আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল (আইএমএফ) বলেছে, বৈশ্বিক মন্দা ও করোনা মহামারির প্রভাবে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বহুমুখী ধাক্কা লেগেছে। এ ধাক্কা মোকাবিলা করে অর্থনীতি পুনরুদ্ধার করতে সরকার কঠোর নীতি গ্রহণ করেছে, যা আইএমএফ সমর্থন করছে। এ নীতি গ্রহণের পরও দেশে ডলারের বিপরীতে টাকার বিনিময় হার ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ পরিস্থিতিতে তেমন উন্নতি হয়নি।
তবে তারা ডলারের বিপরীতে টাকার বিনিময় হারকে আরও নমনীয় করার পরামর্শ দিয়েছে। অর্থাৎ আইএমএফ টাকার বিপরীতে ডলারের দাম আরও বাড়নোর পরামর্শ দিয়েছে।
বৃহস্পতিবার আইএমএফ-এর এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের পরিচালক কৃষ্ণা শ্রীনিবাসন অনলাইন সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ প্রসঙ্গে এসব কথা বলেছেন। সম্প্রতি প্রকাশিত আইএমএফ-এর ‘ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুক, এপ্রিল ২০২৪’ শীর্ষক প্রতিবেদনের ওপর ওয়াশিংটন থেকে তিনি ওই সংবাদ সম্মেলন করেন।
তিনি বলেন, এ অঞ্চলের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও বৈশ্বিক মন্দা আঘাত হেনেছে, এ ধাক্কা ছিল বহুবিধ। করোনা মহামারির পর অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের আগেই ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হয়। এতে পুনরুদ্ধার কার্যক্রম আরও বাধাগ্রস্ত হয়। ইউক্রেনের যুদ্ধকে কেন্দ্র করে ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা বিশ্বব্যাপী পণ্যের সরবরাহব্যবস্থায় বিঘ্ন ঘটায়। এতে পণ্যের দাম বেড়ে যায়, যা বৈশ্বিক সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতাকে হুমকির মুখে ফেলে। বৈশ্বিক অনিশ্চয়তা আরও বাড়িয়ে দেয়। এ পরিস্থিতি থেকে বাংলাদেশের উত্তরণ ঘটাতে আইএমএফ ও বাংলাদেশ একটি কর্মসূচিতে ঐকমত্য হয়, যা এখনো চলমান। এর আলোকে অর্থনীতিতে বিদ্যমান চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করতে সরকার কঠোর আর্থিক নীতি গ্রহণ করে। এর মাধ্যমে আমদানি নিয়ন্ত্রণ করা হয়। ডলারের বিপরীতে টাকার বিনিময় হারকে নমনীয় করা হয়। মূল্যস্ফীতির হার নিয়ন্ত্রণে টাকার প্রবাহ কমানো হয়। এর মধ্য দিয়ে দেশটি সামষ্টিক অর্থনৈতিক সমন্বয় শুরু করেছে। যার লক্ষ্য অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করা।
তিনি আরও বলেন, এটি সত্য যে, কঠোর নীতি গ্রহণের পরও ডলারের বিপরীতে টাকার বিনিময় হার ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ পরিস্থিতিতে তেমন একটা উন্নত হয়নি।
এ প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, এর পেছনে অন্যতম একটি কারণ ছিল বাংলাদেশের গত জাতীয় নির্বাচন। যখন কোনো দেশে নির্বাচন হয়, তখন ওই দেশের সম্ভাবনা সম্পর্কে কিছু অনিশ্চয়তা থাকে। এতে বৈদেশিক মুদ্রার আর্থিক হিসাবের একটি অংশ নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত হয়।
শ্রীনিবাসন আরও বলেন, বাংলাদেশের জন্য ডলারের বিপরীতে টাকার আরও নমনীয় বিনিময় হার নীতি চালু করা অপরিহার্য। অর্থাৎ টাকার বিপরীতে ডলারের দাম আরও বাড়ানো উচিত। এতে দেশে ডলারের প্রবাহ বাড়বে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়বে।
সূত্র জানায়, আইএমএফ-এর ঋণের অন্যতম শর্ত হচ্ছে মূল্যস্ফীতির হার নিয়ন্ত্রণে মুদ্রানীতির ব্যবহার করতে হবে। অর্থাৎ সুদহার বাড়াতে হবে। কমাতে হবে টাকার প্রবাহ। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ নীতি অনুসরণ করার পরও মূল্যস্ফীতির হার সামান্য কমে আবার বাড়তে শুরু করেছে। মূল্যস্ফীতি ডাবল ডিজিটের কাছাকাছি থেকে গত ডিসেম্বরে সামান্য কমে ৯ দশমিক ৪৮ শতাংশে নামে। এরপর তা আবার বাড়তে থাকে। মার্চে তা বেড়ে ৯ দশমিক ৬৯ শতাংশে উঠেছে।
আমদানিতে কঠোর নিয়ন্ত্রণের ফলে আমদানি কমেছে, আমদানিনির্ভর শিল্প মন্দায় আক্রান্ত হয়েছে। পণ্যের দাম বেড়েছে। তারপরও রিজার্ভ বাড়েনি। এখন নিট রিজার্ভ কমে ১৯৮৯ কোটি ডলারে নেমেছে।
তবে সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, আমদানি নিয়ন্ত্রণ না করলে এখন হয়তো কোনো রিজার্ভই থাকত না। আমদানি নিয়ন্ত্রণের কারণে ডলারের সাশ্রয় হয়েছে। এতে রিজার্ভ একটি মাত্রায় ধরে রাখা সম্ভব হয়েছে।
ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে ১১০ এবং বেসরকারি হিসাবে ১২০ থেকে ১২৪ টাকায় রয়েছে। এদিকে ডলারের প্রবাহ বাড়াতে আইএমএফ টাকার মান আরও কমানোর সুপারিশ করেছে। এতে ডলারের প্রবাহ বেড়ে রিজার্ভ বাড়বে বলে সংস্থাটি মনে করে। কিন্তু অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, এতে মূল্যস্ফীতির ওপর চাপ আরও বাড়বে।