২৭ এপ্রিল ২০২৪, শনিবার, ০৭:৫১:২৭ অপরাহ্ন
আইএমএফকে ‘খুশি’ করতে এনবিআরের প্রস্তুতি
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৯-০৮-২০২৩
আইএমএফকে ‘খুশি’ করতে এনবিআরের প্রস্তুতি

বাংলাদেশকে দেওয়া ঋণের শর্ত পূরণে বেশ পিছিয়ে আছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এ নিয়ে সম্প্রতি অসন্তোষও প্রকাশ করেছে উন্নয়ন সহযোগী সংস্থাটি। এ অবস্থায় আইএমএফের ‘মান ভাঙাতে’ তাদের শর্ত মানার যাবতীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে এনবিআর। পুরো অর্থবছরে যেভাবে আইএমএফের শর্ত পূরণ করা হবে, তার একটি কর্মপরিকল্পনা তৈরি করেছে সরকারের রাজস্ব আহরণকারী সংস্থাটি।

বাংলাদেশকে অনুমোদন করা ৪৭০ কোটি ডলার ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি ছাড়ের আগে আগামী অক্টোবর-নভেম্বর সময়ে ঢাকা সফরে আসবে আইএমএফের পরবর্তী মিশন। এই মিশন সামনে রেখে সংস্থাটির শর্ত পূরণের কর্মপরিকল্পনা চূড়ান্ত করতে এনবিআরসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কর্মকর্তারা আগামীকাল অর্থ মন্ত্রণালয়ে বৈঠকে বসছেন।


এনবিআর সূত্র জানায়, আইএমএফের শর্ত মেনেই এনবিআর চলতি অর্থবছরের বাজেটে বেশি শুল্ক-কর বসিয়েছে। এর ফলে কর-জিডিপি অনুপাত শূন্য দশমিক ৫০ শতাংশ বাড়বে। এখন ঋণের শর্তের আলোকে আয়কর, শুল্ক ও ভ্যাট খাতে কীভাবে বিশাল অঙ্কের রাজস্ব আদায় করা হবে, তার রোডম্যাপ তৈরি করা হয়েছে। এ জন্য আগামীকালের বৈঠকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, এনবিআরের চেয়ারম্যান, অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, বিদ্যুৎ বিভাগ ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের মনোনীত কর্মকর্তারা উপস্থিত থেকে প্রস্তাবিত কর্মপরিকল্পনা চূড়ান্ত করবেন।  


এনবিআরের লিখিত কর্মপরিকল্পনায় উল্লেখ করা হয়েছে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এনবিআরের সামনে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৪ লাখ ৫০০ কোটি টাকা। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে এই লক্ষ্যমাত্রা ৪ লাখ ৭২ হাজার ৯০০ কোটি টাকা এবং ২০২৫-২৬ অর্থবছরের তা ৫ লাখ ৬৭ হাজার ২০০ কোটি টাকা। অথচ বর্তমানে দেশের কর-জিডিপি অনুপাত ৭ দশমিক ৬০ শতাংশ। আইএমএফ চায় এটাকে বাড়িয়ে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৮ দশমিক ১০ শতাংশ, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ৮ দশমিক ৬০ শতাংশ ও ২০২৫-২৬ অর্থবছরে ৯ দশমিক ১০ শতাংশে উন্নীত করতে হবে।


বিদ্যমান বাস্তবতায় এটা এনবিআরের জন্য চ্যালেঞ্জের। তা সত্ত্বেও সংস্থাটি কিছু কৌশল ঠিক করেছে। এসব কৌশল বাস্তবায়ন করা গেলে আইএমএফের শর্তমতো কর-জিডিপি অনুপাত বাড়বে বলে মনে করা হচ্ছে।


এ প্রসঙ্গে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আইএমএফ যা চেয়েছিল, তা আমরা পুরোপুরি করতে পারিনি। এ বিষয়ে তাদের বুঝিয়ে সন্তুষ্ট করতে হবে। কর-জিডিপি বাড়ানোর গতানুগতিক ধারা থেকে বের হতে হবে।’ আইএমএফের শর্ত পূরণের ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষ চাপে পড়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের মানুষ করের চাপে পড়ে না; তারা চাপ পড়ে ঘুষের কারণে।’ 


এনবিআর জানায়, কাস্টমসের সামনে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রা ১ লাখ ১৮ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। গত ৫ অর্থবছরে কাস্টমসের রাজস্বের গড় প্রবৃদ্ধি ১৪ দশমিক ১০ শতাংশ। এই হার বজায় থাকলে ১ লাখ ১৩ হাজার ৮৭২ কোটি টাকা আদায় করা যাবে। বাকি ৪ হাজার ৮২৮ কোটি টাকা আদায় করতেই বাজেটে বাদাম, বাসমতী চাল, বিভিন্ন ধরনের ফল, কেমিক্যাল, সিগারেট পেপার, স্টিল প্রোডাক্ট, সফটওয়্যার, বাইসাইকেল ও অন্যান্য বিভিন্ন পণ্যের শুল্ক বাড়ানো হয়েছে। এ ছাড়া পেট্রোবাংলার কাছ থেকেও ১০ হাজার কোটি টাকার বকেয়া থেকে একটা বড় অংশ আদায় করা হবে। 


বাজেটে ভ্যাটের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১ লাখ ৪৩ হাজার ৯০০ কোটি টাকা। ভ্যাটের স্বাভাবিক প্রবৃদ্ধির হার ১২ দশমিক ৭৬ শতাংশ। এই হার বজায় থাকলে ১ লাখ ৩৬ হাজার ৪০০ কোটি টাকা আদায় হবে। বাকি ৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকার মধ্যে সিগারেট থেকে ৬ হাজার কোটি টাকা, মোবাইল ফোন, পলিপ্রোপাইলিন স্টেপল ফাইবার, সফটওয়্যার ও এলপিজি সিলিন্ডারের ওপর অব্যাহতি কমিয়ে এবং সিগারেট, জর্দা, গুল, প্লাস্টিক পণ্য, অ্যালুমিনিয়াম পণ্য ও সানগ্লাসে করহার বাড়িয়ে ১ হাজার ১০০ কোটি টাকা আদায় করা হবে। এ ছাড়া ইলেকট্রনিক ফিসক্যাল ডিভাইসের (ইএফডি) মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকা আদায় হবে। 


আয়কর বিভাগের কর্মপরিকল্পনা তুলে ধরে এনবিআর জানায়, চলতি বাজেটে কর আদায়ের লক্ষ্য ১ লাখ ৩৭ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। গত ৫ অর্থবছরে আয়কর খাতের প্রবৃদ্ধির হার ১৪ দশমিক ১১ শতাংশ। এই হার বজায় থাকলে ১ লাখ ৩২ হাজার ২৫৩ কোটি টাকা আদায় হবে। বাকি ৫ হাজার ৫৪৭ কোটি টাকার মধ্যে জমি রেজিস্ট্রেশনে কর বসানোর মাধ্যমে ৩ হাজার কোটি, ভ্রমণ কর থেকে ৫০০ কোটি, টোব্যাকো কর থেকে ৩০০ কোটি, পরিবেশ সারচার্জ থেকে ১ হাজার ৫০০ কোটি ও কর জাল সম্প্রসারণের মাধ্যমে ২৫০ কোটি টাকা আদায় হবে। 


জানা গেছে, ২০২৬ সাল পর্যন্ত মোট ৭ কিস্তিতে অনুমোদিত আইএমএফের ঋণ ছাড়ে এনবিআর, বাংলাদেশ ব্যাংকসহ বিভিন্ন দপ্তরের জন্য শর্ত রয়েছে ৩৮টি। এসব শর্ত ও সংস্কার প্রস্তাবের একটি দৃশ্যমান অগ্রগতি না হলে ঋণ ছাড় পিছিয়ে যেতে পারে। তাই দ্বিতীয় কিস্তির আগে শর্ত মানার ব্যাপারে সংশ্লিষ্টরা প্রস্তুতি নিচ্ছেন। 


বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘সার্বিকভাবে হয়তো এনবিআরের পদক্ষেপে আইএমএফ সন্তুষ্ট থাকবে না। তবে দ্বিতীয় কিস্তি ছাড়ের আগে কিছু পদক্ষেপে আইএমএফ সন্তুষ্ট থাকতে পারে।’ 

এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান ড. আব্দুল মজিদ আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘সামষ্টিক অর্থনীতির ব্যবস্থাপনায় ব্যত্যয় ঘটেছে বলেই আইএমএফ এসেছে। ত্রুটিগুলো ঠিক করার জন্যই আইএমএফ এসেছে। এনবিআরের ব্যাখ্যায় আইএমএফ সন্তুষ্ট হতে পারে, অসন্তুষ্টও হতে পারে।’ 


শেয়ার করুন