদ ও রাজস্ব বুঝে নেয় ডিএনসিসি। এর ফলে হোটেল শেরাটন পূর্ণাঙ্গভাবে চালুর আইনগত বাঁধা অপসারিত হয়েছে বলে দাবি করা হয় বিজ্ঞপ্তিতে।


উচ্চ আদালতের হস্তক্ষেপে বোরাক রিয়েল এস্টেট এবং ডিএনসিসি’র মধ্যকার বিরোধের আপাত: নিষ্পত্তি হয়েছে মর্মে দাবি করা যায়। কিন্তু যে প্রশ্নের মীমাংসা হয়নি সেটি হচ্ছে, রাষ্ট্রের সম্পত্তি হস্তান্তর নিয়ে অসম চুক্তি। বনানীর মতো অভিজাত এলাকার জমি অত্যন্ত মূল্যবান। সেক্ষেত্রে সরকার পাচ্ছে ৩০% এবং ডেভলপার পাবে ৭০%। যেকোনো হিসেবে এটি একটি অস্বচ্ছ এবং অসম চুক্তি। এ ক্ষেত্রে দুর্নীতি হয়েছে-এমন অভিযোগ তোলেন রিটকারী। চুক্তি প্রক্রিয়ার সঙ্গে যারা সংশ্লিষ্ট ছিলেন তারা ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হয়েছেন-এমন বিবেচনা থেকে বিষয়টি অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয় দুদক। অনুসন্ধান কোন পর্যায়ে রয়েছে-জানতে চাওয়া হলে নাম প্রকাশে আপত্তি জানিয়ে দুদকের একজন পরিচালক (বিশেষ) জানান, প্রতিবেদন প্রকাশের পরপরই কমিশন বিষয়িিট অনুসন্ধানের জন্য হাতে নেয়। অনুসন্ধানের জন্য একটি টিমও গঠন করা হয়। টিম কার্যক্রম শুরুর পরপরই এলো উচ্চ আদালতের রুল ও নির্দেশনা। এ কারণে আইনগত বিষয়ে মতামত নিতে টিম বিষয়টি লিগ্যাল শাখায় পাঠিয়েছে। মতামত পাওয়ামাত্র পরবর্তী পদক্ষেপ নেবে দুদক।


শেয়ার করুন