রাজধানী ঢাকায় দিনের পর দিন গণপরিবহণ বৃদ্ধির কারণে যানজটে ভোগান্তি বাড়ছে নগরবাসীর। স্বল্প দূরত্বের এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেতে সীমাহীন দুর্ভোগ ও দীর্ঘ সময় অপচয় হচ্ছে। যানজটের কারণে অর্থনীতির বড় ক্ষতি হচ্ছে। বুয়েটের এক সমীক্ষায় ওঠে এসেছে, ঢাকা শহরের যানজটের জন্য বার্ষিক ৪ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার খরচ হয়, যা জাতীয় বাজেটের ১০ শতাংশের বেশি। যানজটে বছরে ৬ কোটি কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়।
১৯৯৮ সালে ঢাকায় গাড়ির গতি ছিল ঘণ্টায় ২৫ কিলোমিটার। গত বছরের ৩ এপ্রিল বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের এক গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকায় গাড়ির গতি দাঁড়িয়েছে ঘণ্টায় ৪ দশমিক ৮ কিলোমিটার। এ ছাড়া যানজটের কারণে ঢাকায় বসবাস করা মানুষ মানসিক চাপের মধ্যে থাকেন। যানজটের কারণে হৃদযন্ত্র, ফুসফুসের রোগ হচ্ছে। শ্রবণশক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। যানজটের কারণে স্বাস্থ্য সমস্যায় দৈনিক ক্ষতির পরিমাণ গড়ে ৮ কোটি ৭৪ লাখ টাকা। এদিকে, তিলোত্তমা ঢাকায় ভাঙাচোরা লক্কড়-ঝক্কড় মার্কা গণপরিবহণের কাছে অসহায় হয়ে পড়েছে সাধারণ যাত্রীরা। বেশি ভাড়ার কারণে ট্যাক্সি ও অটোরিকশা নিম্নবিত্তের নাগালের বাইরে। তাই প্রতিদিন ভোগান্তি যেন নিয়তি। ঢাকাবাসীকে যানজট থেকে মুক্তি দিতে সরকার স্বপ্নের মেট্রোরেল চালু করেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০২২ সালের ২৮ ডিসেম্বর উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত মেট্রোরেল উদ্বোধন করেন। পরদিন থেকেই যাত্রী চলাচল শুরু হয়েছে, দেশের প্রথম এই বৈদ্যুতিক ট্রেনে। পরে ধাপে ধাপে এই পথের মাঝের নয়টি স্টেশন খুলে দেওয়া হয়। দুর্বিষহ যানজট নিরসনের স্বপ্ন পূরণে আধুনিক গণপরিবহণ মেট্রোরেল চালুর মাধ্যমে একধাপ এগিয়েছে বাংলাদেশ।
দ্বিতীয় ধাপে আগারগাঁও থেকে মতিঝিল অংশ অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে যাত্রী পরিবহণ শুরু হবে বলে জানিয়েছেন সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উদ্বোধন করবেন। আগারগাঁও থেকে মতিঝিল অংশে মেট্রোরেলের ৭টি স্টেশন হচ্ছে বিজয় সরণি, ফার্মগেট, কারওয়ান বাজার, শাহবাগ, টিএসসি, সচিবালয় ও মতিঝিল। এর মধ্যে প্রথম ধাপে ফার্মগেট, সচিবালয় ও মতিঝিল স্টেশন চালু হতে পারে। মেট্রোরেল বাস্তবায়ন ও পরিচালনকারী কোম্পানি ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড-ডিএমটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ এন ছিদ্দিক সাংবাদিকদের জানান, মেট্রোরেলের দ্বিতীয় অংশে সব স্টেশন একেবারে চালু করা সম্ভব না হলে ধীরে ধীরে চালু করা হবে।
এদিকে রাজধানীর গণপরিবহণের মধ্যে যাত্রীদের স্বস্তি এনে দিয়েছে মেট্রোরল। স্বল্প সময়ে ও কোনো ধরনের ভোগান্তি ছাড়াই এক স্টেশন থেকে আরেক স্টশনে যাতায়াতের নির্ভরযোগ্য পরিবহণ এখন মেট্রোরেল। তাই যাত্রীরা এখন মেট্রোরেল ব্যবহারে আগ্রহী। উত্তরা থেকে আগারগাঁও অংশে যাত্রীদের নিয়মিত ব্যবহার বেড়েছে। সকাল ও সন্ধ্যায় কর্মজীবীদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে মেট্রোরেল। শুধু মেট্রোরেল-সংলগ্ন এলাকার বাসিন্দারা নন, দূর এলাকার বাসিন্দারাও উত্তরার অফিসে আসা-যাওয়ায় মেট্রোরেল ব্যবহার করছেন। শুধু দীর্ঘ যাত্রা নয়, এক স্টপেজ থেকে আরেক স্টপেজে যেতে সারা দিনই স্থানীয়রা মেট্রোরেল ব্যবহার করছেন।
রোববার সন্ধ্যায় আগারগাঁও স্টেশনে কথা হয় অফিস ফেরত যাত্রী আব্দুল কাশেমের সঙ্গে। তিনি মিরপুর ৬ নম্বর সরকারি আবাসন এলাকায় বসবাস করেন। পল্লবী স্টেশনে মেট্রোরেল থেকে নেমে বাসায় যেতে তার পাঁচ মিনিট হাঁটতে হয়। তবু আগারগাঁও পাসপোর্ট অফিসে যাতায়াতে মেট্রোরেল ব্যবহারই তার জন্য সুবিধার হয়। মেট্রোরেলে তিনি ২০ মিনিটের মধ্যে বাসায় পৌঁছাতে পারেন। অথচ আগে রাস্তায় তিন ঘণ্টার মতো বসে থাকতে হতো।
এ বিষয়ে কাজীপাড়ার বাসিন্দা আকবর হোসেন বলেন, মিরপুর ১২ নম্বরে আমার ফার্নিচারের দোকান। মেট্রোরেলে আসতে লাগে ৫ মিনিট। আগে বাসে জায়গায় জায়গায় থেকে যাত্রী ওঠাতো। এতে সময় লাগতো অনেক। বিমান মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা আফসার উদ্দিন বলেন, উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত একটি বাসে যেতে সময় লাগে ৩ ঘণ্টা এবং যানজটের সময় লাগে ৪ থেকে ৫ ঘণ্টা। আর মেট্রোরেলে সময় লাগবে মাত্র ৪০ মিনিট। উত্তরা থেকে মতিঝিল ২০ কিলোমিটার পথে মেট্রোরেলের ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে ১০০ টাকা। যানজট মুক্ত যাতায়াতের সুবিধার্থে অনেকেই এমআরটি পাস করে নিয়েছেন।
সরকার ২০১২ সালে মেট্রোরেল প্রকল্প গ্রহণ করে। কাজ শুরু হয় ২০১৭ সালে। প্রকল্পের উন্নয়ন সহযোগী হিসাবে রয়েছে-জাপান উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা (জাইকা)। শুরুতে প্রকল্পের আকার ছিল প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকা। সম্প্রসারণ, স্টেশন প্লাজা নির্মাণ, কিছু স্টেশনে নতুন করে জমি অধিগ্রহণ, পরামর্শকের পেছনে ব্যয় বৃদ্ধি, বাড়তি ভ্যাটের কারণে আরও প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা ব্যয় বেড়েছে। ঢাকা ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিট ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্টের লাইন-৬ এর খরচ দাঁড়িয়েছে ৩৩ হাজার ৪৭২ কোটি টাকা। এরমধ্যে জাইকা দিচ্ছে ১৯ হাজার ৭১৯ কোটি টাকা। আর সরকার এই প্রকল্পে খরচ করছে ১৩ হাজার ৭৫৩ কোটি টাকা। প্রথমে প্রকল্পটি মতিঝিল পর্যন্ত হওয়ার কথা থাকলেও ১.১৬ কিলোমিটার পরিধি বাড়িয়ে কমলাপুর রেলস্টেশন পর্যন্ত নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। ফলে প্রকল্পটির ব্যয় ২১,৯৮৫ কোটি টাকা থেকে বেড়ে ৩৩,৪৭২ কোটি টাকা হয়েছে। এ জন্য অতিরিক্ত খরচ হচ্ছে ১১,৪৮৭ কোটি টাকা। এখন মেট্রোরেল উত্তরা থেকে কমলাপুর পর্যন্ত ২১.২৬ কিলোমিটার দীর্ঘ হয়েছে।