২১ নভেম্বর ২০২৪, বৃহস্পতিবার, ০৬:১৪:২৮ অপরাহ্ন
নতুন পাঠ্যবই নিয়ে সংকটের আশঙ্কা
  • আপডেট করা হয়েছে : ২৬-০৯-২০২২
নতুন পাঠ্যবই নিয়ে সংকটের আশঙ্কা

নতুন শিক্ষাবর্ষ শুরু হতে বাকি আর মাত্র তিন মাস। এবার শিক্ষার্থীদের জন্য ছাপাতে হবে সোয়া ৩৩ কোটি পাঠ্যবই। কিন্তু এসব বই মুদ্রণ শুরু দূরের কথা, শনিবার পর্যন্ত একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তিও করতে পারেনি জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। অথচ অন্যান্য বছর এই সময়ে ৬ থেকে ৭ কোটি বই ছাপা শেষ হয়ে যায়।

এ বাস্তবতায় ২০২৩ শিক্ষাবর্ষের শুরুতে বিনামূল্যের পাঠ্যপুস্তক হাতে পাওয়া নিয়ে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। নভেম্বরের মধ্যে ছাপা শুরু হলেও ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে সর্বোচ্চ ৩০-৩৫ শতাংশ বা ১০ কোটির বেশি বই সরবরাহ করা সম্ভব হবে না বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। শুধু তাই নয়, কাজ নেওয়া বেশকিছু প্রতিষ্ঠান শেষ পর্যন্ত বই দিতে পারবে কি না, সেই শঙ্কাও উড়িয়ে দিচ্ছেন না তারা। কম দামে কাজ নেওয়ায় সাদা কাগজের পরিবর্তে নিউজপ্রিন্টেও ছাপা হতে পারে বই। এছাড়া প্রাক-প্রাথমিক স্তরে ১২টি প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ১১টিরই নির্দিষ্ট মেশিন নেই। ফলে গত কয়েক বছরের মতোই শিক্ষার্থীরা এবারও ছোট ও ত্রুটিপূর্ণ বই পেতে পারে বলে মনে করছেন তারা।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এবার পাঠ্যবই নিয়ে সৃষ্ট এই হযবরল অবস্থা তৈরির মূল কারণ ৩টি। প্রথমত, বিলম্বে শুরুর কারণে পাঠ্যপুস্তকসংক্রান্ত ৬টি দরপত্রের মধ্যে একটির প্রক্রিয়াও এখন পর্যন্ত শেষ করতে পারেনি এনসিটিবি। ফলে বই ছাপার জন্য এখনো চুক্তি হয়নি। দ্বিতীয়ত, নতুন শিক্ষাক্রমে আগামী বছর ৪টি শ্রেণিতে বই দেওয়ার কথা। বিলম্বের কারণে প্রাথমিকের পাইলটিং (পরীক্ষামূলক প্রয়োগ) করা যায়নি। মাধ্যমিকে ষষ্ঠ শ্রেণির পাইলটিং কোনোমতে হয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত বই চূড়ান্ত হয়নি। তৃতীয়ত, ডলার, জ্বালানি তেল এবং কাগজসহ বই ছাপানোর অপরিহার্য উপাদানের দাম বৃদ্ধি এবং বিদ্যুতের বিদ্যমান পরিস্থিতিও শঙ্কা তৈরি করেছে। বাজার এমন চড়া সত্ত্বেও মুদ্রাকররা গড়ে প্রাক্কলিত দরের (যে দামে সরকার বই ছাপতে চায়) চেয়ে ২৫ শতাংশ কম টাকায় দরপত্র দিয়েছেন। এতে কাক্সিক্ষত মানের বই পাওয়া যাবে কি না, তা বড় প্রশ্ন হিসাবে দেখা দিয়েছে।

মুদ্রণ শিল্প সমিতির সাধারণ সম্পাদক জহুরুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, পাঠ্যবই নিয়ে এখন পর্যন্ত যে অবস্থা তৈরি হয়েছে এর দায় পুরোপুরি এনসিটিবির। কেননা যে দরে কাজ দেওয়া হয়েছে, তাতে অন্তত ৫০টি ফার্ম এবার বই-ই দিতে পারবে না। আবার অনেকের পক্ষে নিউজপ্রিন্টে বই সরবরাহ দূরের কথা, খালি কাগজ দিতে পারবে কি না, সেই সন্দেহও আছে। এই অবস্থায় কারও কারও লক্ষ্য থাকে বছরের শেষ সময়। কেননা বিতরণ সামনে রেখে তখন এনসিটিবি কেবল বই চায়, মান নয়। সেই সুযোগ নিয়ে কেউ কেউ নিউজপ্রিন্টে বই দিয়ে পার পাওয়ার চেষ্টা করতে পারে। ওই পরিস্থিতিতে হয়তো নির্ধারিত ১ জানুয়ারির মধ্যে সর্বোচ্চ ৩০ শতাংশ বই যেতে পারে। তবে এনসিটিবি যদি দেরিতে প্রক্রিয়া শুরু না করত এবং নিুদরের দরপত্র বাতিল করে ন্যায্যমূল্যে কাজ দিত, তাহলে হয়তো এমন অবস্থা তৈরি হতো না।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এনসিটিবি এবার মোট ৩৩ কোটি ২৮ লাখ বই ছাপানোর প্রক্রিয়া চালাচ্ছে। এর মধ্যে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ও দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের ব্রেইল বই এবং প্রাক-প্রাথমিক স্তরের পাঠ্যবই ও অনুশীলন গ্রন্থের দরপত্র প্রক্রিয়া শেষে দরদাতাদের কাছ থেকে সম্মতিপত্র (নোটিফিকেশন অব অ্যাওয়ার্ড) নেওয়ার কাজ চলছে। প্রাথমিকের তৃতীয়-পঞ্চম শ্রেণির সম্মতিপত্র চাওয়া শুরু হয়েছে রোববার। এই স্তরের প্রথম-দ্বিতীয় শ্রেণির বইয়ের দরপত্র জাতীয় ক্রয় কমিটি ও প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনের জন্য প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। মাধ্যমিকের অষ্টম-নবম শ্রেণির বইয়ের চুক্তির প্রক্রিয়া চলছে। আর গত বুধবার ক্রয় কমিটি ষষ্ঠ-সপ্তম শ্রেণির দরপত্র অনুমোদন দিয়েছে। এটির ফাইল এখন প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনের পর শিক্ষা মন্ত্রণালয় হয়ে এনসিটিবিতে ফিরবে। এরপর সম্মতিপত্র চাওয়া হবে দরদাতাদের কাছে।

নিয়ম অনুযায়ী, সম্মতিপত্র চাওয়া হলে দরদাতারা অন্তত এক সপ্তাহ সময় পান। এরপর তারা আরও ২৮ দিন সময় পান চুক্তি করার জন্য। দরদাতারা পারফরম্যান্স গ্যারান্টি (পিজি) বা সিকিউরিটি মানি দিলেই এনসিটিবি সম্মত হয়। এরপর বই মুদ্রণের কার্যাদেশের পাশাপাশি পাণ্ডুলিপি দেওয়া হয়। ওই পাণ্ডুলিপি যাচাই ও এনসিটিবির অনুমোদন নিয়ে বই মুদ্রণ শুরু করতে আরও ৩-৪ দিন সময় লেগে যায়। মুদ্রণ শিল্প সমিতির সাধারণ সম্পাদক বলেন, সম্মতিপত্র দেওয়ার পর থেকে বই ছাপা শুরু পর্যন্ত অন্তত দেড় মাস প্রয়োজন। এই হিসাবে বেশি চাপাচাপি করা হলেও ১০ নভেম্বরের আগে কাজ শুরু করা কিছুতেই সম্ভব হবে না। অথচ অন্যান্য বছর এই সময়ে প্রাথমিক স্তরেরই অনেক বই ছাপানো শেষে জেলা-উপজেলায় পৌঁছে যায়। সেই হিসাবে ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে ৩০ শতাংশের বেশি বই যাবে কি না সন্দেহ আছে। সুতরাং বই নিয়ে বড় ধরনের সংকটই অপেক্ষা করছে।

অবশ্য এনসিটিবি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে এসংক্রান্ত যে সময়সূচি পাঠিয়েছে তাতে ২৩ ডিসেম্বরের মধ্যে কাজ শেষ করার কথা আছে। দরপত্রের শর্ত অনুযায়ী, কার্যাদেশ দেওয়ার ৭০ দিনের মধ্যে অষ্টম-নবম আর ৬০ দিনের মধ্যে ষষ্ঠ-সপ্তম শ্রেণির বই সরবরাহ করতে হবে। অন্যদিকে ৫০ দিনের মধ্যে প্রাক-প্রাথমিক ও প্রথম-দ্বিতীয় শ্রেণির এবং ৭২ দিনের মধ্যে তৃতীয়-পঞ্চম শ্রেণির বই সরবরাহ করতে হবে দরদাতাদের। এখন যদি মধ্য নভেম্বরে বই ছাপানো শুরু হয়, তাহলে বই উৎসবের বাকি থাকে ৪৫ দিন। এই অবস্থায় উল্লিখিত সময়সূচিও ফেল করার আশঙ্কা থাকে। সংশ্লিষ্টরা আরও বলছেন, দরপত্রে নির্ধারিত সময়ের পরও বই সরবরাহে ২৮ দিন সময় পান মুদ্রাকররা, যে সময়ের মধ্যে নামমাত্র জরিমানা দিয়ে বই সরবরাহের সুযোগ থাকে। সূত্র জানায়, এই ২৮ দিনের সুযোগ নিয়ে চলতি বছর মার্চেও কেউ কেউ বই সরবরাহ করেছে। আর এমনটি ঘটলে আগামী ফেব্রুয়ারি-মার্চে বই সরবরাহের কাজ চলে যেতে পারে। এ অবস্থায় গোটা সেট নয়, আংশিক বই সরবরাহ করে পরিস্থিতি সামাল দিতে হবে এনসিটিবিকে।

এ প্রসঙ্গে এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ফরহাদুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, এখন পর্যন্ত সবকিছু সময়সূচি অনুযায়ীই চলছে, কোনো বিলম্ব হয়নি। গত বছর একটি প্রতিষ্ঠানকে ৩ কোটি ২০ লাখ পর্যন্ত বই দেওয়া হয়েছে মুদ্রণের জন্য। এবার সেই প্রতিষ্ঠানকে ২ কোটি বা এর কম বই দেওয়া হয়েছে। এভাবে এবার অস্বাভাবিক হারে এমন কাউকেই কাজ দেওয়া হয়নি। পাশাপাশি প্রাথমিকের মতো মাধ্যমিকেও এবার প্রাপ্য সময়ের অর্ধেকের মধ্যে ৫০ শতাংশ বই সরবরাহের বিধান করা হয়েছে। সুতরাং, যেহেতু সক্ষমতা বিচার করে কাজ দেওয়া হয়েছে এবং অর্ধেক বই পাওয়া যাবে, তাই সংকটের অবস্থা দেখছি না। বরং যথাসময়েই বই শিশুরা পাবে বলে আশা রাখছি। তিনি আরও বলেন, নিউজপ্রিন্টে বই সরবরাহ ঠেকাতে এবার দ্বৈত তদারকি সংস্থা নিয়োগ করা হয়েছে। কম দরে কাজ নেওয়ার দায় মুদ্রাকরদের। কেউ নিুমানের বই দিয়ে পার পাবে না। সেই সুযোগও দেওয়া হবে না।

প্রাক-প্রাথমিকে ত্রুটিপূর্ণ বই : এদিকে গত কয়েক বছর ধরে প্রাক-প্রাথমিক স্তরে নিুমানের পাঠ্যবই দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ আছে। এক্ষেত্রে বড় অভিযোগ, ডিজাইন অনুযায়ী বই ছাপানো হয় না। বৃহস্পতিবার খোদ এনসিটিবি থেকেই সংগৃহীত বইয়ে দেখা যায়, পৃষ্ঠার নিচের দিকে সবুজ রিবন থাকার কথা। কিন্তু ‘ফ্লাশ কাট’ ছাড়াই দেওয়া হয়েছে বই। ফলে রঙিন রিবনের নিচে বাড়তি সাদা কাগজ রয়ে গেছে। মূলত সাদা অংশ কেটে ফেললে বইয়ের আকার ছোট হয়ে যাবে। এজন্যই তা না কেটে সংশ্লিষ্ট মুদ্রাকররা ত্রুটিপূর্ণ বা ডিজাইনবহির্ভূত এই বই সরবরাহ করেছেন। আবার এমন ঘটনাও আছে, নিচে ফ্লাশ কাট দিয়ে সাদা অংশ বাদ দিতে গিয়ে গত বছর একটি প্রতিষ্ঠান ছোট বই সরবরাহ করে জরিমানার মুখে পড়েছিল। সূত্র জানায়, প্রথম-নবম শ্রেণির বই ছাপানোর জন্য দরপত্রে কোন সাইজের মেশিনে ছাপতে হবে তা উল্লেখ থাকে। এসব বইয়ের আকার হলো পৌনে ১০ বাই সোয়া ৭ ইঞ্চি, যা ২০ বাই ৩০ ইঞ্চি মেশিনে ছাপা সম্ভব। আর প্রাক-প্রাথমিকের বইয়ের আকার হলো পৌনে ১১ বাই সোয়া ৮ ইঞ্চি। এই বই ছাপতে পৌনে ২৩ বাই ৩৬ ইঞ্চি মেশিন দরকার। কিন্তু রহস্যজনক কারণে প্রাক-প্রাথমিকের দরপত্রে মেশিনের সাইজ উল্লেখ করা হয় না। এ সুযোগে যাদের এ মানের মেশিন নেই, তারাও কাজ পাচ্ছে। এবারও এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে। যে ১২ প্রতিষ্ঠান কাজ পেয়েছে তাদের মাত্র একটির নির্ধারিত মেশিন আছে।

এ ব্যাপারে এনসিটিবির চেয়ারম্যান বলেন, বাংলাদেশে অল্পসংখ্যক প্রতিষ্ঠানের ওই সাইজের মেশিন আছে। যাতে জিম্মি হতে না হয়, সেজন্যই সাইজ উল্লেখ করা হয় না। তবে এ দাবি সঠিক নয় বলে উল্লেখ করেন মুদ্রণ শিল্প সমিতির সাধারণ সম্পাদক জহুরুল ইসলাম। তিনি বলেন, এই দাবি সঠিক নয়। অন্তত ২০টি প্রতিষ্ঠানের ওই সাইজের মেশিন আছে। আর যাদের মেশিন আছে, এনসিটিবি তো তাদেরও কাজ দেয়নি।

শেয়ার করুন