৩০ এপ্রিল ২০২৪, মঙ্গলবার, ০৯:৩৫:৫৬ অপরাহ্ন
দুই চীনা নাগরিক ঢাকায় পেতেছেন ক্রিপ্টো-ফাঁদ
  • আপডেট করা হয়েছে : ২৩-০৮-২০২৩
দুই চীনা নাগরিক ঢাকায় পেতেছেন ক্রিপ্টো-ফাঁদ

 অবৈধ ক্রিপ্টোকারেন্সি এবং ফরেক্স ট্রেডের ব্যবসার ফাঁদ নিয়ে ঢাকায় তৎপরতা চালাচ্ছেন চীনের দুজন নাগরিক। এদেশের বাজার ধরার লক্ষ্যে বারিধারায় অফিস নিয়ে গত ফেব্রুয়ারি থেকেই নিজেদের কার্যক্রম পরিচালনা করছেন দং জং এবং হু জু নামের দুই জুয়াড়ি। কয়েকজন বাংলাদেশিকে নিয়োগ করে তাদের দিয়ে তৈরি করছেন ক্রিপ্টোকারেন্সি ব্যবসার ফাঁদ। না বুঝে যোগদানের পর তাদের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে ধারণা পাওয়ার পর কেউ কেউ চাকরিও ছেড়েছেন। বাংলাদেশে কোনো ধরনের ব্যবসার অনুমতি না থাকলেও বিনিয়োগের নামে এ চক্র বিভিন্ন সরকারি দপ্তরেও ধরনা দিচ্ছে বলে জানা গেছে।


অনুসন্ধানে জানা যায়, কম্বোডিয়াভিত্তিক বৈধ প্রতিষ্ঠান গোল্ডওয়েল ক্যাপিটালের নাম ভাঙিয়ে বাংলাদেশে কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছিলেন দং জং এবং হু জু। একসময় গোল্ডওয়েল ক্যাপিটালে কাজ করতেন দং জং। তবে কম্বোডিয়ার আসল গোল্ডওয়েলের সঙ্গে দং জং-এর বাংলাদেশের গোল্ডওয়েলের কোনো সম্পর্ক নেই। বাংলাদেশের অন্তত সাত লাখ ব্যবহারকারীর কাছ থেকে ১০ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া এমটিএফইর মতোই দং জং-এর গোল্ডওয়েলেও লেনদেন হয় ক্রিপ্টোকারেন্সি প্ল্যাটফর্ম ‘বাইন্যান্স’-এর মাধ্যমে।


অর্থ পরিশোধ করা যায় মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস ওয়ালেটের মাধ্যমে। এমটিএফইর মতোই এখানে আছে ফরেইন এক্সচেঞ্জ কারেন্সি বা ফরেক্সে ব্যবসার সুযোগ। ব্যবহারকারীদের হয়ে এই ব্যবসা বা ট্রেড করে দং জং এবং হু জু চক্র। লোভ দেখানো হয় বিশাল অঙ্কের মুনাফার। প্রতারণার জন্য দং জং এবং হু জুর রয়েছে ইংরেজি নাম। দং জং-এর ইংরেজি নাম ‘ব্রায়ান’ আর হু জুর ‘অ্যালিসা’।


প্রতিষ্ঠানটির এক সাবেক কর্মকর্তা বলেন, ‘চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে তাদের বারিধারা অফিসে কাজ শুরু করি। আমিসহ তিনজনকে দোভাষীর চাকরি দেওয়া হয়। তবে কাউকেই নিয়োগপত্র দেননি। দোভাষী হিসেবে নিয়োগ দিলেও আমাদের ফরেক্স ট্রেডের প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করে। বলা হয়েছিল, তারা বাংলাদেশে স্টক এক্সচেঞ্জের ব্যবসা করবে।


এ জন্য বিভিন্ন ব্রোকারেজ হাউস এবং বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনে (বিএসইসি) বেশ কয়েকটি বৈঠকও করেন তারা। সেগুলো আমাদের দেখিয়েছিলেন। কিন্তু কিছুদিন পর তারা আমাকে বেশ কয়েকটি ভুয়া ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ এবং টিকটক অ্যাকাউন্ট খুলতে বলে। এসব অ্যাকাউন্ট থেকে তাদের প্রতিষ্ঠানের প্রচার-প্রচারণা করা হতো। আমাদের বলা হলো, ফরেক্সের জন্য বিনিয়োগকারী নিয়ে আসতে। এই পর্যায়ে এসে আমি তাদের প্রতারণার ফাঁদ বুঝতে পেরে এপ্রিলে চাকরি ছেড়ে দিই।’


বিনিয়োগের জন্য কেমন অর্থ নেওয়া হতো জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কমপক্ষে ২০০ মার্কিন ডলারের কথা তারা বলেছিল। তবে কাদের কাছ থেকে ঠিক কী পরিমাণ অর্থ নিত সেটা আমি জানতাম না। কয়েকজনের কাছ থেকে তারা টাকা নিয়েছেন, তবে সে সময় আমরা সামনে থাকতাম না। তাই কী পরিমাণ অর্থ নিতেন আমরা জানতে পারতাম না।


তার মূল পরিকল্পনা ছিল কমবয়সীদের ফরেক্স ব্যবসা শেখানোর লোভ দেখিয়ে আগ্রহী করে পরে তাদের কাছ থেকে বিনিয়োগ হাতিয়ে নেওয়া। আগ্রহীদের তারা কিছু কাজ দেখাতেন, কীভাবে সহজেই ডলার আয় করা যায়। এসব দেখিয়ে তাদের মুগ্ধ করে একসময় তাদের দিয়ে বিনিয়োগ করাত। এজন্য প্রথমে বিনামূল্যে অ্যাকাউন্ট খুলে দেওয়া হতো। তারপর ট্রেডিং করার লোভ দেখিয়ে বিনিয়োগের নামে অর্থ নিত।’


এই প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগের জন্য আলোচনা করতে এসেছিলেন এমন একজন নারী তার অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বলেন, ‘আমাকে বলা হয়েছিল, তারা একটা ফ্রি অ্যাকাউন্ট খুলে দেবে। এই অ্যাকাউন্টে আমি নিজেই ফরেক্স ট্রেড করতে পারব; কিন্তু যদি আমি বিষয়টি না পারি, তাহলে তারা আমার হয়ে ট্রেড করবে। ৫০০ ডলার ছয় মাস বা এক বছরের জন্য তাদের কাছে রাখতে হবে। এখানে দুটি শর্ত ছিল। এক, যদি এই বিনিয়োগে আমি কোনো ক্ষতির ঝুঁকি না নিই, তাহলে লাভ হলে সেখান থেকে আমাকে মাত্র ১০ শতাংশ দেওয়া হবে। আর যদি লোকসানের ঝুঁকি আমি নিই, তাহলে মুনাফা হলে বেশি অংশ দেওয়া হবে।’


দং জং এবং হু জু বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে টাকা কীভাবে নিজেদের অ্যাকাউন্টে নিত, সেটি ব্যাখ্যা করে প্রতিষ্ঠানটির সাবেক ওই কর্মী বলেন, ‘প্রথমে বিনিয়োগকারীরা তাদের ফ্রি অ্যাকাউন্টেই টাকা নেবে। যেহেতু ফরেক্স ট্রেড কেউ পারে না আবার লোকসানের ঝুঁকি আছে, তাই স্বভাবতই সবাই দংজংকে বলত ট্রেড করে দিতে। দং জং আর হু জু তখন বিনিয়োগকারীদের বলত ডলার তাদের অ্যাকাউন্টে ট্রান্সফার করে দিতে।


অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, কয়েক মাস আগে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যান শিবলী রুবাইয়াত উল ইসলামের সঙ্গে তার দপ্তরে সাক্ষাৎ করেন দং জং এবং হু জু। সাক্ষাতে শরীয়তপুরের একজন সংসদ সদস্যও উপস্থিত ছিলেন। কালবেলার কাছে ওই সাক্ষাতের কিছু ছবি ও ভিডিও রয়েছে।


সাক্ষাতের কারণ জানতে চাইলে দেশের বাইরে থেকে হোয়াটসঅ্যাপে লিখিত বক্তব্যে বিএসইসি চেয়ারম্যান বলেন, ‘বিনিয়োগকারীদের জন্য সরকারি দপ্তর সবসময়ই খোলা তবে কেউ পরিদর্শনে (বা সাক্ষাতে) এলে সেটার কারণ আমরা লিখে রাখি। তাদের আসার কারণ ঠিক এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না। তারা একজন সংসদ সদস্যের সঙ্গে এসেছিলেন। তাকে জিজ্ঞেস করে দেখতে পারেন।’


এ বিষয়ে কথা বলার জন্য ওই সংসদ সদস্যকে কয়েক দফা ফোন করা হলেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। যোগাযোগের কারণ উল্লেখ করে খুদেবার্তা দেওয়া হলেও উত্তর মেলেনি। পরে হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে ফোন করা হলে অ্যন এক ব্যক্তি তা রিসিভ করে জানান, ‘সংসদ সদস্য ব্যস্ত আছেন।’


এরপর হোয়াটসঅ্যাপে কয়েক দফা যোগাযোগ করেও কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। হোয়াটসঅ্যাপে দং জং এবং হু জুকে নিয়ে বিএসইসি চেয়ারম্যানের সঙ্গে সাক্ষাতের ছবি দিয়ে বার্তা দেওয়া হয়। সংসদ সদস্য সেটি দেখলেও কোনো জবাব দেননি।


এদিকে দং জং এবং হু জুর বক্তব্য নিতে এই প্রতিবেদক বারিধারা ডিপ্লোম্যাটিক জোনের ৩ নম্বর সড়কে তাদের কার্যালয়ে যান। সরেজমিন জানা যায়, ভবনটির অষ্টম তলায় একটি ফ্ল্যাট নিয়ে তারা অফিস ও বাসা হিসেবে ব্যবহার করছেন।


ভবনের একজন নিরাপত্তারক্ষী জানান, ‘এই ভবনেই তারা থাকেন। দু-তিনজন কর্মচারী আছেন। তারা সকালে আসেন, বিকেলে চলে যান। তবে গত সোমবার ওই ভবনে গিয়ে দুই চীনা নাগরিক এবং বাংলাদেশি কর্মীদের কাউকেই পাওয়া যায়নি।


পরে যোগাযোগের অনুরোধ করে ভবনের অভ্যর্থনায় পরিচয়সহ ফোন নম্বর দিয়ে আসেন এই প্রতিবেদক। তবে ওই রাতে বাসায় ফিরলেও ৯টায় দেশত্যাগের উদ্দেশে বিমানবন্দর চলে যান দং জং এবং হু জু।


ভবনটির এক বাসিন্দার গাড়িচালক সোমবার রাত ৯টা ৩ মিনিটে মোবাইল ফোনে জানান, ‘তারা এসে খুব তাড়াহুড়া করে ব্যাগ নিয়ে ৯টার দিকে এয়ারপোর্টে চলে যান। তাদের নিজেদের গাড়িতে না গিয়ে রেন্ট-এ-কারের মাইক্রোতে করে যান।’


দং জং এবং হু জুর ভাড়া নেওয়া ফ্ল্যাটের স্বত্বাধিকারীর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তাদের বরাতে ভবনটির সুপারভাইজার মোহাম্মদ এহসান মঙ্গলবার সকালে বলেন, ‘তারা বলেছে ছুটি কাটাতে যাচ্ছেন। ভবন অ্যাসোসিয়েশন এবং ফ্ল্যাট মালিক সম্মত হয়েছিলেন তাদের সঙ্গে আপনার বৈঠক করে দেওয়ার। তারা ফিরে এলে আপনি আবার যোগাযোগ করতে পারেন।’


অবশ্য সূত্র বলছে, দং জং আর হুজু বাংলাদেশে আর আসবে না। এমটিএফইর প্রতারণার বিষয়টি ফাঁস হওয়ার পর থেকেই তারা আতঙ্কিত ছিলেন। তাদের সঙ্গে বাংলাদেশের কেউ সাক্ষাৎও করতে পারছেন না।

শেয়ার করুন