উৎক্ষপণের ছয় বছর পরও সম্ভাব্য বিদেশি গ্রাহক দেশগুলোর সঙ্গে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১-এর ফ্রিকোয়েন্সি সমন্বয় ও ল্যান্ডিং রাইটস পাওয়ার কাজটি সম্পন্ন হয়নি। এখন এর সময়ও শেষ। আবার এসংক্রান্ত প্রকল্প গ্রহণের সময় যেসব দেশে এর ট্রান্সপন্ডার বিক্রি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন সম্ভব বলে জানানো হয়েছিল, বাস্তবতা তার বিপরীত। রাশিয়াভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ইন্টারস্পুিনকের কাছ থেকে বহুগুণ বেশি দামে কেনা অবিবটাল স্লটের অবস্থান ওই দেশগুলোর বেশির ভাগে প্রযোজ্য নয়।
ফলে এই স্যাটেলাইটের ৪০টি ট্রান্সপন্ডারের মধ্যে কেইউ ব্যান্ডের ১৩টির কোনো গ্রাহক নেই। এ ছাড়া ‘বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট সিস্টেম বাস্তবায়ন’ শীর্ষক প্রকল্পের অবাস্তব ও অতিমূল্যায়িত ফিজিবিলিটি স্টাডির মাসুল দিতে হচ্ছে বাংলাদেশকে। ১৫ বছর মেয়াদের প্রায় তিন হাজার কোটি টাকার এই স্যাটেলাইট এখনো লাভের মুখ দেখেনি। বরং লোকসানের আশঙ্কাই বেশি।
সংশ্লিষ্টদের ধারণা, এই শ্বেতহস্তীর পালনে রাষ্ট্রের ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াতে পারে হাজার কোটি টাকারও বেশি। গত ২ অক্টোবর তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মো. নাহিদ ইসলাম বাংলাদেশ স্যাটেলাইট কম্পানি পরিদর্শনে গেলে কম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. জহিরুল ইসলাম তাঁকে বলেন, ‘স্যাটেলাইটের খরচ বেশি হয়েছে, তাই প্রাপ্তি আশানুরূপ নয়।’
২০১২ সালের ২৯ মার্চ বিটিআরসি এ বিষয়ে চুক্তিবদ্ধ পরামর্শক প্রতিষ্ঠান স্পেস পার্টনারশিপ ইন্টারন্যাশনালের (এসপিআই) মাধ্যমে জানিয়েছিল, এই স্যাটেলাইট উৎক্ষপণ করার পর বাংলাদেশ প্রতিবছর প্রায় ৫০ মিলিয়ন ডলার (বর্তমানে ৬০০ কোটি টাকা) আয় করতে পারবে। কিন্তু এখন মোট আয় হচ্ছে বছরে ১৫০ কোটি টাকার কাছাকাছি।
এর মধ্যে পরিচালন ব্যয় এবং সম্পদের স্থায়িত্বের বিপরীতে প্রতিবছর অবচয় বাদ দিলে লাভের ঘরে কিছুই থাকে না।
তথ্য-প্রযুক্তিবিদ সুমন আহমেদ সাবিরের মতে, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের জন্য যে বিনিয়োগ হয়েছে তা উঠে আসার সম্ভাবনা নেই। সঠিকভাবে বাজার যাচাই না করেই এ খাতে বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করা হয়েছে। শুরুতে মার্কেটিংয়ের দিকে সেভাবে নজর দেওয়া হয়নি। এ ছাড়া বর্তমান বিশ্বে যেভাবে স্যাটেলাইট ব্যান্ডউইডথের চাহিদা কমছে, তাতে বিক্রি না হওয়া ট্রান্সপন্ডারগুলো ভবিষ্যতে কাজে লাগবে বলে মনে হচ্ছে না।
এ বিষয়ে স্যাটেলাইটটির পরিচালনাকারী সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ স্যাটেলাইট কম্পানি লিমিটেডের (বিএসসিএল) একজন কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, প্রকল্পটি পাসের সময় যে ফিজিবিলিটি স্টাডি বা সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়েছিল তা ত্রুটিপূর্ণ ছিল। এতে বাজারের চাহিদা, প্রতিযোগিতা এবং রাজস্ব সম্ভাবনাকে অতি মূল্যায়ন করা হয়। এ ধরনের অতিমূল্যায়ন উদ্দেশ্যপ্রণোদিতও হতে পারে। এতে দেশের লাভ-ক্ষতি বিবেচনায় না নিয়ে হয়তো ব্যক্তি বা একটি চক্রের স্বার্থ প্রাধান্য পেয়েছে। এটি বেসরকারি খাতের কোনো প্রকল্প হলে সংশ্লিষ্ট সবার চাকরি যেত।
এ ছাড়া সংশ্লিষ্ট কয়েকজন কর্মকর্তার ধারণা, প্রকল্পে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান এসপিআইয়ের ‘আন্তর্জাতিক’ সাইনবোর্ড ব্যবহার করা হয়েছে। বাস্তবে পরামর্শক ছিলেন দেশের বৃহৎ একটি ব্যবসায়ী গ্রুপের সঙ্গে সম্পর্কিত এক ব্যক্তি, যিনি ওই প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গেও যুক্ত। তাঁর পেছনেও বিপুল অর্থ ব্যয় হয়েছে।
পরামর্শক প্রতিষ্ঠানটির কাজ ছিল, স্যাটেলাইট উৎক্ষপণের জন্য বাজার পর্যবেক্ষণ, ব্যাবসায়িক পরিকল্পনা, আইটিইউর সঙ্গে তরঙ্গ সমন্বয়, স্যাটেলাইট সার্ভিস ডিজাইন, স্যাটেলাইট আর্কিটেকচারাল ডিজাইন, সিস্টেম ডিজাইন, দরপত্র প্রস্তুত, ম্যানুফ্যাকচারিং ও সুষ্ঠুভাবে উৎক্ষপণ পর্যবেক্ষণ। কিন্তু ইন্টারস্পুটনিকের কাছ থেকে বড়জোর ছয় মিলিয়ন মার্কিন ডলারের ১১৯.১ ডিগ্রি পূর্ব দ্রাঘিমাংশে অরবিটাল স্লট ২৮ মিলিয়ন ডলারে কেনার ব্যবস্থা করলেও অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে পরামর্শ দিতে ব্যর্থ হয়েছে। প্রকল্প থেকে কম্পানির কাছে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়ার সময় অনেক কিছু হস্তান্তর করেনি। গ্রাউন্ড স্টেশনের কাছে ২০০ ফুট রাস্তাসহ আরো অনেক সুবিধা ডিপিপি অনুসারে কম্পানিকে দেওয়া হয়নি।