১৭ ডিসেম্বর ২০২৫, বুধবার, ০৯:৩২:১১ অপরাহ্ন
ইঁদুরের গর্তে জীবনসংগ্রাম: সূর্যহারা বেগমের দু’মুঠো ভাতের গল্প
  • আপডেট করা হয়েছে : ১৪-১২-২০২৫
ইঁদুরের গর্তে জীবনসংগ্রাম: সূর্যহারা বেগমের দু’মুঠো ভাতের গল্প

শাবল, ঝাঁটা আর একটি ব্যাগ—এই সামান্য সম্বল নিয়েই মাঠে মাঠে ঘুরে বেড়ান ৬৭ বছর বয়সী সূর্যহারা বেগম। লক্ষ্য একটাই—ইঁদুরের গর্ত। কাঙ্ক্ষিত গর্ত খুঁজে পেলেই শাবল দিয়ে খুঁড়ে হাত বাড়ান ভেতরে। বেরিয়ে আসে ইঁদুরের জমিয়ে রাখা আমনের ধান। সেই ধান থেকেই চাল হবে, আর সেই চালে রান্না করা ভাত খেয়েই দিন কাটে নিঃসন্তান, নিঃস্ব সূর্যহারার।

তিনি রাজশাহী জেলার একটি উপজেলার পৌর সদরের বাসিন্দা। নেই স্বামী, নেই সন্তান। জীবিকার তাগিদে প্রতিদিনই সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ছুটে চলেন এক মাঠ থেকে আরেক মাঠে। কোথাও ঝরে পড়া ধান থাকলে ঝাঁটা দিয়ে ঝাড়ু দিয়ে সযত্নে সংগ্রহ করেন। তীব্র শীত উপেক্ষা করেই চলে তার কর্মযজ্ঞ।

আমন মৌসুমে ধান পাকলে ইঁদুর পাকা ধানের শীষ কেটে গর্তে জমা করে। সেই গর্ত থেকেই ধান সংগ্রহ করেন সূর্যহারা বেগম। তবে ঝুঁকিও কম নয়। অনেক সময় গর্তে ইঁদুরের বাচ্চা কিংবা বিষধর সাপ থাকে—এমনটা বুঝতে পারলে আর হাত দেন না তিনি।

শুধু ধান কুড়িয়েই নয়, বর্ষা মৌসুমে কাজ না থাকলে পরিত্যক্ত জলাশয় থেকে ডাঁটি পদ্ধতিতে মাছ ধরেন। সেই মাছ বাজারে বিক্রি করেই চলে সংসার। মাঝেমধ্যে আলুর কোল্ড স্টোরেজে শ্রমিকের কাজও করেন।

নিজের জীবনের কষ্টের কথা বলতে গিয়ে সূর্যহারা বেগম বলেন,

“আমার পৈতৃক নিবাস পাবনায়। তখন আমাদের এলাকায় খাদ্যের খুব কষ্ট ছিল। বাবা আমাকে বিয়ে দেন রাজশাহীতে। বিয়ের কিছুদিন পর আমার স্বামী পান বিক্রেতা আসকান আলী স্ট্রোক করে এক পাশ প্যারালাইজড হয়ে যান। তাকে নিয়ে মানুষের দুয়ারে দুয়ারে কাজ করে কোনোমতে চলেছি। প্রায় এক দশক আগে তিনি মারা যান। এরপর আমার জীবনে নেমে আসে আরও দুর্ভোগ।”

তিনি আরও বলেন, দু বেলা দু মুঠো খাবারের জন্য ফসলের মাঠ থেকে ধান, আলু, পেঁয়াজ কুড়িয়ে সারা বছরের জন্য অল্প অল্প করে জমাই। বর্ষায় মাছ ধরি। আল্লাহ যতদিন সুস্থ রাখবেন, ততদিন সংগ্রাম করেই বাঁচব। আল্লাহ ছাড়া কারও কাছে হাত পাততে চাই না।”

সিংগা মাঠ এলাকার একাধিক ধান উৎপাদনকারী কৃষক জানান, আমন মৌসুমে ইঁদুরের উপদ্রব সবচেয়ে বেশি থাকে। ইঁদুর পাকা ধান কেটে গর্তে জমা করে। কৃষকেরা ধান কেটে নেওয়ার পর মাঠে পড়ে থাকা ধান সাধারণত দরিদ্র নারীরা কুড়িয়ে নেন। এ কাজে তাদের কেউ বাধা দেয় না।

ইঁদুরের গর্ত থেকে ধান তুলে বেঁচে থাকার এই সংগ্রাম—সূর্যহারা বেগমের জীবন যেন নীরব কষ্ট আর অদম্য সাহসের এক জীবন্ত দলিল।

শেয়ার করুন