পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর ঢাকা-বরিশাল নৌ-রুটে গড়ে শতকরা ৪০ থেকে ৫০ ভাগ যাত্রী কমলেও বিষয়টিকে স্বাভাবিক মনে করছেন লঞ্চ মালিকরা। তাদের মতে, ঈদের ১৫-২০ দিন আগ থেকে সবসময়ই যাত্রীর সংকট থাকে। পদ্মা সেতুর কারণে কিছুটা প্রভাব পড়েছে ঠিক, তবে যে হারে যাত্রী কমেছে তার কারণ সেতু নয়। শনিবার ঢাকায় অভ্যন্তরীণ নৌ চলাচল ও যাত্রী পরিবহণ সংস্থার কেন্দ্রীয় কমিটির সভা শেষে এমনটাই জানান লঞ্চ ব্যবসায়ীরা। বর্তমান পরিস্থিতিতে লঞ্চের ভাড়া কমবে কিনা জানতে চাইলে-স্পষ্ট উত্তর না।
সভা সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, পরিস্থিতি বুঝে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে মালিকদের। যাত্রী কম হলে কম আর বেশি হলে সরকারি রেটে ভাড়া আদায়ের অলিখিত অনুমতি দেওয়া হয়েছে সভায়। ৪ তলা বিশিষ্ট লঞ্চের ক্ষেত্রে ডেক শ্রেণিতে সর্বনিম্ন ২৫০ এবং ৩ তলা বিশিষ্ট লঞ্চের ক্ষেত্রে ৩শ টাকার কম নেওয়া যাবে না-এমনটাও বলা হয়েছে। নিজেদের সিদ্ধান্তে কেবিনের ভাড়াও কমিয়ে নিতে পারবেন মালিকরা। এছাড়া যাত্রীর চাপ বেশি থাকলে ৭ জুলাই বৃহস্পতিবার থেকে ঈদ স্পেশাল সার্ভিস চালানোর ব্যাপারেও সিদ্ধান্ত হয়েছে সভায়।
পদ্মা সেতু দিয়ে যানবাহন চলাচল শুরুর দিন থেকেই আশঙ্কাজনক হারে কমতে শুরু করে ঢাকা-বরিশাল রুটের লঞ্চ যাত্রী। স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় ৪০ থেকে ৫০ ভাগ পর্যন্ত যাত্রী হারায় লঞ্চগুলো। শুধু ঢাকা-বরিশালই নয়, রাজধানী থেকে দক্ষিণাঞ্চলগামী ৩২টি নৌ রুটের প্রায় সবগুলোতেই একই চিত্র। ডেক আর কেবিনের অর্ধেক খালি রেখেই চলতে হচ্ছে লঞ্চগুলোকে। বৃহস্পতিবার বরিশাল থেকে যে কটি লঞ্চ ঢাকার উদ্দেশে ছেড়ে গেছে সেগুলোর কেবিন যাত্রী হিসাবেও ধরা পড়ে বিষয়টি। ওইদিন বরিশাল থেকে ঢাকায় যাওয়া কুয়াকাটা-২ লঞ্চের ২৫০টি কেবিনের মধ্যে যাত্রী ছিল মাত্র ৭৮টিতে। এ্যাডভেঞ্চার-১’র ১৬৫টি কেবিনের মধ্যে ৯০টি ছিল খালি। একইভাবে পারাবত-১২ এবং সুন্দরবন-১১ লঞ্চও ঢাকা গেছে অর্ধেক কেবিন খালি নিয়ে। এসব লঞ্চের ডেকেও ছিল না তেমন যাত্রী। যদিও এই সংকটের জন্য পদ্মা সেতুকে দায়ী করতে নারাজ লঞ্চ মালিকরা। কেন্দ্রীয় লঞ্চ মালিক সমিতির সহ সভাপতি সুন্দরবন নেভিগেশনের মালিক সাঈদুর রহমান রিন্টু বলেন, ‘এটা ঠিক যে সেতু চালু হওয়ার পর অনেকেই এখন স্বপ্নের পদ্মা সেতু দেখতে সড়ক পথে ঢাকা যাচ্ছেন। মাত্র ৩ ঘণ্টায় বরিশাল থেকে ঢাকা যাওয়ার বিষয়টি তো আমরা কোনোদিন কল্পনাও করিনি। কিন্তু তাই বলে পদ্মা সেতুর কারণে এই যাত্রী সংকট তা ঠিক নয়। ফি বছরই ঈদের ১৫-২০ দিন আগে থেকে যাত্রী সংকটে ভুগি আমরা। এই সময়ে মানুষ খুব একটা লঞ্চে যাতায়াত করে না। সংকট-টা আবার কেটে যায় ঈদের ৪-৫ দিন আগে। লঞ্চে সারাবছরই যে ভরপুর যাত্রী চলাচল করে তাও ঠিক নয়। সিজনে যাত্রী বাড়ে আবার কমে। এটা ঠিক যে পদ্মা সেতুর কারণে যাত্রী কিছুটা কমেছে। তবে আমি মনে করি এটা সাময়িক।’
যাত্রী সংকটের কারণে লোকসানের মুখে পড়া লঞ্চগুলোতে যাত্রী টানতে এরইমধ্যে শুরু হয়েছে ভাড়া কমিয়ে নেওয়া। ডেক শ্রেণিতে সরকার নির্ধারিত ভাড়া যেখানে ৩৫৪ টাকা সেখানে পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর তা কমিয়ে দেড়শ থেকে ২৫০ টাকা পর্যন্ত নিচ্ছে লঞ্চগুলো। কেবিনের ক্ষেত্রেও ভাড়া কমেছে ৪শ থেকে ৬শ টাকা পর্যন্ত। টানা এক সপ্তাহ ধরে এভাবে কম ভাড়ায় যাত্রী টানার মধ্যেই শনিবার ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয় লঞ্চ মালিকদের কেন্দ্রীয় সংগঠন অভ্যন্তরীণ নৌ চলাচল ও যাত্রী পরিবহণ সংস্থার কেন্দ্রীয় কমিটির সভা। ধারণা করা হচ্ছিল প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে এই সভায় ঢাকা-বরিশালসহ বিভিন্ন রুটে লঞ্চ ভাড়া কমানোর সিদ্ধান্ত নেবেন মালিকরা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই সিদ্ধান্ত হয়নি সেখানে। সভায় সভাপতিত্ব করা মালিক সমিতির সিনিয়র সহ সভাপতি বদিউজ্জামান বাদল বলেন, ‘ভাড়া কমানোর প্রশ্নই আসে না। করোনা আমাদের কোমড় ভেঙে দিয়েছে। অন্য সব সেক্টরের শিল্প মালিকরা প্রণোদনা পেলেও আমরা পাইনি। তেলের দাম বাড়তি। বেড়েছে যন্ত্রাংশের মূল্যও। যে ভাড়ায় লঞ্চ চলছে তাতে টিকে থাকা মুশকিল। তার ওপর ভাড়া কমাতে গেলে মালিকরা দেউলিয়া হয়ে যাবে। সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছে তেমন কোনো পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে যা যা করা দরকার তাই করা হবে। যাত্রীসেবার মান বৃদ্ধি, কম সময়ে গন্তব্যে পৌঁছতে দ্রুতগামী লঞ্চের ব্যবস্থা এবং যাত্রীদের জন্য নানা সুযোগ-সুবিধার আয়োজন করা হবে। ঢাকা থেকে দক্ষিণাঞ্চলসহ মোট ৪২ রুটে ২শর মতো লঞ্চ চলাচল করে। সাময়িক যে সমস্যা তৈরি হয়েছে তা শুধু ঢাকা-বরিশালসহ ৩-৪টি রুটে। এই ৩-৪টি রুটের জন্য তো আর সারা দেশের রুটগুলোকে ঝুঁকির মুখে ফেলতে পারি না। প্রতিযোগিতাকে প্রতিযোগিতা দিয়ে মোকাবিলা করা হবে।’
ব্যবসায়ী নেতা বাদল এভাবে বললেও ভেতরের ভিন্ন কিছু খবর পাওয়া গেছে। পরিচয় গোপন রাখার শর্তে কয়েকজন মালিক বলেন, ‘সভায় যাত্রী সংকট ও ভাড়া কমানোর বিষয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়। পরে সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নেন যে, আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা দিয়ে ভাড়া কমানো ঠিক হবে না। ২-৩ মাস পর যদি পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যায় সেক্ষেত্রে তখন সরকার নির্ধারিত রেটে ভাড়া আদায় কঠিন হয়ে পড়বে। বর্তমান পরিস্থিতিতে টিকে থাকার জন্য মালিকরা চাইলে যাত্রীদের কাছ থেকে ভাড়া কমিয়ে নিতে পারবেন। এক্ষেত্রে যাতে অসুস্থ প্রতিযোগিতার সৃষ্টি না হয় সেজন্যে ডেক শ্রেণির ভাড়া ৩ তলা লঞ্চের ক্ষেত্রে ৩শ এবং ৪ তলা লঞ্চের ক্ষেত্রে ২৫০ টাকার কম নেওয়া যাবে না। কেবিনের ক্ষেত্রেও একইভাবে সিঙ্গেলের ক্ষেত্রে ১ হাজার এবং ডাবলের ক্ষেত্রে ২ হাজার টাকা সর্বনিম্ন নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। পদ্মা সেতু চালু হওয়ার আগে ঢাকা বরিশাল রুটে ডেকের ভাড়া ছিল ৩শ এবং কেবিনের ভাড়া যথাক্রমে ১২শ ও ২৪শ। সভায় উপস্থিত সুরভী নেভিগেশনের পরিচালক রেজিন উল কবির বলেন, ‘শুধু ঈদ-কুরবানি ছাড়া প্রায় কখনোই সরকারি রেটে ভাড়া আদায় করি না আমরা।
সবসময়ই কম ভাড়া নেওয়া হয় যাত্রীদের কাছ থেকে। সরকারি রেটের চেয়ে বেশি ভাড়া নেওয়ার ক্ষমতা না থাকলেও কম নেওয়ার ক্ষমতা রয়েছে মালিকদের। প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য যদি কেউ ভাড়া কমিয়ে নেন তাহলে তো কারও কিছু বলার নেই। সভায় এসব বিষয় নিয়েও আলোচনা হয়েছে। এখন পর্যন্ত যা সিদ্ধান্ত তাতে যাত্রী কম হলে ভাড়া কমিয়ে নিতে পারবে মালিকরা। বেশি হলে ভাড়া আদায় হবে সরকারি রেটে। যেমন ঈদের আগে-পরে সরকারি রেটেই ভাড়া নেব আমরা। যাত্রী কম হলে তখন আবার সে অনুযায়ী ব্যবস্থা।’
এফবিসিসিআই’র পরিচালক ও নিজাম শিপিং লাইন্স’র মালিক নিজামউদ্দিন বলেন, ‘মোট কথা আনুষ্ঠানিকভাবে ভাড়া কমাচ্ছি না আমরা। আমাদের বিশ্বাস পদ্মা সেতুর কারণে লঞ্চের যাত্রী তেমন একটা কমবে না। বর্তমানে যা হচ্ছে তা শুধুই সাময়িক। ১-২ মাস গেলেই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসবে। তারপরও যদি কঠিন কোনো সংকটের সৃষ্টি হয় সেটা তখন আবার দেখা যাবে।’