রাজধানীর বেইলি রোডের ভবনে অগ্নি নির্গমন পথ (ফায়ার এক্সিট) না থাকায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন, ‘আমরা অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্রের ব্যবস্থা করেছি, তবুও মানুষ এতটা সচেতন নয়। আপনি একটি বহুতল ভবনে আগুন দেখেছেন, যার কোনো অগ্নি নির্গমন পথ ব্যবস্থা নেই।’
‘জাতীয় বিমা দিবস-২০২৪’ উদযাপন উপলক্ষ্যে শুক্রবার রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে আয়োজিত অনুষ্ঠানে সরকারপ্রধান এসব কথা বলেন।
বৃহস্পতিবার রাত ৯টা ৫০ মিনিটে রাজধানীর বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজ ভবনে আগুন লাগার সংবাদ পায় ফায়ার সার্ভিস। এরপর ঘটনাস্থলে ফায়ার সার্ভিসের ১৩টি ইউনিটের চেষ্টায় রাত ১১টা ৫০ মিনিটে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত ৪৬ জনের মৃত্যু হয়েছে।
এই অগ্নিকাণ্ডের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বহুতল ভবন হলেও সেখানে কোনো অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা ছিল না। ভবন বা স্থাপনা তৈরির সময় তিনি সব সময় স্থাপত্যবিদদের অনুরোধ করেন যেন খোলা বারান্দা বা ভেন্টিলেশন এবং অগ্নিনির্বাপণের ব্যবস্থা রাখা হয়।
সরকারপ্রধান বলেন, ‘কিন্তু স্থাপত্যবিদেরা সেভাবে নকশা করেন না, আবার মালিকেরা এক ইঞ্চি জায়গা ছাড়তে চায় না। ৪৬ জন মানুষ মারা গেছে। এর চেয়ে দুঃখ ও কষ্টের আর কী হতে পারে! অথচ আমরা ফায়ার এক্সটিংগুইসার লাগানোসহ অগ্নিনির্বাপণ পথের ব্যবস্থা রাখার নির্দেশ বারবার দিচ্ছি। সেটা কিন্তু তারা মানে না।’
শেখ হাসিনা অভিমত ব্যক্ত করেন যে, ‘দেখা যাবে এখানে কোনো বিমাও করা ছিল না। কাজেই বিনিময়ে কিছু পাবেও না। এই সব ক্ষেত্রে সচেতনতা আসলে খুব বেশি প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে আরও ব্যাপকভাবে যাতে মানুষ সচেতন হয়, সেই জন্য আপনারা (বিমাসংশ্লিষ্ট মহল) চেষ্টা করবেন, আমাদের তরফ থেকে আমরা করে যাচ্ছি।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ যাতে আরও বিমার দিকে এগিয়ে আসে, সে বিষয়ে আপনারা আরও যত্নবান হবেন, যাতে বিমা দাবিগুলো মানুষ সহজে পেতে পারে।’
সরকারপ্রধান বলেন, ‘যারা অসদুপায় অবলম্বনকারী, তাদের কথা আমি বলছি না। প্রকৃতপক্ষে যাদের প্রাপ্য, তারা যেন সহজে পেতে পারে, এদিকে একটু দৃষ্টি দিতে হবে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সবাইকে সচেতন করতে বাংলাদেশ ইনস্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশন ও বিমা নিয়ন্ত্রণ সংস্থা আইডিআরএ-কে আরও জোরাল ভূমিকা রাখার আহ্বান জানাচ্ছি।’
প্রধানমন্ত্রী বিমার দাবি মেটানোর ক্ষেত্রে সচেতন হওয়ার পরামর্শ দিয়ে কোনো একটি তৈরি পোশাক কারখানায় ঘন ঘন আগুন লাগার কারণ খতিয়ে দেখতে গিয়ে একটি ভয়াবহ চিত্র দেখতে পান বলে জানান। যেখানে প্রায় একটি পরিত্যক্ত জায়গায় কিছু মালপত্র, বর্জ্য রেখে ওই কোম্পানির এক শ্রমিককে ২০ হাজার টাকা দিয়ে সেখানে আগুন লাগিয়ে ৪০ কোটি টাকা বিমা দাবি করা হয়েছিল। এ ক্ষেত্রে অনেক সময় বিমা কোম্পানির লোকজন যারা তদন্তে যান, তাদেরও ‘ম্যানেজ’ করার অভিযোগ রয়েছে উল্লেখ করে তিনি যথাযথ তদন্ত করে অর্থছাড় করারও পরামর্শ দেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আপনারা যারা বিমার সঙ্গে জড়িত, অবশ্যই তাঁরা এই বিষয়টাতে গুরুত্ব দেবেন। আর এই ধরনের ঘটনা যেন কেউ আর ঘটাতে না পারেন।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা ও মাথাপিছু আয় বেড়েছে। বছর বছর দেশের কিছু অঞ্চলে যে মঙ্গা বা দুর্ভিক্ষ হতো, সেটা আর নেই এবং মানুষের জীবন মানও অনেক উন্নত হয়েছে।
’৯৬ সালে প্রথমবার সরকারে আসার পরেই বেসরকারি খাতকে গুরুত্ব দিয়ে তা উন্মুক্ত করে দেন উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, তার সরকার চায় দেশ আরও এগিয়ে যাক। তিনি বলেন, ‘এই জন্য আমরা ব্যাংক, বিমা, বিদ্যুৎসহ সবকিছুই বেসরকারি খাতে উন্মুক্ত করে দিয়েছি। সে ক্ষেত্রেও আমি মনে করি ইনস্যুরেন্স করার ক্ষেত্রে মানুষের মাঝে আরও সচেতনতা সৃষ্টি করা অত্যন্ত জরুরি।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, তার সরকার বেসরকারি খাতকে উন্মুক্ত করে দেওয়ায় একের পর এক যখন ব্যাংক প্রতিষ্ঠার অনুমতি প্রদান করেছিল, তখন অনেক আন্তর্জাতিক সংস্থা (উন্নয়ন সহযোগী) প্রশ্ন তুলেছিল বাংলাদেশের অর্থনীতি এত ছোট, এতগুলো ব্যাংক দিয়ে কী হবে? তিনি বলেন, ‘আমার উত্তর ছিল আমাদের অর্থনীতি এত ছোট থাকবে না, অবশ্যই বড় হবে। সেই বড় তো আমরা করতে পেরেছি।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অগ্নিঝরা মার্চের প্রথম দিনটিতে শুরুতেই বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব, মুক্তিযুদ্ধের ৩০ লাখ শহিদ এবং সম্ভ্রমহারা দুই লাখ মা-বোন এবং জাতীয় চার নেতাসহ ’৭৫-এর ১৫ আগস্টের শহীদদের শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন।
অনুষ্ঠানে ব্যাংকের মাধ্যমে বিমা, অর্থাৎ ব্যাংকের গ্রাহকেরা প্রয়োজন অনুযায়ী ব্যাংক থেকেই যাতে বিমা পলিসি নিতে পারেন, সেই জন্য প্রধানমন্ত্রী অনুষ্ঠানে ‘ব্যাংকাস্যুরেন্স’-এর উদ্বোধন করেন।
প্রধানমন্ত্রী অনুষ্ঠানে জাতীয় বিমা দিবস-২০২৪ উপলক্ষে বিমা দাবি পরিশোধের ভিত্তিতে চারটি প্রতিষ্ঠানকে সম্মাননা স্মারক প্রদান করেন। তিনি দিবসটি উপলক্ষে স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে আয়োজিত রচনা প্রতিযোগিতায় বিজয়ীদের মধ্যেও পুরস্কার বিতরণ করেন।
অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন। স্বাগত বক্তৃতা করেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব শেখ মোহাম্মদ সলীম উল্লাহ। বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) চেয়ারম্যান মোহাম্মদ জয়নুল বারী ও বাংলাদেশ ইনস্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিআইএ) সভাপতি শেখ কবির হোসেন ও অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন। অনুষ্ঠানে বিমা শিল্পের ওপর এবং ‘ব্যাংকাস্যুরেন্স’-এর ওপর নির্মিত পৃথক দুটি প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শন করা হয়।