চলতি বছরে তাপমাত্রা বৃদ্ধি, ব্যাপ্তি ও দীর্ঘ মেয়াদে স্থায়িত্বের নতুন রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে। সিলেট ও চট্টগ্রামের দু-একটি এলাকা ছাড়া সারা দেশের মানুষের ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে তীব্র দাবদাহ। টানা দাবদাহের এক মাস পূর্ণ হয়েছে গতকাল মঙ্গলবার।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের মতে, সারা দেশে তাপপ্রবাহের ব্যাপ্তি, তীব্রতা ও সময়কাল বিবেচনায় গত ৭৬ বছরের মধ্যে চলতি এপ্রিল মাস নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করেছে। এর আগে ১৯৯২ সালে ৩০ দিন তাপপ্রবাহ থাকলেও তা শুধু দেশের পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোর মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। এ বছর সারা দেশেই তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে গেছে। মঙ্গলবার দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে যশোরে ৪৩.৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এরপরই চুয়াডাঙ্গায় ৪৩.৭ ডিগ্রি রেকর্ড করা হয়।
চলমান তাপপ্রবাহে বাতাসে জলীয়বাষ্পের আধিক্য ছিল। এ কারণে মানুষের কষ্ট বেশি হয়েছে। প্রচণ্ড গরম সইতে না পেরে হিট স্ট্রোকে অনেক মানুষের মৃত্যু হয়েছে। গতকালও দেশের সাত জেলায় আটজন হিট স্ট্রোকে মারা গেছেন। তাদের বেশিরভাগ রোদে বাইরে কাজ করার সময় অসুস্থ হয়ে মারা যান। এদিন গাজীপুরের কালীগঞ্জে গরমে রেললাইন বাঁকা হয়ে যায়। অল্পের জন্য দুর্ঘটনার হাত থেকে রক্ষা পান কালনী এক্সপ্রেসের যাত্রীরা। এছাড়া প্রচণ্ড গরমের জন্য দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। যদিও আবহাওয়া অধিদপ্তরের আভাস, আজ থেকে গরমের তীব্রতা কিছুটা কমতে পারে। আগামী দু-একদিনে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বৃষ্টির পূর্বাভাস রয়েছে। যত বেশিদিন বৃষ্টি হবে, তাপমাত্রা তত কমতে থাকবে।
আবহাওয়াবিদ ড. মুহাম্মদ আবুল কালাম মল্লিক যুগান্তরকে বলেন, এবার টানা ৩০ দিন প্রায় সারা দেশেই তাপপ্রবাহ বয়ে গেছে। যা ৭৬ বছরের ইতিহাসে নতুন রেকর্ড। অতীতে সারা দেশে এভাবে তাপপ্রবাহ বয়ে যেতে দেখা যায়নি। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এর আগে ২০১০ সালে ২০ দিন টানা তাপপ্রবাহ ছিল রাজশাহীতে। আর ১৯৯২ সালে দেশের পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোতে ৩০ দিন তাপপ্রবাহ ছিল। কিন্তু এবার চট্টগ্রাম ও সিলেটের কিছু অংশ ছাড়া সারা দেশে টানা ৩০ দিন তাপপ্রবাহ ছিল। এপ্রিল মাসে স্বাভাবিক গড় তাপমাত্রার চেয়ে ২-৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি ছিল। তার মতে, চলতি মৌসুমে বৃষ্টিপাত না থাকায় তাপপ্রবাহের ব্যাপ্তি দীর্ঘকাল ছিল। বৃষ্টি হলে তাপমাত্রা কমে আসবে।
মঙ্গলবার দেশে সর্বোচ্চ ৪৩.৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে যশোরে। এর আগে ১৯৬৪ সালের এপ্রিল মাসে যশোরে ৪৪.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়। ওই হিসাবে ১৯৬৪ সালের পর এই প্রথম সর্বোচ্চ তাপমাত্রা দেখলেন যশোরবাসী। যদিও ২০০৯ সালে যশোরে ৪৩.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা ছিল। গতকাল তাপপ্রবাহের তীব্রতার দিক বিবেচনায় দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল চুয়াডাঙ্গা। গত ৩৯ বছরের রেকর্ড ভেঙে চুয়াডাঙ্গায় এ মৌসুমের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৪৩ দশমিক ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। চুয়াডাঙ্গায় ১৯৮৫ সালে আবহাওয়া অফিস স্থাপনের পর থেকে এটাই সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল।
আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, যশোর ও চুয়াডাঙ্গা ছাড়াও গতকাল কুষ্টিয়ায় ৪২.৫, পাবনা ৪৩.২, রাজশাহী ৪৩, বাগেরহাট ৪২.৩ ও সাতক্ষীরায় ৪২.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা ছিল। অর্থাৎ এসব জেলার ওপর দিয়ে অতি তীব্র দাবদাহ বয়ে গেছে। আর টাঙ্গাইল, ফরিদপুর, গোপালগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, সিরাজগঞ্জ, দিনাজপুর ও খুলনা জেলার ওপর দিয়ে তীব্র তাপপ্রবাহ ছিল। দেশের অন্য জেলাগুলোতে মৃদু থেকে মাঝারি তাপপ্রবাহ ছিল।
আবহাওয়া অধিদপ্তর আরও জানিয়েছে, আগামী বৃহস্পতিবার থেকে দেশের বিভিন্ন এলাকায় তাপমাত্রা কমার আভাস রয়েছে। এ কারণে সারা দেশে না হয়ে অঞ্চলভেদে জারি হবে নতুন হিট অ্যালার্ট।
আবহাওয়াবিদরা জানান, ১৯৭২ সালের ১৮ মে রাজশাহীতে সর্বোচ্চ ৪৫.১ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার রেকর্ড রয়েছে। এবার তাপমাত্রা পারদ ওই পর্যন্ত পৌঁছেনি। তবে চলতি বছরে তাপপ্রবাহের স্থায়িত্বকাল অনেক বেশি। এ কারণে মানুষের কষ্টের তীব্রতাও বেশি। এই সময়ে থেমে থেমে বৃষ্টি হলে মানুষের এত কষ্ট হতো না। টানা তাপপ্রবাহের কারণে সারা দেশেই মানুষের ওপর ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। হিট স্ট্রোকে মানুষের মৃত্যু বেড়েছে।
তাপমাত্রা আজ থেকে কমার আভাস: গতকাল সন্ধ্যা ৬টার পূর্বাভাসে আজ বুধবার দিনে কিছু কিছু জায়গায় তাপপ্রবাহ কমতে পারে। সারা দেশে তাপমাত্রা সামান্য হ্রাস পেতে পারে। দেশের পূর্বাঞ্চলে রাতের তাপমাত্রা সামান্য বাড়তে পারে।
সিলেট ও চট্টগ্রাম অঞ্চলের কিছু এলাকায় ঝড়ো হাওয়াসহ বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে। আগামীকাল বৃহস্পতিবার চট্টগ্রাম ও সিলেটের পাশাপাশি ঢাকা ও বরিশাল বিভাগের দু-এক জায়গায় ঝড়ো হাওয়াসহ বৃষ্টি হতে পারে। এতে বিরাজমান তাপপ্রবাহের তীব্রতা কমে আসতে পারে। দেশের পূর্বাঞ্চলে দিনের তাপমাত্রা ১-২ ডিগ্রি সেলসিয়াস কমতে পারে। পরের পাঁচ দিনে সারা দেশে বৃষ্টির পূর্বাভাস দিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।