পার্বত্য চট্টগ্রামের দুর্গম এলাকায় আত্মগোপনে রয়েছেন 'হিজরতে'র উদ্দেশ্যে ঘরছাড়া তরুণদের অনেকে। বিভিন্ন সংগঠনের ছত্রছায়ায় সেখানে তাঁদের প্রশিক্ষণও দেওয়া হচ্ছে। এমনকি গোপনে উগ্রপন্থি কার্যক্রম পরিচালনা করছেন তাঁরা। এ অবস্থায় জঙ্গিদের ধরতে পার্বত্য চট্টগ্রামে চলছে সম্মিলিত অভিযান। এ ছাড়া জঙ্গিবাদে জড়িয়ে গত দুই বছরে বাড়িছাড়া ৫৫ তরুণের খোঁজও পেয়েছে র্যাব। তাঁদের মধ্যে ৩৮ জনের একটি তালিকাও প্রকাশ করেছে সংস্থাটি। নতুন জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারকস্ফীয়ার সঙ্গে জড়িত পাঁচজনকে গ্রেপ্তারের পর গতকাল সোমবার রাজধানীর কারওয়ান বাজারে এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য তুলে ধরেন র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।
গ্রেপ্তাররা হলেন- কুমিল্লার মসজিদুল কোবার ইমাম শাহ মো. হাবিবুল্লাহ (৩২), নেয়ামত উল্লাহ (৪৩), মোহাম্মদ হোসাইন (২২), রাকিব হাসনাত ওরফে নিলয় (২৮) ও সাইফুল ইসলাম ওরফে জায়দ চৌধুরী রনি (১৯)। গত রোববার রাতে র্যাব সদর দপ্তরের গোয়েন্দা শাখা ও র্যাব-১০-এর যৌথ অভিযানে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী ও কেরানীগঞ্জ এলাকা থেকে তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়।
র্যাব কর্মকর্তা খন্দকার আল মঈন বলেন, হাবিবুল্লাহ দুই বছর আগে নেয়াম উল্লাহর মাধ্যমে জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারকস্ফীয়ার সদস্য হন। এর পর থেকে তিনি বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়িতে একটি মাদ্রাসা পরিচালনা করছেন। সেখানে অনেক শিক্ষার্থীও রয়েছেন। তিনি এই সংগঠনের অন্যতম অর্থ সরবরাহকারীও। বিভিন্ন মাদ্রাসার কথা বলে চাঁদা তুলে সংগঠনে দিয়েছেন হাবিবুল্লাহ। মগজ ধোলাই করে কুমিল্লা থেকে নিখোঁজ সাতজন ছাত্রকে জঙ্গি সংগঠনে নেন এই জঙ্গি। ওই তরুণদের সঙ্গে তাঁর একাধিক বৈঠকও হয়েছে।
র্যাব মুখপাত্র বলেন, পার্বত্য অঞ্চলে কিছু বিচ্ছিন্ন সংগঠনের ছত্রছায়ায় নিখোঁজদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। সেখানে তাঁরা নতুন ওই জঙ্গি সংগঠনের নামেই অবস্থান করছেন। নিখোঁজদের বোমা তৈরির প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। সশস্ত্র সংগ্রামে অংশ নেওয়ার প্রশিক্ষণও তাঁদের দেওয়া হয়। নাশকতার লক্ষ্য নিয়ে তাঁরা কী ধরনের পরিকল্পনা করছেন- এটা পলাতকদের গ্রেপ্তার পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। তাঁদের গ্রেপ্তারে পার্বত্য অঞ্চলে বিভিন্ন বাহিনীর সমন্বয়ে সমন্বিত অভিযান চলছে।
র্যাবের তথ্য মতে, দেশের ১৯ জেলা থেকে ৫৫ তরুণ নিরুদ্দেশ হন। তার মধ্যে কুমিল্লা থেকে ১৫, সিলেট থেকে সাত, সুনামগঞ্জ থেকে এক, নারায়ণগঞ্জ থেকে চার, নেত্রকোনা থেকে এক, নোয়াখালী থেকে এক, পটুয়াখালী থেকে ছয়, ফরিদপুর থেকে দুই, বরিশাল থেকে তিন, ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে এক, ময়মনসিংহ থেকে এক, মাগুরা থেকে এক, মাদারীপুর থেকে দুই, খুলনা থেকে এক, চাঁদপুর থেকে এক, ঝালকাঠি থেকে দুই, ঝিনাইদহ ও টাঙ্গাইল থেকে একজন এবং ঢাকা থেকে চারজন নিখোঁজ রয়েছেন।
র্যাব জানায়, দেশের বিভিন্ন এলাকায় তরুণদের জঙ্গি সংগঠনের সদস্যরা টার্গেট করতেন। পরবর্তী সময়ে তাঁদের মুসলমানদের ওপর নির্যাতন-নিপীড়নের বিভিন্ন ভিডিও দেখানো এবং বিভিন্ন অপব্যাখ্যা প্রদানের মাধ্যমে উগ্রবাদে উদ্বুদ্ধ করা হতো। এরপর রাজনীতি, সমাজ ব্যবস্থা-সংক্রান্ত অনিয়ম, ধর্মীয় অপব্যাখ্যা ও বিভিন্ন তাত্ত্বিক জ্ঞান প্রদান করার মাধ্যমে তরুণদের সশস্ত্র হামলার প্রস্তুতি নিতে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার বিষয়ে উৎসাহী করে তুলত।
গ্রেপ্তার হোসাইন এক বছর আগে, সাইফুল দেড় মাস ও রাকিব ২ মাস আগে নিখোঁজ হন। নিখোঁজ হওয়া তরুণদের সশস্ত্র হামলার প্রস্তুতির জন্য প্রশিক্ষণ নিতে পটুয়াখালী, ভোলাসহ বিভিন্ন এলাকায় পাঠানো হয়। পরে তাদের বিভিন্ন 'সেইফ হাউসে' রেখে বিভিন্ন ব্যক্তির তত্ত্বাবধানে পটুয়াখালী ও ভোলার বিভিন্ন চর এলাকায় শারীরিক কসরত ও জঙ্গিবাদবিষয়ক বিভিন্ন প্রশিক্ষণ প্রদান করা হতো। এ ছাড়া আত্মগোপনে থাকার কৌশল হিসেবে তাদের রাজমিস্ত্রি, রংমিস্ত্রি, ইলেকট্রিশিয়ানসহ বিভিন্ন পেশার কারিগরি প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়।
র্যাব জানায়, যারা নিখোঁজ হয়েছেন, তাঁদের অনেকের পরিবার জানেন নিরুদ্দেশ হওয়া তরুণরা চাকরির জন্য বিদেশে অবস্থান করছেন। কেউ কেউ নিয়মিত পরিবারকে অর্থ প্রদান করতেন। র্যাবের হাতে গ্রেপ্তার নেয়ামত উল্লাহ কুমিল্লার একটি মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করতেন। ২০১৯ সালে স্থানীয় এক ব্যক্তির মাধ্যমে জঙ্গি সংগঠনে যুক্ত হন তিনি। গ্রেপ্তার হোসাইন ইলেকট্রিশিয়ান। এক বছর আগে উগ্রপন্থি সংগঠনে নাম লেখান তিনি। এ ছাড়া রাকিব কুরিয়ার সার্ভিসে ডেলিভারিম্যান ও সাইফুল রাজমিস্ত্রি হিসেবে কাজ করতেন।