২১ নভেম্বর ২০২৪, বৃহস্পতিবার, ০৭:১৮:১৪ অপরাহ্ন
রাজশাহী সিটির উন্নয়ন প্রকল্পে কাজ ফেলে পালিয়েছে ঠিকাদাররা, থমকে আছে বহু প্রকল্প
  • আপডেট করা হয়েছে : ২১-১০-২০২৪
রাজশাহী সিটির উন্নয়ন প্রকল্পে কাজ ফেলে পালিয়েছে ঠিকাদাররা, থমকে আছে বহু প্রকল্প

রাজশাহী সিটি করপোরেশনে কাজ পাওয়া অনেক ঠিকাদার ৫ আগস্টের পর পালিয়ে গেছেন। এতে রাসিকের বহু উন্নয়ন প্রকল্প এখন প্রায় বন্ধ। ফেলে যাওয়া এসব কাজ এখন অন্য দলের লোকেরা হস্তগত করতে নগর ভবনে দৌড়ঝাঁপ করছেন। পলাতক দলীয় ঠিকাদাররাও তাদের কাজগুলো হস্তান্তর করে কাজ সম্পন্ন করার চেষ্টা করছেন। রাজশাহী সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা বলছেন, হাতবদল হয়েও যদি কাজগুলো সম্পন্ন করা যায়, সেটা করতে তাদের কোনো আপত্তি নেই। কাজ ও বিল হবে কার্যাদেশ পাওয়া ঠিকাদারদের নামেই। তবে মাঠে কারা কাজ করবেন, সেটা আমাদের দেখার বিষয় হবে না। ৫ আগস্টের আগে রাজশাহী সিটি করপোরেশনের উন্নয়নকাজের ৪৬টি প্যাকেজের দরপত্র হয়েছিল। এর মধ্যে মহানগর যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক তৌরিদ আল মাসুদ রনির মালিকানাধীন রিথিন এন্টারপ্রাইজ ও এআর কনস্ট্রাকশন সাতটি প্যাকেজের দরপত্র পেয়েছিল। এছাড়া কাশিয়াডাঙ্গার মোখলেসুর রহমান মুকুলের মুন এন্টারপ্রাইজ করছিলেন ছয়টি প্যাকেজের কাজ। যুবলীগ নেতা রনি আওয়ামী লীগের বিভিন্ন কর্মসূচিতে সামনে থাকতেন এবং টাকার জোগান দিতেন। ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার মিছিলে হামলার নেতৃত্বে ছিলেন রনি। ইতোমধ্যে তার নামে নগরীর বিভিন্ন থানায় দুটি হত্যাসহ একাধিক মামলা হয়েছে। যুবলীগ নেতা রনি ও মুকুলের পাওয়া ১১টি প্যাকেজের কাজ এখন বন্ধ।


রাজশাহী নগরীর বক্ষব্যাধি হাসপাতালের পুকুরের সৌন্দর্যবর্ধন ও প্রতিরক্ষা দেওয়াল নির্মাণে ১৩ কোটি ৪৯ লাখ টাকার কাজটি পেয়েছিল যুবলীগ নেতা রনির রিথিন এন্টারপ্রাইজ। এ প্যাকেজের ৭০ ভাগ কাজ সম্পন্ন দেখিয়ে রিথিনকে ইতোমধ্যে ৯ কোটি ৩৯ লাখ টাকার বিল পরিশোধ করা হয়েছে। নগরীর ধর্মসভা মন্দির ও ভবনের সৌন্দর্যবর্ধনের ১ কোটি ৫৯ লাখ টাকার কাজটিও রনি করছিলেন। ৮০ ভাগ কাজ সম্পন্নের কথা বলে তাকে ৮৭ লাখ টাকা বিল দেওয়া হয়েছে। রনির এই দুটি বড় কাজ এখন বন্ধ।


নগরীর রামচন্দ্রপুর এলাকার বিহারি পুকুর, টিকারপাড়া গোরস্তানের অভ্যন্তরে থাকা দুটি পুকুরের সৌন্দর্যবর্ধনের ৫ কোটি ৪২ লাখ টাকার কাজটিও রনিকে দেওয়া হয়েছিল। ৮৩ ভাগ কাজ হওয়ার কথা বলে জুনে তাকে ৩ কোটি ৭৯ লাখ টাকা বিল দেওয়া হয়েছে। এ কাজটিও বন্ধ। নগরীর আরও তিনটি ওয়ার্ড এলাকার সিসি সড়ক ও নর্দমা নির্মাণ প্যাকেজের ৫ কোটি ৬ লাখ টাকার কাজ রনির রিথিন এন্টারপ্রাইজ করছিলেন। এ কাজের বিপরীতে ২ কোটি ৪৮ লাখ টাকার বিল দেওয়া হয়েছে। রনি আত্মগোপনে যাওয়ার পর আর কাজ হয়নি।


এদিকে রনির আরেকটি প্রতিষ্ঠান এআর কনস্ট্রাকশন নগরীর ২৬ ও ২৭ নম্বর ওয়ার্ড এলাকার সড়ক ও ড্রেন নির্মাণ এবং নগরীর আরও ৬টি ওয়ার্ড এলাকার সড়ক, ফুটপাথ, সীমানাপ্রাচীর নির্মাণে ১৩ কোটি ৪৭ লাখ টাকার কাজ করছিল। এসব কাজের বিপরীতে জুনে রনিকে ৬ কোটি ৫ লাখ টাকার চলতি বিল পরিশোধ করা হয়েছে।


জানা যায়, রনির এআর কনস্ট্রাকশন ও এমএস আলাউদ্দিন ট্রেডার্স নামের প্রতিষ্ঠান দুটি যৌথভাবে নগরীর ছয়টি ঈদগাহ মাঠের সীমানাপ্রাচীর নির্মাণে ৩ কোটি ৩৬ লাখ টাকা কাজ করছিলেন। এ কাজের বিপরীতে ঠিকাদারদের ৩ কোটি ৩৬ লাখ টাকা বিল দেওয়া হয়েছে। এলাকাবাসী জানায়, নগরীর মতিহার থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এসএম আলাউদ্দিন রনি এআর কনস্ট্রাকশনের সঙ্গে যৌথভাবে কাজটি নিয়ে নিজেই করছিলেন। ৫ আগস্টের পর আওয়ামী লীগ নেতা আলাউদ্দিন পলাতক রয়েছেন।


অন্যদিকে নগরীর পদ্মা বাঁধের ওপর ১ কোটি ৬৬ লাখ টাকায় একটি ঝুলন্ত সেতু, সিঅ্যান্ডবি মোড়ে ৫ কোটি ২ লাখ টাকার বঙ্গবন্ধুর ম্যুরালের কাজ করছিলেন মুকুলের মুন এন্টারপ্রাইজ। এ দুটি কাজের জন্য মুকুলকে ৪ কোটি ২৯ লাখ অগ্রিম বিল পরিশোধ করা হয়েছে। রাজশাহী জজকোর্টের সীমানাপ্রাচীর, নর্দমা, কার্পেটিং সড়ক নির্মাণের ২ কোটি ৮৪ লাখ টাকার কাজটিও করছিলেন মুকুল। এ কাজের বিপরীতে মুকুলকে ১ কোটি ২১ লাখ টাকার বিল পরিশোধ করা হয়েছে।


অন্যদিকে নগরীর কেশবপুর দক্ষিণপাড়া, কোর্ট স্টেশন পূর্ব ও পশ্চিমের তিনটি জলাশয় সৌন্দর্যবর্ধনের ৬ কোটি ৩৪ লাখ টাকার কাজও মুকুল করছিলেন। জায়গা নিয়ে জটিলতা থাকায় কাজগুলো শুরু হলেও অগ্রগতি হয়নি। এর পরিবর্তে কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো উন্নয়ন ও বুলনপুরের পুকুর সংস্কারের কাজ করে মুকুল ৪ কোটি ৭২ লাখ টাকা বিল তুলেছেন। নগরীর ১৫ নম্বর ওয়ার্ডে সিসি সড়ক ও নর্দমা নির্মাণে ৪ কোটি ২৬ লাখ টাকার কাজের বিপরীতে মুকুল বিল তুলেছেন ৩ কোটি ৮০ লাখ টাকা। তবে কাজটির অর্ধেক এখনো বাকি। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সীমানাপ্রাচীর নির্মাণের ১১ কোটি ১৮ লাখ টাকার একটি বড় কাজ মুকুল করছিলেন। এ কাজের বিপরীতে তিনি ১ কোটি ২ লাখ টাকার বিল পেয়েছেন। আরেক আওয়ামী লীগ নেতা প্রতিষ্ঠান ডন এন্টারপ্রাইজ সড়ক ও ড্রেন নির্মাণে ৫ কোটি ৫০ লাখ টাকা কাজ করছিলেন। কাজটি এখন পর্যন্ত ৩৫ ভাগ বাস্তবায়ন হয়েছে। তবে এর বিপরীতে ডন এন্টারপ্রাইজকে ৩ কোটি ১৫ লাখ টাকা বিল পরিশোধ করা হয়েছে।


জানা যায়, নগরীর ১৬, ১৭ ও ২১ নম্বর ওয়ার্ডেও নর্দমা নির্মাণ করছিলেন আওয়ামী লীগ নেতা ফিরোজ কবীর মুক্তার প্রতিষ্ঠান সাবিনা এন্টারপ্রাইজ। ৪ কোটি ৩৮ লাখ টাকার কাজটি শুরু হলেও মাঝপাথে বন্ধ হয়েছে।


এছাড়া রূপপুরের কেলেঙ্কারির হোতা মজিদ সন্স রাজশাহী সিটি করপোরেশনে করছে ২১৫ কোটি টাকা কাজ। নগরীর বিলসিমলা ফ্লাইওভার নির্মাণে ৮৯ কোটি ৫৯ লাখ টাকার কাজের বিপরীতে ৮ কোটি ৩১ লাখ ৬৬ হাজার বিল তুলে নেওয়া হয়েছে। বন্ধ থাকার পর সম্প্রতি কাজটি শুরু হলেও চলছে ধীরগতিতে। নগরীর শালবাগান বাজার নির্মাণের ৪১ কোটি টাকার কাজটিও করছে মজিদ সন্স। তবে কাজটি শুরুর পরপরই ৫ কোটি ২৭ লাখ টাকা বিল পরিশোধ করা হয়েছে। এছাড়া ভদ্রা রেলগেটে কাঁচাবাজার নির্মাণে ৩৮ কোটি টাকার কাজটিও মজিদ সন্স পেয়েছে। এ কাজ শুরুই হয়নি।


মজিদ সন্সের রাজশাহীর প্রকল্প ম্যানেজার সারোয়ার জাহান বলেন, ভদ্রা কাঁচাবাজার কাজ করার অনুমতি পাওয়া যায়নি। শালবাগান কাঁচাবাজারে অর্ধেক কাজ হয়েছে। স্থানীয় ব্যবসায়ীদের আপত্তির কারণে কাজ এখন বন্ধ আছে। এখন শুধু ফ্লাইওভারের কাজটি আমাদের চলমান আছে।


রাজশাহী সিটি করপোরেশনের প্রকল্প পরিচালক মাহমুদুর রহমান বলেন, ৫ আগস্টের পর ঠিকাদার পলাতক থাকায় কিছু কাজ বন্ধ আছে। তবে তাদের পক্ষে এখন অন্যরা এসে পড়ে থাকা কাজ শেষ করতে চাচ্ছেন। যেই করুক তাতে রাসিকের আপত্তি নেই। কেউ যদি কাজ শেষ করতে না পারে, সেগুলো বাতিল করে নতুন করে দরপত্র আহ্বান করা হবে।


শেয়ার করুন