২২ নভেম্বর ২০২৪, শুক্রবার, ১২:১০:৫৬ পূর্বাহ্ন
পুষ্টিকর খাবার পায় না দেশের সাড়ে ১২ কোটি মানুষ
  • আপডেট করা হয়েছে : ১৭-০৩-২০২৪
পুষ্টিকর খাবার পায় না দেশের সাড়ে ১২ কোটি মানুষ

পণ্যের উচ্চমূল্যের কারণে দেশের ১২ কোটি ৫২ লাখ মানুষ প্রয়োজনীয় পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ করতে পারছেন না। এটি ২০২১ সালের হিসাব। বর্তমানে এই সংখ্যা আরও বেড়েছে। বিশ্বব্যাংকের রিপোর্টের উদ্ধৃতি দিয়ে এ তথ্য জানিয়েছে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। সংস্থাটি আরও জানায়, চলতি বছরে রাজস্ব আয় লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৮২ হাজার কোটি টাকা ঘাটতি থাকতে পারে। 


শনিবার সিপিডির নিজস্ব কার্যালয়ে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট নিয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলা হয়। অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন। এছাড়াও বক্তব্য রাখেন প্রতিষ্ঠানটির বিশেষ ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান এবং গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম প্রমুখ। অনুষ্ঠানে জানানো হয়, প্রতিবারের মতো আগামী অর্থবছরেও সরকার একটি গতানুগতিক বাজেট দিতে যাচ্ছে। 


কিন্তু অর্থনীতিকে মূলধারায় ফিরিয়ে আনতে হলে বাজেটে কাঠামোগত সংস্কার ও মন্ত্রণালয়ের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। ইতোমধ্যে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা হারিয়ে ফেলেছে। তাই আগামী বাজেটে মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা পুনরুদ্ধার, রাজস্ব আয় বাড়ানো, সরকারের ব্যয় নিয়ন্ত্রণ, বিভিন্ন খাতে শৃঙ্খলা ফেরাতে মধ্যমেয়াদি সংস্কার এবং সামাজিক নিরাপত্তায় গুরুত্ব আরও বাড়ানো।


মূল প্রবন্ধে উল্লেখ করা হয়, বিশ্বব্যাংকের প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউট এবং টুফটস ইউনিভার্সিটি ২০২১ সালে একটি রিপোর্ট তৈরি করেছে। ওই রিপোর্টে বলা হয়, বাংলাদেশের ১২ কোটি ৫২ লাখ মানুষ পণ্যের উচ্চমূল্যের কারণে প্রয়োজনীয় পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ করতে পারছে না। যা দেশের মোট জনসংখ্যার ৭৩ দশমিক ৯ শতাংশ। ২০২৪ সালে এই সংখ্যাটি আরও বিশাল হবে। সিপিডি বলছে, নানা কারণে খাদ্যের দাম বাড়ছে। 


এরমধ্যে রয়েছে-বাজারের বিভিন্ন কারসাজি, কিছু শক্তিশালী কোম্পানির বাজারে আধিপত্য এবং সরকারের প্রয়োজনীয় নিয়ন্ত্রণের অভাব। সাম্প্রতিক সময়ে বেশকিছু প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম অতিরিক্ত বেড়েছে। এরমধ্যে রয়েছে-মসুর ডাল, পেঁয়াজ, ছোলা, বেসন, ভোজ্যতেল, চিনি, আলু, মাংস, কাঁচামরিচ, চিড়া, মুড়ি, খেজুর এবং বেগুনসহ রমজানকেন্দ্রিক পণ্য। প্রতিবছরই রমজানে জিনিসপত্রের দাম নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকার উদ্যোগ নেয়। কিন্তু এখানে সফলতা খুব কমই আসে।


মূল প্রবন্ধে আরও বলা হয়, দেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বড় ধরনের চাপের মধ্যে রয়েছে। বিশেষ করে মূল্যস্ফীতির চাপে মানুষের জীবনযাত্রা সংকটে পড়েছে। এ পরিস্থিতিতে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা পুনরুদ্ধার করাই ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটের মূল উদ্দেশ্য হওয়া উচিত। সিপিডি বলেছে, ১০ থেকে ১১ বছর ধরে লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় রাজস্ব আহরণে বড় ঘাটতি থেকে যাচ্ছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরেও এই ঘাটতি থাকবে। বছর শেষে তা ৮২ হাজার কোটি টাকা হতে পারে। তারা আরও বলেছে, সরকারের বাজেট ঘাটতি কমেছে ঠিক, কিন্তু ঘাটতি নিরসনে বাণিজ্যিক ব্যাংকের ওপর সরকারের নির্ভরশীলতা বেড়েছে। বছরজুড়ে মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের উপরে। এছাড়া রপ্তানি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, প্রবাসী আয়, বিদেশি বিনিয়োগসহ বহিঃস্থ খাতের প্রায় সব সূচকে উদ্বেগজনক পরিস্থিতি বিরাজ করছে।


সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, অর্থনীতি এখন বিভিন্ন ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছে। এরমধ্যে রাজস্ব আহরণ ও বাজেট বাস্তবায়নে শ্লথগতি, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, ব্যাংকে তারল্যের সংকট, রপ্তানি, প্রবাসী আয় এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাচ্ছে। এমন বাস্তবতায় আগামী বাজেট প্রণয়নে তিনটি বিষয়কে মূল লক্ষ্য নির্ধারণের পরামর্শ দিয়েছে সিপিডি। প্রথমত, সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা পুনরুদ্ধার ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে সুরক্ষা দেওয়া, দ্বিতীয়ত, রাজস্ব আহরণ বাড়াতে উদ্যোগ নেওয়া, যাতে ব্যাংকের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে রাজস্ব আয় থেকে প্রয়োজনীয় ব্যয় করা যায় এবং তৃতীয়ত, দক্ষতার সঙ্গে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সরকারি ব্যয় করা, যাতে অর্থের অপচয় না হয়।


ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, নির্বাচনি ইশতেহারে মূল্যস্ফীতি কমানো ছিল সরকারের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য। তা বাস্তবায়নে সরকার কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু কেউ বাজারকে বিভিন্নভাবে প্রভাবিত করে সাত দিনে ৫০ কোটি টাকা লাভ করতে পারলে ৫০ লাখ বা ১ কোটি টাকা জরিমানা করে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনা যাবে না। সেজন্য দরকার বিদ্যমান আইনের কঠোর প্রয়োগ এবং তা দৃশ্যমান হতে হবে। 


এক প্রশ্নের উত্তরে মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, সম্প্রতি দুটি ব্যাংকের একীভূত হওয়ার ঘটনা ইতিবাচক। ব্যাংকগুলো দুর্বল হওয়ার পেছনে বাস্তব কারণ ছিল। দেশের অর্থনৈতিক বাস্তবতায় চতুর্থ প্রজন্মের এতগুলো ব্যাংকের প্রয়োজন ছিল কিনা, সেটা একটা প্রশ্ন। এছাড়া ব্যাংকগুলোয় সুশাসনের অভাব ছিল দৃশ্যমান। যেসব কারণে ব্যাংকগুলো দুর্বল হয়েছে, সেসব কারণগুলো আমলেও নেওয়ার উদ্যোগ নিতে হবে। সেটা না করে শুধু একীভূত করা হলে কার্যকর কিছু হবে না। আরেক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, বর্তমানে সরকার যে টাকা রাজস্ব আয় করছে, রাজস্ব ব্যয় তার প্রায় সমান। অর্থাৎ বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বা উন্নয়নে যে টাকা ব্যয় করা হয়, পুরোটাই ঋণ নির্ভর। এটি কোনো ভালো পদক্ষেপ নয়। ফলে আয় বাড়াতে হবে।


ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, সরকারের এই মেয়াদে প্রথম বাজেট এটি। এছাড়াও অর্থ মন্ত্রণালয় নতুন নেতৃত্ব এসেছে। ফলে বর্তমান বাস্তবতার নিরিখে নতুন অর্থবছরের বাজেট প্রণয়ন করতে হবে। চলতি অর্থবছরের বাজেটের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণে ওই সময়ে বাস্তবতাকে আমলে নেওয়া হয়নি। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটের মূল্য উদ্দেশ্য হওয়া উচিত বর্তমান চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করে সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা পুনরুদ্ধার করা। সেজন্য প্রয়োজনীয় মধ্যমেয়াদি সংস্কার করতে হবে। 


তিনি বলেন, অর্থবছরের প্রথম ৬ মাসে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির বাস্তবায়ন হয়েছে ২৫ দশমিক ৫ শতাংশ। আগের বছরের একই সময়ে যা ছিল ২৭ দশমিক ২ শতাংশ। যদিও গত অর্থবছরেও ৬ মাসে বাজেট বাস্তবায়ন ছিল। এ বছর তা আরও কমেছে। আর সরকারকে সহায়তা দিতে গিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে অস্বাভাবিকভাবে টাকা ছাপাতে হয়েছে। তিনি আরও বলেন, প্রবাসী আয় এবং রপ্তানিসহ বিভিন্ন খাতে সহায়তা দিচ্ছে সরকার। কিন্তু এতে খুব বেশি লাভ হচ্ছে না। ফলে সহায়তার বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করা উচিত।


ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, সরকারের রাজস্ব আয় বাড়াতে হবে। পাশাপাশি নিু আয়ের মানুষকেও স্বস্তি দিতে হবে। এক্ষেত্রে বর্তমান কর কাঠামো পুনর্বিবেচনা করা উচিত। যেমন বর্তমানে করমুক্ত আয় সীমা ৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা। এরপর কারও আয় ১ লাখ হলে তাকে ৫ শতাংশ কর দিতে হয়। এক্ষেত্রে আয় ২ লাখ হলে ৫ শতাংশ কর নির্ধারণ করা উচিত। এছাড়াও সর্বোচ্চ আয়ের ব্যক্তির কর হার ২৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৩০ শতাংশ করা উচিত। এছাড়াও বর্তমানে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত এবং শেয়ারের বাইরে থাকা কোম্পানির করের ব্যবধান ৫ শতাংশ। এটি বাড়িয়ে সাড়ে ৭ শতাংশ করার প্রস্তাব দিয়েছে সিপিডি। 


সংস্থাটির মতে, শেয়ারবাজারের বাইরে থাকা কোম্পানির কর সাড়ে ৭ শতাংশ বেশি হওয়া উচিত। না হলে কোম্পানিগুলো বাজারে আসতে চাইবে না। এছাড়াও ইংলিশ মিডিয়ামের শিক্ষার্থীদের ওপর থেকে কর প্রত্যাহার এবং মোটরসাইকেলের মালিকদের ওপর কর আরোপের প্রস্তাব করে সিপিডি। এক্ষেত্রে ১০০ সিসি পর্যন্ত মোটরসাইকেলের কর দেড় হাজার টাকা, ১০১ থেকে ১৫০ সিসি ৩ হাজার এবং ১৫০ সিসির উপরে মোটরসাইকেলের জন্য ৫ হাজার টাকা অগ্রীম আয়করের প্রস্তাব করা হয়।


ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, নতুন সরকারের প্রথম ১০০ দিনে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের জন্য লক্ষ্যভিত্তিক যে কর্মচাঞ্চল্য থাকা প্রয়োজন ছিল, তা দেখা যায়নি। সংস্কার কোথায় দরকার, তা বহুবার বলা হয়েছে। এখন বাজেটে তার প্রতিফলন প্রয়োজন। এছাড়া সংসদে বাজেট আলোচনায় সংসদ-সদস্যদের আরও সক্রিয় অংশগ্রহণ জরুরি। এছাড়াও আগে বাজেট বাস্তবায়নের অগ্রগতি প্রতি ৩ মাস পরপর অর্থমন্ত্রী সংসদকে জানাতেন। বর্তমানে এটি বন্ধ রয়েছে। এটি আবারও চালু করা উচিত।


শেয়ার করুন