 
                         
                    
                                            
                        
                             
                        
শেখ হাসিনার শাসনামলে গুম-অপহরণের ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের দুই মামলায় পরোয়ানাভুক্ত ১৩ সেনা কর্মকর্তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। একই সঙ্গে জুলাই অভ্যুত্থানের সময় রাজধানীর রামপুরা এলাকায় ২৮ জনকে গুলি করে হত্যার ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের আরেক মামলায় আরো দুই সেনা কর্মকর্তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেওয়া হয়। অর্থাৎ মানবতাবিরোধী অপরাধের তিন মামলায় ১৫ জন সেনা কর্মকর্তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেওয়া হয়েছে।
চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন ট্রাইব্যুনাল-১ গতকাল বুধবার সকাল ৮টার দিকে এ আদেশ দেন।
গুম-অপহরণের পর র্যাবের টাস্কফোর্স ইন্টারোগেশন (টিএফআই) সেলে আটকে রেখে নির্যাতনের মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক প্রতিরক্ষাবিষয়ক উপদেষ্টা তারিক আহমেদ সিদ্দিকসহ মোট আসামি ১৭ জন। এই মামলায় যে ১০ জনকে কারাগারে পাঠনো হয়েছে, তাঁরা হলেন—র্যাবের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপস) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. জাহাঙ্গীর আলম, সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপস) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল তোফায়েল মোস্তফা সারোয়ার, সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপস) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. কামরুল হাসান, সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপস) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাহাবুব আলম, সাবেক পরিচালক (ইন্টেলিজেন্স উইং) লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. মশিউর রহমান জুয়েল, সাবেক পরিচালক (ইন্টেলিজেন্স উইং) লেফটেন্যান্ট কর্নেল সাইফুল ইসলাম সুমন, সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপস) কর্নেল আবদুল্লাহ আল মোমেন, সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপস) কর্নেল আনোয়ার লতিফ খান (অবসর প্রস্তুতিমূলক ছুটিতে), সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপস) কর্নেল কে এম আজাদ ও সাবেক পরিচালক (ইন্টেলিজেন্স উইং) কর্নেল মো. সারওয়ার বিন কাশেম।
শেখ হাসিনা ও তারিক আহমেদ সিদ্দিকসহ অন্য সাতজন আসামি পলাতক। পলাতকদের মধ্যে অন্য পাঁচ আসামি হলেন—সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক পুলিশপ্রধান (আইজিপি) বেনজীর আহমেদ, সাবেক পুলিশপ্রধান ও র্যাবের সাবেক মহাপরিচালক এম খুরশীদ হোসেন, র্যাবের সাবেক মহাপরিচালক মো. হারুন-অর-রশিদ, র্যাবের সাবেক পরিচালক (ইন্টেলিজেন্স উইং) ও সাবেক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মুহাম্মদ খায়রুল ইসলাম।
আর গুম-অপহরণের পর সেনাবাহিনীর জয়েন্ট ইন্টারোগেশন সেলে (জেআইসি) আটকে রেখে নির্যাতনের মামলায় মোট আসামি ১৩ জন। তাঁদের মধ্যে কারাগারে পাঠানো হয়েছে তিনজনকে। তাঁরা হলেন— ডিজিএফআইয়ের সাবেক পরিচালক (সিটিআইবি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাহবুবুর রহমান সিদ্দিক, সাবেক পরিচালক (সিটিআইবি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আহমেদ তানভীর মাজাহার সিদ্দিক ও সাবেক পরিচালক (সিটিআইবি) মেজর জেনারেল শেখ মো. সরওয়ার হোসেন।
শেখ হাসিনা ও তারিক আহমেদ সিদ্দিকসহ বাকি ১০ আসামি পলাতক।
পলাতক বাকি আট আসামি হলেন—ডিজিএফআইয়ের সাবেক মহাপরিচালক ও অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল মো. আকবর হোসেন, ডিজিএফআইয়ের সাবেক মহাপরিচালক ও অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল মো. সাইফুল আবেদিন, ডিজিএফআইয়ের সাবেক মহাপরিচালক ও অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল মো. সাইফুল আলম, ডিজিএফআইয়ের সাবেক মহাপরিচালক ও অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল আহমেদ তাবরেজ শামস চৌধুরী, ডিজিএফআইয়ের সাবেক মহাপরিচালক ও অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল হামিদুল হক, ডিজিএফআইয়ের সিটিআইবির সাবেক পরিচালক ও সাবেক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ তৌহিদুল উল ইসলাম, ডিজিএফআইয়ের সিটিআইবির সাবেক পরিচালক ও মেজর জেনারেল কবীর আহাম্মদ ও অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট কর্নেল মখছুরুল হক। অর্থাৎ এই দুই মামলার মোট ৩২ জন আসামির মধ্যে ১৭ জনই পলাতক। তাঁদের ট্রাইব্যুনালে হাজির হতে আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে দুটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিতে রেজিস্ট্রার কার্যালয়কে নির্দেশ দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। আগামী ২০ নভেম্বর এই দুই মামলার পরবর্তী তারিখ ধার্য করা হয়েছে।
জুলাই অভ্যুত্থানের সময় রাজধানীর রামপুরা-বনশ্রী এলাকায় ২৮ জনকে হত্যার ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় মোট আসামি চারজন।
তাঁদের মধ্যে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) সাবেক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ রেদোয়ানুল ইসলাম ও বিজিবির সাবেক কর্মকর্তা মেজর রাফাত বিন আলম মুনকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। অন্য দুই আসামি পলাতক। তাঁরা হলেন—পুলিশের সাবেক অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) মো. রাশেদুল ইসলাম ও সাবেক ওসি মো. মশিউর রহমান। পলাতক এই দুজনের বিষয়ের জাতীয় দৈনিকে বিজ্ঞপ্তি দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আগামী ৫ নভেম্বর এই মামলার পরবর্তী তারিখ রেখেছেন ট্রাইব্যুনাল।
কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে গতকাল বুধবার সকাল ৭টার দিকে ‘বাংলাদেশ জেল-প্রিজন ভ্যান’ লেখা সবুজ রঙের গাড়িতে ১৫ জনকে ট্রাইব্যুনালে আনা হয়। সকাল ৮টা ৫ মিনিটে ট্রাইব্যুনাল এজলাশে বসেন। এরপর চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম কার্যতালিকা অনুসারে আত্মসমর্পণ বা হাজির করা আসামিদের বিষয়টি উল্লেখ করলে নাম ডেকে ডেকে আসামিদের উপস্থিতি নিশ্চিত করা হয়। এরপর আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। তাঁদের পক্ষে ট্রাইব্যুনালে ওকালতনামা দাখিল করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এম সারোয়ার হোসেন, আইনজীবী মেজবাউল হক, সালাউদ্দিন রিগ্যানসহ আরো দুজন আইনজীবী। সকাল সাড়ে ৮টার মধ্যে ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম শেষ হলেও সকাল ১০টার দিকে একই প্রিজন ভ্যানে আসামিদের নিয়ে যাওয়া হয়।
সেনাবাহিনী এই আদালতের প্রক্রিয়াকে সাহায্য করেছে : চিফ প্রসিকিউটর
আদেশের পর ট্রাইব্যুনাল প্রাঙ্গণে এই আদেশ নিয়ে সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। এক প্রশ্নের জবাবে চিফ প্রসিকিউটর বলেন, ‘আজ যাঁদের হাজির করা হয়েছে, তাঁদের গ্রেপ্তারের ব্যাপারে, বিচারে সোপর্দ করার ব্যাপারে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী যেমন কাজ করেছে, তেমনি বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের রক্ষক বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এই আদালতের প্রক্রিয়াকে সাহায্য করেছে। তারা ঘোষণা দিয়েছিল, ল অব দ্য ল্যান্ডের প্রতি তারা শ্রদ্ধাশীল থাকবে। বিচারপ্রক্রিয়ার প্রতি তাদের সমর্থন থাকবে। তারা সেই সমর্থন আমাদের দিয়েছে। আসামিদের গ্রেপ্তার করে আদালতে হাজির করার ব্যাপারে তারা সম্পূর্ণ সহযোগিতা করেছে। এটা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর মাধ্যমে আমরা জানতে পেরেছি। উনাদের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী গ্রেপ্তার করে আদালতে উপস্থিত করেছে।’
গ্রেপ্তার আসামিদের চাকরি নিয়ে এক প্রশ্নে তাজুল ইসলাম বলেন, ‘আইন অনুযায়ী তাঁদের চাকরির স্ট্যাটাস নির্ধারিত হবে। সর্বশেষ সংশোধিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনে যেভাবে বলা আছে সেভাবে নির্ধারিত হবে।’
অনলাইনে তাঁদের হাজিরা দেওয়ার সুযোগ থাকবে কি না, জানতে চাইলে চিফ প্রসিকিউটর বলেন, ‘সেটা আদালত নির্ধারণ করবেন। ভবিষ্যতে যখন আবেদন আসবে, বাস্তবতার নিরিখে আদালত যেটা ভালো মনে করবেন, যেটা বিচার প্রক্রিয়াকে স্মুথ (সাবলীল) করবে, সবকিছু মিলিয়ে যেটা কনভিনিয়েন্ট (সুবিধাজনক) হবে, আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী যা হওয়ার, সেটা হবে।’
কারাগারে পাঠানো কর্মকর্তারা ডিভিশন সুবিধা পাবেন কি না—প্রশ্নে তাজুল ইসলাম বলেন, ‘তাঁদের কাস্টডিতে রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কাস্টডিতে প্রেরণ মানে হচ্ছে তাঁরা কারা কর্তৃপক্ষের অধীনে চলে যাবেন। কারা কর্তৃপক্ষ তাঁদের কোথায় রাখবে, কোন জেলে রাখবে, কোন সাবজেলে রাখবে, ঢাকায় রাখবে না চট্টগ্রামে পাঠাবে, না অন্য কোথাও রাখবে এটার যথাযথ কর্তৃপক্ষ কারা কর্তৃপক্ষের অর্থাৎ সরকারের।’
আত্মসমর্পণকারী সেনা কর্মকর্তারা আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল : আইনজীবী
১৫ সেনা কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করে ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়েছে—চিফ প্রসিকিউটর এমন দাবি করলেও তাঁদের আইনজীবী এম সারোয়ার হোসেন বলেন, সেনা সদরের আদেশে সংযুক্ত ১৫ জন অফিসার আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে আজ স্বেচ্ছায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে আত্মসমর্পণ করেছেন।’
প্রসিকিউশনের গ্রেপ্তারের দাবির বিষয়ে তিনি বলেন, ‘যেহেতু তাঁরা পুলিশের মাধ্যমে আদালতে আত্মসমর্পণ করেছেন, সেটিকে তাঁরা বলেছেন তাঁরা গ্রেপ্তার হয়েছেন। তাঁরা কখনোই গ্রেপ্তার ছিলেন না। তাঁরা সেনা হেফাজতে ছিলেন। আর্মি আইন অনুযায়ী তাঁরা অ্যাটাচ ছিলেন। তাঁরা ট্রায়াল ফেস (বিচার মোকাবেলা) করতে চান।’
এক প্রশ্নে আইনজীবী সারোয়ার হোসেন বলেন, ‘আইনের কাছে যাঁরা স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণ করেন, তাঁরা মনোবল নিয়ে আত্মসমর্পণ করেন। তার মানে তাঁদের মনোবল আছে যে তাঁরা কোনো অন্যায় করেননি। যাঁরা সত্যিকারের অন্যায় করেছেন, তাঁরা দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছেন।’
আইনজীবী সারোয়ার হোসেন বলেন, ‘এই অফিসাররা অনেক সিনিয়র অফিসার, অভিজ্ঞ অফিসার। আন্তর্জাতিক বাহিনীতেও অনেকে চাকরি করেছেন। তাঁরা আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে আজ এই আদালতে আত্মসমর্পণ করেছেন। তাঁরা আশা করছেন, এই আদালতের মাধ্যমে তাঁরা ন্যায়বিচার পাবেন।’
আইনজীবী সারোয়ার হোসেন বলেন, ‘ঢাকা সেনানিবাসের যে ভবনটিকে সাবজেল ঘোষণা করা হয়েছে, এই ১৫ সেনা কর্মকর্তাকে সেখানে নেওয়া হবে বলে আমরা জেনেছি।’ তিনি আরো জানান, কারাগারে পাঠানো ১৫ কর্মকর্তার জামিন চেয়ে আবেদন করা হয়েছে। আগামী নির্ধারিত তারিখে এর শুনানি হবে বলে জানান তিনি।
গত ৮ অক্টোবর সাবেক এই তিন মামলায় ৩৪ আসামির বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির পর গত ১১ অক্টোবর এক সংবাদ সম্মেলনে সেনাবাহিনী জানায়, ১৫ কর্মকর্তা সেনাবাহিনীর হেফাজতে আছেন। এমন পরিস্থিতির মধ্যে গত ১৩ অক্টোবর ঢাকা সেনানিবাসের একটি ভবনকে সাময়িকভাবে কারাগার ঘোষণা করে সরকার। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এসংক্রান্ত প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, ‘ফৌজদারি কার্যবিধির ১৮৯৮-এর ৫৪(১)-এর ক্ষমতাবলে দ্য প্রিজন অ্যাক্ট কারা আইন), ১৮৯৪-এর ধারা ৩/বি অনুসারে ঢাকা সেনানিবাসের বাশার রোডসংলগ্ন উত্তর দিকে অবস্থিত ‘এমইএস’ বিল্ডিং নং-৫৪-কে সাময়িকভাবে কারাগার হিসেবে ঘোষণা করা হলো। যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদনক্রমে এই আদেশ জারি করা হলো। এই আদেশ অবিলম্বে কার্যকর হবে।’

