আমেরিকার সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যে এগিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ। আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে বিশ্বে অর্থনৈতিক দিক দিয়ে এক নম্বরে অবস্থানকারী যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশ বিশাল পরিমাণ রপ্তানি করলেও সে তুলনায় আমদানি করে নগণ্য পরিমাণ। সংখ্যার হিসাবে গত অর্থবছর বাংলাদেশ রপ্তানি করেছে ১ হাজার ১১৭ কোটি ডলারের পণ্য, বিপরীতে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্র থেকে পণ্য আমদানি করেছে ২৮৩ কোটি ডলারের। রপ্তানিতে একক দেশ হিসেবে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বাজার যুক্তরাষ্ট্র। গত অর্থবছর মোট রপ্তানি আয়ের ২০ শতাংশ এসেছে দেশটি থেকে। জার্মানি, ফ্রান্স, স্পেন, যুক্তরাজ্যের তুলনায় আমেরিকায় রপ্তানিতে সর্বোচ্চ প্রবৃদ্ধি হয়েছে বাংলাদেশের গত অর্থবছরে। পাশাপাশি সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগেরও ২০ শতাংশের বেশি আমেরিকানদের। অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, আমেরিকার সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য আরও বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এ জন্য পণ্যের বৈচিত্র্যকরণ করতে হবে। আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম আরও বেগবান করার জন্য স্বয়ংক্রিয় কাস্টমস ব্যবস্থার বাস্তবায়ন করতে হবে। অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোর অবকাঠমো উন্নয়ন করা দরকার। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যমতে, ২০২১-২২ অর্থবছরে যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি হয়েছে ১ হাজার ১১৭ কোটি ডলারের পণ্য, যা মোট রপ্তানি আয়ের প্রায় ২২ শতাংশ। গত বছর মোট রপ্তানি আয় হয়েছে ৫ হাজার ২০৮ কোটি ডলার। পরবর্তী অবস্থানে রয়েছে জার্মানি। দেশটিতে রপ্তানি হয়েছে ৭৫৯ কোটি ডলারের পণ্য, যুক্তরাজ্য থেকে রপ্তানি আয় এসেছে ৪৮৩ কোটি ডলার, ফ্রান্স থেকে ২৭১ কোটি ডলার এবং স্পেন থেকে ৩১৭ কোটি ডলারের রপ্তানি আয় এসেছে। উল্লিখিত চারটি দেশের তুলনায় যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি ছিল সর্বোচ্চ ৪৯ শতাংশ।
২০২১-২২ অর্থবছর যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ১ হাজার ৪২ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে, যার মধ্যে ৮৬ শতাংশ আয়ই তৈরি পোশাক থেকে, যার পরিমাণ ৯০১ কোটি ডলার। এ ছাড়া ৩১ কোটি ডলারের হোম টেক্সটাইল রপ্তানি হয়েছে। বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি হওয়া তৈরি পোশাকের ২১ শতাংশ এবং হোম টেক্সটাইলের ১৭ দশমিক ৮৫ শতাংশের গন্তব্য যুক্তরাষ্ট্র।
এ বিষয়ে আমেরিকান চেম্বার অব কমার্স ইন বাংলাদেশের (অ্যামচেম) সভাপতি সৈয়দ এরশাদ আহমেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ১ হাজার ৪০০ কোটি ডলার। পুরোটাই বাংলাদেশের পক্ষে। বাণিজ্য বাড়াতে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। রপ্তানি আয় বাড়াতে একক পণ্যের ওপর নির্ভরশীল না হয়ে পণ্যের বৈচিত্র্যকরণ করা দরকার। এ জন্য রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোকে আরও কাজ করতে হবে। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য যেসব অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরি করা হয়েছে, সেগুলোর অবকাঠামো উন্নয়ন করতে হবে। আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম আরও বেগবান করার জন্য স্বয়ংক্রিয় কাস্টমস ব্যবস্থার বাস্তবায়ন করতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের বিমানবন্দরে টেম্পারেচার কন্ট্রোল শিপমেন্ট ব্যবস্থা চালু করা দরকার। এটা যত দ্রুত চালু করা যাবে তত দ্রুত আমরা কাঁচা ফুল, খাদ্য ও ওষুধ রপ্তানি করতে পারব।’
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্যমতে, চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে সর্বোচ্চ ৭৯৪ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। এর মধ্যে তৈরি পোশাকই ছিল ৬৯৫ কোটি ডলার, যা কি না বাংলাদেশে মোট তৈরি পোশাক রপ্তানির ১৮ শতাংশের কাছাকাছি।
অন্যদিকে ২০২১-২২ অর্থবছর বাংলাদেশ ২৮৩ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করেছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে, যা মোট আমদানির ৪ শতাংশের কিছু বেশি। একই সময়ে বাংলাদেশ চীন, ভারত, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া থেকে ৭ হাজার ২৭৭ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করেছে। এর মধ্যে চীন থেকে ১ হাজার ৯৩৫ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করা হয়েছে। ভারত থেকে ১ হাজার ৩৬৯ কোটি ডলার, সিঙ্গাপুর থেকে ৪১২ কোটি ডলার, মালয়েশিয়া থেকে ৩৪৭ কোটি ডলার, ইন্দোনেশিয়া থেকে ৩০৮ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করেছে বাংলাদেশ।
জানতে চাইলে গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমেরিকায় আমরা রপ্তানি বেশি করি। আমদানি কম করি। এটা আমাদের জন্য খুবই উপকারী। আমেরিকার সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক অনেক গভীর এবং অনেক দিনের। আমাদের রপ্তানিপণ্য বেশি নেই। শুধু তৈরি পোশাক। এ জন্য আমাদের অনেক সীমাবদ্ধতা আছে। আরও ১০-২০টি পণ্য থাকলে রপ্তানি ৫ থেকে ৭ গুণ বৃদ্ধি পেত। আমেরিকা মাসে শত শত কোটি ডলারের আমদানি করছে। সেই বাজারে আমাদের ১০ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি কিছু না। পণ্য বৈচিত্র্যকরণ করতে হবে। তাহলে আমরা আমেরিকার সর্ববৃহৎ রপ্তানিকারক হতে পারব। মার্কিন বাজারে আমাদের অবস্থান আরও সুদৃঢ় হবে। গার্মেন্টস দিয়ে এগোনো যাবে কিন্তু বিশাল আকারে নয়।’ তিনি বলেন, ‘বিশ্বের সব দেশেই আমেরিকা বিনিয়োগ করে। বাংলাদেশেও দেশটির বিনিয়োগ রয়েছে। আমেরিকার বিনিয়োগ আরও বেশি আনার জন্য আমাদের বিনিয়োগ আকর্ষণীয় করতে হবে। অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোর অবকাঠামো বাস্তবায়ন করতে হবে।’ বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগেও শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশে ২ হাজার ১১৫ কোটি ডলারের এফডিআই এসেছে। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র থেকেই এসেছে ১৯ দশমিক ৩৮ শতাংশ বা ৪১০ কোটি ডলারের বিনিয়োগ, এটি সর্বোচ্চ। যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসা ৪১০ কোটি ডলারের এফডিআইর মধ্যে গ্যাস ও পেট্রোলিয়াম খাতে ২৯১ কোটি ডলার, বস্ত্র খাতে ১২ কোটি ডলার, ব্যাংকিংয়ে ২০ কোটি ডলার, বিদ্যুৎ খাতে ১৭ কোটি ডলার, আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ২৪ কোটি ডলার এবং বিমায় ২৭ কোটি ডলার রয়েছে। এ ছাড়া যুক্তরাজ্য থেকে ২৭১ কোটি ডলার, সিঙ্গাপুর থেকে ১৮৪ কোটি, দক্ষিণ কোরিয়া থেকে ১৪৬ কোটি এবং চীন থেকে ১৩৫ কোটি ডলারের বিনিয়োগ পেয়েছে বাংলাদেশ। এ বিষয়ে গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘পণ্য রপ্তানিতে একক দেশ হিসেবে বড় বাজার যুক্তরাষ্ট্র। এ বাজারে আমাদের পণ্য গড়ে ১৫ শতাংশ শুল্ক দিয়েও প্রতিযোগিতা সক্ষমতা ধরে রেখেছে। তবে রপ্তানিপণ্যের ৯০ শতাংশের বেশি তৈরি পোশাক। দেশটিতে নন-কটন তৈরি পোশাকের চাহিদা বাড়ছে। আমাদের সেদিকে নজর দেওয়া উচিত। একই সঙ্গে শুধু তৈরি পোশাকের ওপর নির্ভরশীল না হয়ে পণ্য বৈচিত্র্যকরণ করা দরকার। চামড়া, চামড়াজাত পণ্য ও সিরামিক রপ্তানি করা যেতে পারে। এ জন্য আমাদের আরও বেশি বিদেশি বিনিয়োগ দরকার। বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য অবকাঠামো উন্নয়ন অত্যন্ত জরুরি।’