চলচ্চিত্র মানে চলমান চিত্র। তবে সেই চলচ্চিত্র যখন কোনো দেশের শিল্পমাধ্যমে পরিণত হয়, তখন কেবল দৃশ্যটা চলমান হলেই চলে না, সঙ্গে জড়িত থাকে আরো অনেক পক্ষ, হাজারো-লাখো মানুষ। সব পক্ষের চলমান তথা কার্যকর অবস্থাই প্রমাণ করে, চলচ্চিত্র শিল্প বেঁচে আছে। এখন প্রশ্ন, বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্প কেমন আছে? বেঁচে? কতখানি প্রাণ আছে তাতে? অনেক বছর ধরেই থেমে থেমে ভেসে আসে এমন বয়ান, ‘দেশের চলচ্চিত্র শিল্প খাদের কিনারায়’, ‘মুমূর্ষু অবস্থায় দেশের চলচ্চিত্র’ কিংবা ‘খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে ঢাকার চলচ্চিত্র’।
এসব ধারণা যে একেবারে অমূলক, তা-ও বলা যায় না। ঈদ ছাড়া ছবির বাণিজ্য বিস্মৃত হয়ে গেছে। আবার ঈদেও যেসব ছবি আসে, দু-একটি বাদে দর্শকের নাগাল পায় কটি? প্রশ্নগুলো যেমন সহজ, উত্তরও চলচ্চিত্রসংশ্লিষ্টদের জানা। জানে না হয়তো সরকার।
জানলে হালের অবস্থা কিঞ্চিৎ ব্যতিক্রম হতেই পারত। সিনেমা হলের সংখ্যা এমনিতে নেমে এসেছে অর্ধ শতে। তার মধ্যেই সম্প্রতি বেশ কয়েকটি বড় হল বন্ধের খবর এসেছে। আবার পুরান ঢাকায় নতুন সম্ভাবনা হয়ে কয়েক বছর আগে চালু হয়েছিল লায়ন সিনেমাস।
লোকসান গুনতে গুনতে তারাও এখন ‘ছেড়ে দে মা কেন্দে বাঁচি’ অবস্থায়। ভাবছেন বন্ধ করে দেওয়ার কথাও। বন্ধ হয়ে গেছে বগুড়ার একমাত্র আধুনিক থিয়েটার মধুবন সিনেপ্লেক্স। কার্যক্রম বন্ধ রেখেছে দেশের বৃহত্তম হল মণিহারও। এ ছাড়া আরো কয়েকটি জেলার ‘যক্ষের ধন’ প্রেক্ষাগৃহের দুয়ারেও ঝুলছে তালা।
এই যখন অবস্থা, তখন সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরে বিরাজ করছে নিশ্চিদ্র নীরবতা। সংকটের সমাধান দূর কি বাত, কোনো আশার বাণীও আসেনি বিবৃতি আকারে। বরং ঘোষিত কার্যক্রমেও দেখা যাচ্ছে স্থবিরতা।
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার কিছুদিন পরই জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ২০২৩-এর কমিটি গঠন করা হয়। এরপর কমিটির সদস্যপদেও হয়েছে রদবদল। শেষমেশ ছবি দেখা শেষে জুরি বোর্ড তাঁদের সুপারিশ চূড়ান্ত করে জমা দেয় মন্ত্রণালয়ে। এ বছরের এপ্রিলেই তা চূড়ান্ত হয়ে যায়। সে সময় ঘনিষ্ঠ সূত্রের বরাতে বিভিন্ন গণমাধ্যম প্রকাশ করেছিল, কারা পেতে যাচ্ছেন ২০২৩-এর জাতীয় পুরস্কার। আশায় শিনা চওড়া হয় সম্ভাব্য বিজয়ীদের। তখন তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়েছিল, শিগগিরই প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করা হবে। এরপর যথানিয়মে তা তুলে দেওয়া হবে ঘটা আয়োজনে। কিন্তু পাঁচ মাস পেরিয়ে গেলেও এখনো আসেনি প্রজ্ঞাপন, জানা যায়নি আসলে কারা পাবেন পুরস্কার। ঠিক কী কারণে জাতীয় পুরস্কারের প্রক্রিয়া থেমে আছে, তা নিয়ে ধোঁয়াশা অনেকের মনে। যখন সরকারের অন্যসব কার্যক্রম বহাল তবিয়তে চলছে, তখন কেবল চলচ্চিত্রের আয়োজন থমকে থাকা স্বাভাবিকভাবে নিচ্ছেন না অনেকে।
শুধুই কি পুরস্কার? না, ধীরলয়ের উদাহরণ আরো ঢের আছে। জুলাইয়ের পয়লা দিনে চলচ্চিত্রে অনুদানের ঘোষণা দেওয়া হয়। ছোট-বড় মিলিয়ে ৩২টি ছবিকে ১৩ কোটি টাকার অনুদান দেওয়া হবে। এরপর যথানিয়মে ছবিগুলোর প্রযোজক-নির্মাতাদের মঞ্জুরিপত্র দেওয়া হয়। কিন্তু অনুদানের প্রথম কিস্তিটা তাঁরা পেয়েছেন প্রায় তিন মাস পরে। ‘রুহের কাফেলা’র জন্য পূর্ণদৈর্ঘ্য বিভাগে অনুদান পেয়েছেন আহমেদ হাসান সানি। তিনি জানান, সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে তারা প্রথম কিস্তির টাকা পেয়েছেন। তাঁর ভাষ্য, ‘এত দিন অপেক্ষায় ছিলাম। কাজও শুরু করতে পারিনি। তবে টাকা পাওয়ার পরই আমরা পুরোদমে কাজ শুরু করে দিয়েছি। প্রি-প্রডাকশন চলছে। স্ক্রিপ্টের কাজও সম্পন্ন। এরপর কাজের অগ্রগতি অনুসারে ধাপে ধাপে বাকি কিস্তিগুলো পাওয়ার কথা।’
একই অবস্থা সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ‘রিমেম্বারিং মনস্যুন রেভল্যুশন’ শীর্ষক প্রকল্পেও। এ প্রকল্পের অধীনে আটটি বিভাগে চলচ্চিত্রবিষয়ক কর্মশালা হয়। পরিকল্পনা ছিল, কর্মশালার সঙ্গে আটটি ছবিও বানানো হবে। কিন্তু কর্মশালা সম্পন্ন হলেও ছবির খবর নেই। একটি সূত্রে জানা গেছে, কেবল একটি ছবি সম্পন্ন হয়েছে। বাকিগুলোর গল্প মন্ত্রণালয়ে জমা পড়ে আছে। কিন্তু নির্মাণের অনুমোদন আসছে না, তাই অনিশ্চয়তায় সেসব ছবির ভবিষ্যৎ।
এখানেই শেষ নয়, চলচ্চিত্রের উন্নয়নের জন্য একটি পরামর্শক কমিটি গঠন করে সরকার। সেটাও গত বছরের অক্টোবরের কথা। এক বছর হয়ে গেলেও সেই কমিটির দৃশ্যমান কোনো কার্যক্রম দেখা যায়নি, পাওয়া যায়নি উল্লেখযোগ্য কোনো খবরও। প্রতি মাসে বৈঠক হওয়ার কথা থাকলেও এখনো পর্যন্ত বৈঠক হয়েছে মাত্র দুটি। ফলে চলচ্চিত্রের উন্নয়নে আলোচনা কিংবা বুদ্ধি-পরামর্শের প্রশ্নই তো অবান্তর!
আমাদের কাজ হলো ছবিগুলো দেখে সুপারিশ জানানো। সেটা রোজার ঈদের পরপরই [এপ্রিলের প্রথমাংশে] আমরা জানিয়েছি। এরপর সে সুপারিশ মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া হয়েছে কি না, প্রজ্ঞাপন কবে আসবে কিংবা পুরস্কার কবে দেওয়া হবে, এসব আমাদের সিদ্ধান্তেও হয় না, জানারও কথা না। আমরা নিজেদের কাজটুকু ঠিকভাবে করেছি। বাকিটা মন্ত্রণালয় জানে।
দেশে সবচেয়ে অবহেলিত সেক্টর চলচ্চিত্র। লোক দেখানো আয়োজন, ড্রোন শো কত কিছুর জন্য ফান্ড থাকে, চলচ্চিত্র পুরস্কারের ফান্ড নেই। নিজেদের গঠন করা জুরি বোর্ডের বিচারও তারা মানতে পারছে না! আবার শুনছি ২০২৩-২৪ সালের পুরস্কার একসঙ্গে দেওয়া হবে। কেন? জাতীয় পুরস্কার তো স্রেফ কিছু টাকা আর একটা ট্রফি না। এটা জাতির সামনে একটা স্বীকৃতি। তাদের কাছে এটা জাস্ট একটা ইভেন্ট। এখন তো দেশ শিল্প বন্ধ্যাত্বের দিকে ঢুকে পড়েছে। শিল্প-সংস্কৃতি থাকবে না। এখন বড় বিনোদন রেস্টুরেন্টে খাওয়া। খেলাধুলা নেই, সংগীত-নৃত্য চর্চা নেই, শুধু আছে খাওয়া। খাচ্ছে আর রোগ-ব্যাধি বানাচ্ছে। যাইহোক, পুরস্কারের বিষয়ে আমার ধারণা, জুরিবোর্ড যে তালিকা করেছে, শেষ পর্যন্ত তা থাকবে না।