২১ নভেম্বর ২০২৪, বৃহস্পতিবার, ০৬:১৬:৫৭ অপরাহ্ন
গোদাগড়ীতে খেতুরধামে লাখো ভক্তের সমাগম শেষ হলো অনুষ্ঠান
  • আপডেট করা হয়েছে : ১৫-১০-২০২২
গোদাগড়ীতে খেতুরধামে লাখো ভক্তের সমাগম শেষ হলো অনুষ্ঠান

সারাবিশ্বে সনাতন হিন্দু ধর্মাবলাম্বীদের ধামের সংখ্যা ছয়টি। এর মধ্যে পাঁচটিই ভারতবর্ষে। আর একটি রয়েছে বাংলাদেশে। রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার খেতুর গ্রামে এই ধামের অবস্থান। তাই এটিকে খেতুরীধাম নামেই সবাই চেনেন। গত বৃহস্পতিবার থেকে খেতুরীধামে শুরু হয় অহিংসার প্রতীক ঠাকুর নরোত্তম দাসের তিরোভাব তিথি মহোৎসব।

এই উৎসবকে ঘিরে দেশ-বিদেশের লাখো ভক্তের আগমন হয়েছিল খেতুরীধামে। খেতুর, প্রেমতলী, ডুমুরিয়া, ফরাদপুর, বসন্তপুরসহ কয়েকটি গ্রামজুড়ে তাদের অবস্থান পরিণত হয় এক মহামিলনমেলায়। শনিবার প্রথম প্রহরে দধিমঙ্গল, দ্বি-প্রহরে ভোগ আরতি ও মহান্ত বিদায়ের মধ্যদিয়ে অনুষ্ঠান মালার সমাপ্তি হলো। এর আগে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় শুভ অধিবাসের মধ্যদিয়ে অনুষ্ঠানের মূল আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়। পরদিন শক্রবার অরুণোদয় থেকে অষ্ট প্রহরব্যাপী সেখানে চলে তারক ব্রক্ষ্মনাম সংকীর্ত্তন। এতে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে যাওয়া কয়েক লাখ ভক্ত ছাড়াও ভারত, নেপাল ও ভুটানের বহু ভক্ত অংশ নেন। গৌরাঙ্গদেব ট্রাস্টি বোর্ডের সাধারণ সম্পাদক শ্যামাপদ স্যানাল জানান, উৎসবে যোগ দিতে এবার প্রায় পাঁচ লাখ ভক্তের আগমন হয়েছিল খেতুরীধামে।

শনিবার দুপুরে মহান্ত বিদায়ের পর দূর-দূরান্ত থেকে যাওয়া ভক্তদের অনেকেই বাড়ির পথ ধরেন। তবে এখনও রয়েছেন প্রায় তিন লাখ ভক্ত। মহোৎসব ঘিরে আয়োজিত গ্রামীণ মেলা উপভোগ করছেন তারা। দুই-একদিন পর এ মেলাও শেষ হবে। শনিবার সকালে খেতুরীধাম ঘুরে দেখা গেল, তবু একটুও বিরক্তের ছাপ নেই ভক্তদের চোখে-মুখে। বহুদূর পাড়ি দিয়ে আসার পরেও ক্লান্তি নেই তাদের। একের পর এক ধর্মীয় করণীয় বিষয়গুলো পালন করে যাচ্ছেন তারা। গত ৪৭ বছর ধরে খেতুরীধামে আসেন বগুড়ার শিবগঞ্জের বাসিন্দা নারায়ন দাস। তিনি বলেন, সেই যুবককাল থেকে তিনি খেতুরীধামে আসেন। এখন বয়স হয়েছে। অসুস্থ হলেও নাতিদের সঙ্গে নিয়ে তিনি আসেন। তার মতে, খেতুরীধামে গেলে নরোত্তম ঠাকুরের কৃপা লাভের পাশাপাশি মানুষে মানুষে ভেদাভেদ ভোলা যায়। ভারতের মুর্শিদাবাদ থেকে এসেছিলেন জগন্নাথ দাস। বললেন, খেতুরীধামে আসার সাধ তার অনেকদিনের।

এবার প্রতিবেশীদের সঙ্গে এসেছেন তিনি। এর আগে তিনি ভারতের সবকটি ধামে গিয়েছেন। খেতুরীধামে আসার মধ্যদিয়ে তার সবকটি ধাম যাওয়া হলো। এ জন্য তিনি মানসিকভাবে প্রশান্তি পাচ্ছেন। নেপাল থেকে আসা তীর্থযাত্রী মেহেন্নাথ শিং বললেন, পুরো একমাসের পরিকল্পনা নিয়ে বাংলাদেশ এসেছেন তিনি। খেতুরীধামে দেশ-বিদেশের ভক্তদের এই মিলনমেলা তার কাছে অনেক ভালো লেগেছে। বাংলাদেশে হিন্দু ধর্মাবলাম্বীদের আরও যত ঐতিহ্যবাহী স্থান রয়েছে, সেগুলো পরিদর্শনের চেষ্টা করবেন তিনি। এদিকে খেতুরীধামের উৎসব উপলক্ষে এবারও পর্যাপ্ত নিরাপত্তাব্যবস্থা গ্রহণ করে কর্তৃপক্ষ। সিসি ক্যামেরা বসানো হয় পুরো এলাকাজুড়ে। ভক্তদের জন্য নির্মাণ করা হয় পর্যাপ্ত সংখ্যক টয়লেট, থাকার জায়গা এবং তিন বেলা ভোগ। তাদের চিকিৎসায় বসানো হয় অস্থায়ী মেডিকেল ক্যাম্পও।

প্রায় পাচঁ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে করা হয় আলোকসজ্জা। নরোত্তম ঠাকুরের সংক্ষিপ্ত জীবনী থেকে জানা যায়, ১৫৩১ খ্রিস্টাব্দে ঠাকুর নরোত্তম দাস তৎকালীন গড়েরহাট পরগণার অন্তর্গত বর্তমান গোদাগাড়ী উপজেলার পদ্মা তীরের গোপালপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা জমিদার কৃষ্ণনন্দ দাস, মা নারায়নী রাণী। গোপলপুরে শৈশব অতিবাহিত করে ঠাকুর নরোত্তম দাস বৃন্দাবন অভিমুখে যাত্রা করেন। সেখানে নিখিল বৈষ্ণবকুল লোকনাথ গোস্বামীর শিষ্যত্বগ্রহণ করে দীক্ষা লাভ করেন।পরে তিনি খেতুরে ফিরে আসেন। খেতুর মন্দিরে গড়ে তোলেন স্থাপনা। এরপর তিনিই প্রথমে এখানে এ উৎসবের আয়োজন করেন।

ভক্তরা দূর-দূরান্ত থেকে তার কাছে এসে দীক্ষাগ্রহণ করতে শুরু করেন। ১৬১১ খ্রিস্টাব্দের কার্তিকী কৃষ্ণা পঞ্চমী তিথিতে ঠাকুর নরোত্তম দাস নিত্তলীলায় প্রবেশের মানসে গঙ্গাস্নানের বাসনা প্রকাশ করেন। এ সময় শিষ্যরা তাকে গঙ্গাজলে নিয়ে গেলে নিজের দেহকে অর্ধনিমজ্জিত করে প্রিয় শিষ্য গঙ্গানারায়ণ ও রামকৃষ্ণকে আদেশ করেন তার দেহ মার্জন করতে। গুরু আজ্ঞায় নরোত্তমের ওই দুই শিষ্য তার দেহ মার্জন করতে থাকলে পুরো দেহ এক সময় সাদা দুধের মতো তরল পদার্থে পরিণত হয়ে গঙ্গাজলে মিলিত হয়ে যায়। সে অনুযায়ী ঠাকুর নরোত্তম দাস পৃথিবীতে ৮০ বছর স্থায়ী ছিলেন। এরপর থেকেই যুগ পরম্পরায় দুর্গাপূজার পর বৈষ্ণব ধর্মের অনুসারীরা অহিংসার এই মহান সাধকের কৃপা লাভের আশায় খেতুরীধামে বছরে একবার মিলিত হয়ে থাকেন।

শেয়ার করুন