২৩ মে ২০২৫, শুক্রবার, ১০:৪৩:৪৯ অপরাহ্ন
বিএমডিএ চেয়ারম্যান ড. এম আসাদুজ্জামান আর নেই
  • আপডেট করা হয়েছে : ২৩-০৫-২০২৫
বিএমডিএ চেয়ারম্যান ড. এম আসাদুজ্জামান আর নেই

বরেন্দ্র বহুমুখি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিএমডিএ)-এর চেয়ারম্যান ড. এম আসাদুজ্জামান আর নেই। শুক্রবার (২৩ মে) সকাল ৯টা ৪০ মিনিটে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে তাকে মৃত ঘোষণা করা হয় (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর। তিনি স্ত্রী, এক ছেলে ও এক মেয়েসহ অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন।


ড. এম আসাদুজ্জামান বিএনপির সাবেক মন্ত্রী প্রয়াত ব্যারিস্টার আমিনুল হক ও সাবেক আইজিপি এনামুল হকের ভাই। রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার কেল্লাবারুই পাড়ায় ১৯৪৯ সালের ১ নভেম্বর সভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহন করে ড. আসাদুজ্জামান।



রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মৃখপাত্র ও জরুরী বিভাগের চিকিৎসক শংকর কে বিশ্বাস জানান, ড. এম আসাদুজ্জামান নগরীর উপশহরের নিজ বাসায় ছিলেন। সকালে তিনি অসুস্থ্য হয়ে পড়েন। সকল ৯টা ৪০ মিনিটে তাকে হাসপাতালের জরুরী বিভাগে নিয়ে আসা হয়। সেখানে পরীক্ষা-নিরিক্ষা শেষে তাকে মৃত ঘোষণা করা হয়েছে। হাসপাতালে পৌঁছার আগেই তিনি মারা যান।



ড. এম আসাদুজ্জামানের মৃত্যুতে বিএমডিএ কর্মকর্তারাসহ বিভিন্ন মহল থেকে শোক প্রকাশ করা হয়েছে। বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ এবং রাজশাহী চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রির পরিচালক সাইফুল ইসলাম হীরক এক শোক বার্তায় বলেছেন, আমরা তাঁর বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানাচ্ছি। আল্লাহ্‌ তাঁকে জান্নাতুল ফেরদাউস নসিব করুন।



বিএমডিএ পরিচালক সাইফুল ইসলাম হীরক বলেন, “ড. এম আসাদুজ্জামান একজন দক্ষ, সৎ ও উদ্ভাবনী চিন্তাধারার প্রশাসক ছিলেন। তাঁর মৃত্যুতে বরেন্দ্র অঞ্চলের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে অপূরণীয় ক্ষতি হলো।”



ড. আসাদুজ্জামানের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করে তাঁর বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানিয়েছেন রাজশাহী মহানগর বিএনপির সাবেক বন ও পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদক ও রাজশাহী-১ আসনে বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশী বিএনপি নেতা ইঞ্জিনিয়ার কে এম জুয়েল।



ড. আসাদুজ্জামান একজন বহুমাত্রিক শিক্ষাজীবনের অধিকারী। তিনি ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইরিগেশন ও ওয়াটার ম্যানেজমেন্ট-এ স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর ১৯৮৩ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন বিষয়ে এলএলবি ডিগ্রি লাভ করেন। কৃষির উপর গভীর গবেষণার উদ্দেশ্যে তিনি ১৯৯৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্যাসিফিক ওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটি থেকে কৃষি বিজ্ঞানে পিএইচডি সম্পন্ন করেন। পরবর্তীতে ২০০৭ সালে তিনি বিশ্বখ্যাত হাভার্ড বিজনেস স্কুল থেকে অ-লাভজনক প্রতিষ্ঠানের কৌশলগত ব্যবস্থাপনা বিষয়ে নির্বাহী শিক্ষা কোর্স সম্পন্ন করেন।


ড. আসাদুজ্জামান কর্মজীবন শুরু করেন একজন ইরিগেশন ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে। প্রযুক্তিগত জ্ঞান ও মাটির সাথে নিবিড় সম্পর্ক তাঁর পেশাজীবনকে ধাপে ধাপে শিখরে পৌঁছে দেয়। তিনি ১৯৯২, ১৯৯৬ এবং ২০০২, ২০০৬ এই দুই মেয়াদে বিএমডিএর নির্বাহী পরিচালক হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন এবং ২০০৭ সালে সরকারি চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন।



তারপরও থেমে থাকেননি তিনি। কৃষি ও পানি ব্যবস্থাপনায় বিশ্বব্যাংক, সিডা, ডিএফআইডি, ও এডিবি -এর পরামর্শক হিসেবে আন্তর্জাতিক প্রকল্পে কাজ করেন এবং নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে সরাসরি অবদান রাখেন।


ড. আসাদুজ্জামান ছিলেন একাধারে গবেষক, উদ্ভাবক ও প্রয়োগবাদী। তাঁর গবেষণার মূল ক্ষেত্র ছিল ভূগর্ভস্থ পানি, টিউবওয়েল ডিজাইন, সেচ ব্যবস্থাপনা ও খরচ পুনরুদ্ধার। তিনি উদ্ভাবন করেন ইনভার্টেড ওয়েল নামক এক বিশেষ ধরনের টিউবওয়েল প্রযুক্তি, যা অতি পাতলা অ্যাকুইফার অঞ্চলেও সফলভাবে পানি উত্তোলনে সক্ষম।


তাঁর আরেকটি যুগান্তকারী উদ্যোগ ছিল প্রিপেইড মিটার ও স্মার্ট কার্ডভিত্তিক সেচ খরচ পুনরুদ্ধার ব্যবস্থা চালু করা, যা বাংলাদেশের সেচ খাতে এক নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। এতে কৃষক স্বচ্ছ ও সাশ্রয়ী পদ্ধতিতে সেচ সুবিধা পেতে শুরু করে।


তাঁর নেতৃত্বে বরেন্দ্র অঞ্চলে বাস্তবায়িত প্রকল্পসমূহ কৃষি বিপ্লবের সূচনা করে। মরুপ্রায় বরেন্দ্র অঞ্চল আজ শস্যসমৃদ্ধ অঞ্চলে পরিণত হয়েছে, যা বরেন্দ্র মডেল নামে খ্যাত। এই মডেলটি বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলে বিস্তৃত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে এবং এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (ADB) তা নেপাল ও ভারতের মতো দেশেও প্রয়োগের কথা ভাবছে।


তাঁর অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে একাধিক সম্মাননা লাভ করেন। বরেন্দ্র অঞ্চলে কৃষিজ উৎপাদন বৃদ্ধি, টেকসই পানি ব্যবস্থাপনা এবং খননকৃত পুকুর ও জলাধার পুনঃউদ্ধার প্রকল্পে তিনি নেতৃত্ব দেন।


ড. আসাদুজ্জামান ছিলেন এক প্রজ্ঞাবান প্রযুক্তিবিদ, যিনি উদ্ভাবন, নেতৃত্ব ও মানবিক চিন্তাধারার সমন্বয়ে বাংলাদেশের কৃষি ও সেচ খাতে এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তাঁর অবদান দেশের জন্য এক স্থায়ী সম্পদ হয়ে থাকবে।


     

শেয়ার করুন