০৪ মে ২০২৪, শনিবার, ০২:১১:৪৬ পূর্বাহ্ন
শিল্পমন্ত্রীর পিএসের দখলে প্রগতির দামি গাড়ি
  • আপডেট করা হয়েছে : ২৮-০৮-২০২৩
শিল্পমন্ত্রীর পিএসের দখলে প্রগতির দামি গাড়ি

শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশ ইস্পাত ও প্রকৌশল করপোরেশনের একটি প্রতিষ্ঠান প্রগতি ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড। রাষ্ট্রায়ত্ত এই প্রতিষ্ঠানের কাজ ক্রয়াদেশের ভিত্তিতে গাড়ি সংযোজন করে তা সরকারি বিভিন্ন দপ্তরে সরবরাহ করা। ক্রয়াদেশের বাইরে কোনো প্রতিষ্ঠানকে গাড়ি ব্যবহার করতে দেওয়ার সুযোগ প্রগতির নেই। কিন্তু নিয়ম না থাকলেও প্রভাব খাটিয়ে প্রগতির একটি দামি গাড়ি ব্যবহার করে আসছেন শিল্পমন্ত্রীর একান্ত সচিব (পিএস) মো. আব্দুল ওয়াহেদ।


শুধু তা-ই নয়, যুগ্ম সচিব পদমর্যাদার এই কর্মকর্তার ব্যবহার করা ঢাকা মেট্রো ঘ-১৮-১৫৮১ নম্বরের পাজেরো এসইউভি গাড়িটির চালকের বেতন, জ্বালানিসহ আনুষঙ্গিক সব খরচ দেয় প্রগতি। এর আগে ৯৪ লাখ টাকা দামের একটি নতুন পাজেরো গাড়ি ব্যবহার করে বিক্রয় অযোগ্য করে ফেলেছেন তিনি। গাড়িটি বর্তমানে প্রগতির গ্যারেজে পড়ে আছে। এ ছাড়া প্রগতির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) থাকাকালে প্রতিষ্ঠানটির একটি দামি গাড়ি শিল্প মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব এস আলমকে উপহার দিয়েছেন বলেও অভিযোগ উঠেছে তাঁর বিরুদ্ধে।


শিল্পমন্ত্রীর পিএস আব্দুল ওয়াহেদ প্রগতির যে গাড়িটি ব্যবহার করেন, সেটির চালকের নাম মো. আসলাম। প্রগতি সূত্রে জানা গেছে, তাঁর মূল বেতন ২৬ হাজার ১০০ টাকা। তিনি এপ্রিল মাসে ডিউটির একটি তালিকা প্রগতি ইন্ডাস্ট্রিজ চট্টগ্রাম অফিসে সরবরাহ করেন। সেখানে ১৯১ ঘণ্টা ৩০ মিনিট অতিরিক্ত ডিউটি করেছেন বলে উল্লেখ করা হয়। অতিরিক্ত ডিউটির জন্য মূল বেতনের সঙ্গে প্রতি মাসে আরও প্রায় ২০ হাজার টাকা প্রগতির ব্যয় হচ্ছে এই পিএসের পেছনে। চালক আসলাম আজকের পত্রিকার কাছে প্রগতির ওই গাড়িটি চালানোর তথ্য স্বীকার করেছেন।


এসব বিষয়ে জানতে শিল্পমন্ত্রীর পিএস আব্দুল ওয়াহেদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি সবকিছু অস্বীকার করে বলেন, ‘আমি প্রগতির কোনো গাড়ি ব্যবহার করি না। প্রগতির দুটি গাড়ি মন্ত্রীর দপ্তরে ব্যবহার হয়। অতিরিক্ত সচিব এস আলমকে গাড়ি উপহার দেওয়ার বিষয়টিও মিথ্যা।’


অতিরিক্ত সচিব এস আলম বলেন, ‘উপহার নয়, আমি যখন প্রগতির চেয়ারম্যান ছিলাম তখন গাড়িটি চার-পাঁচবার আমাকে লিফট দিয়েছে। আমি খারাপ কাজের লোক নই।’

শিল্পমন্ত্রীর পিএস অস্বীকার করলেও প্রগতি ইন্ডাস্ট্রিজ থেকে প্রতিষ্ঠানটির ছয়টি গাড়ি অন্যত্র ব্যবহারের একটি তালিকা আজকের পত্রিকার হাতে এসেছে। এর মধ্যে তিনটি কিউএক্স জিপ ব্যবহার করেন সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি, শিল্পমন্ত্রী ও শিল্প প্রতিমন্ত্রী। আর শিল্পমন্ত্রীর পিএস আব্দুল ওয়াহেদ ব্যবহার করেন একটি পাজেরো, যেটির চেচিস নম্বর PILSUVKH4W1100001 ও ইঞ্জিন নম্বর 4D56UCAG0038)। এ ছাড়া শিল্পমন্ত্রীর পুলিশ প্রটোকল একটি মিতসুবিশি পিকআপ ও শিল্প প্রতিমন্ত্রীর পিএস একটি মাহিন্দ্র গাড়ি ব্যবহার করেন। বিষয়টি আরও নিশ্চিত হওয়ার জন্য প্রগতি ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের উপপ্রধান প্রকৌশলী (যান্ত্রিক) গাজী মাজহারুল আনোয়ারের সঙ্গে


যোগাযোগ করা হলে আজকের পত্রিকাকে তিনি বলেন, ‘প্রগতির ছয়টি গাড়ি শিল্প মন্ত্রণালয়ে ব্যবহার হতো। এর মধ্যে একটি গাড়ি প্রতিমন্ত্রী ফেরত দিয়েছেন। বাকি পাঁচটি শিল্পমন্ত্রী মহোদয়, উনার পিএস, প্রতিমন্ত্রীর পিএস, সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ও শিল্পমন্ত্রী মহোদয়ের প্রটোকলে নিয়োজিত পুলিশ ব্যবহার করেন।’


আব্দুল ওয়াহেদ শিল্প মন্ত্রণালয়ে মন্ত্রীর পিএস হিসেবে যোগ দেন ২০১৯ সালের ১ জানুয়ারি। তার পর থেকে শিল্প মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন প্রগতি ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডে প্রভাব খাটাতে থাকেন তিনি। মন্ত্রীর পিএস ছাড়াও প্রগতির এমডির দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। চলতি বছরের ১৩ ফেব্রুয়ারি থেকে ১২ মে পর্যন্ত প্রগতির এমডি ছিলেন আব্দুল ওয়াহেদ।


প্রগতিতে তাঁর প্রভাব খাটানো নিয়ে প্রধানমন্ত্রী দপ্তর, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ও দুর্নীতি দমন কমিশনে বেশ কিছু অভিযোগও জমা পড়েছে। 


আব্দুল ওয়াহেদের যত বিতর্কিত কার্যক্রম

প্রগতির পরিচালক হিসেবে আছেন মো. ইয়াসির আরাফাত। প্রগতির ওয়েবসাইটে এই পরিচালকের পরিচয় দেওয়া আছে প্রযুক্তিবিদ ও সমাজসেবক হিসেবে। প্রকৃতপক্ষে তিনি একজন ঠিকাদারি ব্যবসায়ী। শিল্পমন্ত্রীর পিএস আব্দুল ওয়াহেদের ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুবাদে প্রগতির পরিচালক হন ইয়াসির আরাফাত। শিল্প মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন করপোরেশনের কাজ আরাফাত বাগিয়ে নিচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।    


প্রগতির ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা ও বগুড়া সার্ভিস সেন্টারের জন্য আউটসোর্সিং পদ্ধতিতে ৩৫ জন মেকানিক নিয়োগের জন্য পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছিল ২০২২ সালে। এই কাজের জন্য একক দরদাতা হিসেবে ইয়াসির আরাফাতের প্রতিষ্ঠান মেসার্স আরাফাত কনস্ট্রাকশনকে নিয়োজিত করার সিদ্ধান্ত অনুমোদন করে প্রগতির পরিচালনা পর্ষদ।


প্রগতির কারখানা, সিবিএ, আমদানি-রপ্তানিসহ সব প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড চট্টগ্রামকেন্দ্রিক। অভিযোগ রয়েছে, এরপরও আব্দুল ওয়াহেদ ও আরাফাত প্রগতির হেড অফিস ঢাকায় স্থানান্তরের চেষ্টা করেন। ঢাকা অফিসের সংস্কারের নামে একটি সার্ভিস সেন্টার স্থাপনের জন্য ১০ কোটি টাকা খরচ অনুমোদনের প্রস্তাব কোম্পানি বোর্ডে উপস্থাপন করেন। অথচ এই খাতে সর্বোচ্চ ১ কোটি টাকা ব্যয় যথেষ্ট ছিল বলে একাধিক কর্মকর্তা আজকের পত্রিকাকে জানিয়েছেন। মন্ত্রীর পিএসের প্রভাবে প্রস্তাবিত এই ব্যয় অনুমোদনও করেছে কোম্পানির বোর্ড। এখন ইয়াসির আরাফাতের মালিকানাধীন আরাফাত কনস্ট্রাকশনের মাধ্যমে কাজ করানোর পাঁয়তারা করছে বলে অভিযোগ উঠেছে।


জানা গেছে, প্রগতির ঢাকা অফিসের জায়গাটিতে প্রায় ২৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি আধুনিক ওয়ার্কশপসহ ১৪ তলা বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণের জন্য ডিপিপি শিল্প মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। এমন অবস্থায় নতুন করে ১০ কোটি টাকা ব্যয়ে আরেকটি প্রকল্প কার স্বার্থে নেওয়া হয়েছে, সেটি নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে সংশ্লিষ্টমহলে।


অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে মো. ইয়াসির আরাফাত বলেন, ‘প্রগতির এক লোক ভুল বুঝিয়ে প্রগতির ঠিকাদার হিসেবে আমার প্রতিষ্ঠানের নাম নেয়। কিন্তু পরে বুঝতে পেরে নামটি সরিয়ে নিই।’


ইয়াসির আরাফাত নাম সরিয়ে নেওয়ার বিষয়টি দাবি করলেও জনবল নিয়োগের ঠিকাদারি কাজটি তিনিই পেয়েছেন বলে জানা গেছে। সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে প্রগতির এমডি মোহাম্মদ আজাদ বলেন, ‘আমি নতুন আসছি। আমাকে কেন জড়াচ্ছেন? এই বিষয়ে আমি কোনো মন্তব্য করব না।’


যোগাযোগ করা হলে শিল্প মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী কামাল আহমেদ মজুমদার আব্দুল ওয়াহেদের বিষয়টি ইস্পাত করপোরেশনের চেয়ারম্যানের ওপর ছেড়ে দেন। তিনি আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘ইস্পাত করপোরেশন বিষয়টি দেখবে। প্রগতিতে কী ঘটছে, সেটি আমি জানি না।’


শেয়ার করুন