বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের (বিকেবি) সঙ্গে রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংককে (রাকাব) একীভূত করার সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ সবাই। রাকাবের কর্মকর্তা, অর্থনীতিবিদ ও রাজশাহীর বিশিষ্টজনেরা বলছেন, আসছে জুনেই মুনাফার স্বপ্ন দেখা রাকাবকে ডুবতে বসা বিকেবির সঙ্গে একীভূত করলে লাভের চেয়ে ক্ষতিই হবে বেশি।
এতে রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের কৃষকেরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। যে কোন সমস্যায় পড়লে তারা আর রাজশাহীতেই ব্যাংকের প্রধান কার্যালয় পাবেন না। যেতে হবে ঢাকায়। এতে কৃষকের ভোগান্তিও বাড়বে। ব্যাংকিং ব্যবস্থায় তারা আগ্রহ হারাবেন।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, রাষ্ট্রপতির এক আদেশে ১৯৭৩ সালে বিকেবি প্রতিষ্ঠিত হয়। বিশেষায়িত এ ব্যাংকটি প্রতিষ্ঠিত হয় কৃষির উন্নয়নে ঋণ দেয়ার জন্য। কিন্তু ২০১০ সালের পর থেকে বিকেবি বড় ঋণ দেওয়ার মাধ্যমে বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু করে। ফলে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ বেড়ে যায়। আর্থিকভাবে নাজুক হয়ে পড়ে ব্যাংকটি। তার আগে ১৯৮৬ সালে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক ভেঙেই রাকাব প্রতিষ্ঠা হয়।
ওই সময় রাজশাহী ও রংপুর বিভাগে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের যেসব শাখা ছিল সেগুলোকে রাকাবকে দেওয়া হয়। এখন আবার রাকাবকে বিকেবির সঙ্গে একীভূত করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এ নিয়ে গত ৩ এপ্রিল গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার দুই ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (এমডি) সঙ্গে বৈঠক করেন। দ্রুতই এ বিষয়ে একটি সমঝোতা স্মারক সই হতে পারে।
এই সিদ্ধান্তের বিপক্ষে ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছেন রাকাবের বিভাগীয় নিরীক্ষা কার্যালয়ের সহকারী মহাব্যবস্থাপক মোস্তাফিজুর রহমান সরকার। তিনি লিখেছেন, ‘এর আগেও তিনবার রাকাবকে বিকেবির সঙ্গে একীভূত করার উদ্যোগ নিয়ে সে প্রক্রিয়া স্থগিত করা হয়েছে ক্ষতির কথা বিবেচনা করে। এত বড় একটা সিদ্ধান্ত আরও সময় নিয়ে নেওয়া উচিত। আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষা, সম্ভাব্যতা যাচাই করা দরকার। যদি এমন হতো বড়টির (বিকেবি) অবস্থা তুলনামূলক ভালো, তো হয়তো একটা আশা থাকতো। সেটি (বিকেবি) তো প্রায়ই ডুবেই গেছে। বরং রাকাব বর্তমানে অনেক ভালো অবস্থায় আছে। আশা করি, অনেক সমস্যা তৈরির আগে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আরও সময় নেবেন। তাতেই উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের কৃষি, কৃষক, উৎপাদন স্থিতিশিলতা এবং রাকাব সংশ্লিষ্ট সকলের জন্য মঙ্গল।’
রাকাবের কর্মকর্তারা বলছেন, রাকাবই এখন দেশের একমাত্র ব্যাংক যারা কৃষকের দোরগোড়ায় সেবা পৌঁছে দেয়। রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের ১৬টি জেলায় এখন এর শাখা রয়েছে ৩৮৩টি। কোন কোন ইউনিয়নে দুটি করেও শাখা আছে। শতভাগ শাখায় অনলাইন ব্যাংকিং ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে। ব্যাংকটির সাড়ে ৩ হাজার কর্মীর বড় অংশই বয়সে তরুণ।
ব্যাংকের আইসিটি বিভাগও অনেক বেশি শক্তিশালী। এখন ‘রাকাব লেন্স’ নামের মোবাইল অ্যাপ দিয়ে রাকাবের একটি দক্ষ টিম সবগুলো শাখার কার্যক্রম সার্বক্ষণিক মনিটরিং করে। সামগ্রিক তথ্য দেওয়ার পাশাপাশি প্রত্যেক শাখার ঋণ বিতরণ, আদায়, মুনাফা অর্জনসহ যাবতীয় তথ্য তাৎক্ষণিকভাবে এই অ্যাপসের মাধ্যমে পাওয়া যায়। কোথাও কোন দুর্বলতা দেখলে তাৎক্ষণিকভাবে দিকনির্দেশনা দেওয়া যায়। বিকেবি এসব সিস্টেমের অনেক দূরে। বিকেবির সঙ্গে রাকাবকে একীভূত করলে রাকাব ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বিকেবির পরিশোধিত মূলধন ৯০০ কোটি টাকা। ১ হাজার ৩৮টি শাখায় গ্রাহকের আমানত রয়েছে ৪০ হাজার ৭১৯ কোটি টাকা। এই আমানত থেকে ৩২ হাজার ৪৮ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করা হয়েছে। এর মধ্যে ৬ হাজার ৫০০ কোটি টাকা খেলাপি হয়ে গেছে, যা মোট ঋণের ২০ শতাংশ। গত বছর পর্যন্ত মূলধন ঘাটতির পরিমাণ ১৬ হাজার ৭১৯ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। পুঞ্জীভূত লোকসানের পরিমাণ ১৫ হাজার ২১৫ কোটি টাকায় পৌঁছেছে।
এদিকে রাকাবের পরিশোধিত মূলধন ৮২৪ কোটি টাকা। এই ব্যাংকে কৃষকের আমানতের পরিমাণ ৬ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। তবে ব্যাংকটি ৭ হাজার ৪৭৮ কোটি টাকা ঋণ দিয়ে বসে আছে। এর মধ্যে ১ হাজার ৫৩৪ কোটি টাকা খেলাপি হয়েছে। খেলাপি ঋণের হার ২১ দশমিক ৩৭ শতাংশ। ব্যাংকটি ২ হাজার ৪৭২ কোটি টাকা মূলধন ঘাটতিতে রয়েছে। তবে রাকাব কর্মকর্তারা আশা করছেন, আগামী জুন থেকেই ব্যাংকটির মুনাফায় ফিরবে। এখন কোন দুর্বলতা থাকলে কঠোর মনিটরিংয়ের মাধ্যমে ব্যাংকটিকে আরও শক্তিশালী করা উচিত। কিন্তু বিকেবির সঙ্গে একীভূত করার বিপক্ষে মত তাদের।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. ইলিয়াছ হোসেন বলছেন, ‘রাকাব ও বিকেবিকে একীভূত করলে ম্যানেজমেন্ট শক্তিশালী হতে পারে। কিন্তু এর নেতিবাচক দিকগুলোই বেশি। এর ফলে উত্তরবঙ্গের অর্থনীতি অনেকটা পিছিয়ে পড়বে। দুটি ব্যাংক একীভূত হলে বিকেবির উপকার হতে পারে, কিন্তু উত্তরবঙ্গের যে কৃষি এবং কৃষির বিভিন্ন উপখাতগুলো রাকাব থেকে সহযোগিতা পেয়ে থাকে সেগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’
রাকাবকে একীভূত করার সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানিয়ে ফেসবুকে সতর্ক করে পোস্ট দিয়েছেন সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) জেলা সভাপতি আহমেদ সফিউদ্দিন। তিনি লেখেন, ‘সাবধান! উত্তরের প্রাণ রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংককে আবার ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা চলছে।’
রাকাবের এমডি নিরঞ্জন চন্দ্র দেবনাথ বলেন, ‘রাকাব ও বিকেবির পারফরমেন্স নিয়ে গভর্নর স্যার মিটিং করেছেন। পত্রিকায় এসেছে যে দুটি ব্যাংক একীভূত হচ্ছে। এটা নিয়ে আমরা আনুষ্ঠানিক কোন চিঠি পাইনি। কবে সমঝোতা স্মারক সই হবে সেটাও জানি না। দুই বোর্ডের সিদ্ধান্ত না হলে হবে না। এই প্রক্রিয়াটা লম্বা হবে। তবে প্রক্রিয়ার কার্যক্রম শুরুর ব্যাপারে সমঝোতা হতে পারে।’