২১ নভেম্বর ২০২৪, বৃহস্পতিবার, ০৭:৪৩:১৭ অপরাহ্ন
২৪১ কনটেইনারে বিপজ্জনক পণ্য
  • আপডেট করা হয়েছে : ১৩-০৬-২০২২
২৪১ কনটেইনারে বিপজ্জনক পণ্য

দীর্ঘদিন ধরে পড়ে থাকা ২৪১ কনটেইনার বিপজ্জনক পণ্য সরাতে তোড়জোড় শুরু করেছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। এসব পণ্যের মধ্যে দাহ্য ও বিস্ফোরকজাতীয় রাসায়নিক পদার্থ থাকায় যে কোনো সময় তা বিপদের কারণ হয়ে উঠতে পারে। এসব পণ্যে ছোটখাটো অগ্নিকাণ্ডের দুর্ঘটনা ঘটেছে এরই মধ্যে।

গত সপ্তাহে সীতাকুণ্ডের বিএম কনটেইনার ডিপোতে অগ্নিকাণ্ড ও ভয়াবহ বিস্ফোরণের পর নড়েচড়ে বসেছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। দ্রুত এসব পণ্য বন্দর থেকে সরাতে তারা তোড়জোড় শুরু করেছেন। তাগাদা দেওয়া হয়েছে কাস্টমকে। বন্দরের অনুরোধে কাস্টম বিপজ্জনক পণ্যগুলো নিলামে বিক্রি বা ধ্বংসের প্রস্তুতি নিচ্ছে। এরই মধ্যে রাসায়নিকের কয়েকটি চালান স্পট নিলামের মাধ্যমে বিক্রি করা হয়েছে। বন্দর থেকে ডেলিভারি না নেওয়া পণ্য নিলাম বা ধ্বংস করার দায়িত্ব চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজের।

তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বছরের পর বছর এ ধরনের পণ্য বন্দরে পড়ে থাকার মূল কারণ হচ্ছে নিলামে ধীরগতি ও চিঠি চালাচালিতে সময়ক্ষেপণ হওয়া। নিলাম ব্যবসায়ী সমিতির নেতারা বলছেন, প্রচলিত নিলাম প্রথার বাইরে গিয়ে প্রয়োজনে প্রজ্ঞাপন জারি করে বিশেষ উদ্যোগ নিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ এসব পণ্য বন্দর থেকে সরিয়ে ফেলতে হবে।

জানা যায়, বন্দরে পড়ে থাকা বিপজ্জনক পণ্যের মধ্যে ২০-২৫ বছর আগের পণ্যও রয়েছে। তবে ১০-১৫ বছর ধরে পড়ে রয়েছে এমন পণ্যই বেশি। অনেক কনটেইনার জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছে। বেরিয়ে এসেছে ভেতরের মালামাল, যা বন্দরের জন্য ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।

চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজ সূত্র জানায়, তারা বন্দর থেকে ধ্বংস ও নিলামযোগ্য বিপজ্জনক পণ্যের একটি তালিকা পেয়েছে। তাতে দেখা যায়, এ মুহূর্তে ২৪১ কনটেইনারবোঝাই এজাতীয় পণ্য বন্দরের ভেতরে রয়েছে, যা আমদানির পর আর ডেলিভারি নেওয়া হয়নি। এর মধ্যে যেসব পণ্য ব্যবহার উপযোগী, সেগুলো নিলামে তোলা হবে। আর ব্যবহার অনুপযোগী পণ্যগুলো ধ্বংস করা হবে। তবে রাসায়নিক ধ্বংসের প্রক্রিয়াটি বেশ জটিল ও সময়সাপেক্ষ। তাই আপাতত দ্রুত নিলামের দিকেই মনোযোগী হয়ে উঠেছে কাস্টম। পাশাপাশি চলমান রয়েছে ধ্বংসের প্রক্রিয়াও।

কাস্টম হাউজ সূত্রে জানা যায়, বিপজ্জনক পণ্যের মধ্যে ৪৪ কনটেইনার ধ্বংসযোগ্য পণ্য রয়েছে। নিলামে বিক্রির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে ৪১টির। এর বাইরে নিলামযোগ্য কনটেইনার রয়েছে আরও ৪০টি। ইনভেনট্রি হয়নি ৬০টির। ইনভেনট্রি হয়েছে এমন কনটেইনার রয়েছে ৫৫টি। এছাড়া কয়েকটি চালান রয়েছে, যেগুলো কাস্টম হাউজের নথিতে নিলামের পর ডেলিভারি হয়েছে। কিন্তু বন্দর বলছে ডেলিভারি হয়নি। চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজের উপকমিশনার (নিলাম) আলী রেজা হায়দার বলেন, ‘সীতাকুণ্ডের ঘটনার পর বন্দর কর্তৃপক্ষ আমাদের চিঠি দিয়ে কিছু রাসায়নিক দ্রত সরানোর ব্যবস্থা করতে বলেছেন। আমরা এরই মধ্যে দুই কনটেইনার হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড স্পট নিলামের মাধ্যমে বিক্রি করেছি। অন্য যেসব বিপজ্জনক পণ্য রয়েছে, সেগুলোও নিলাম বা ধ্বংসের প্রক্রিয়া চলছে। বন্দর থেকে আমাদের ২৬৫ কনটেইনার বিপজ্জনক পণ্যের তালিকা দেওয়া হয়েছিল। সেখান থেকে ২৪টি কনটেইনার ডেলিভারি দেওয়া হয়েছে। এখনো রয়ে গেছে ২৪১টি।’

চট্টগ্রাম বন্দরে আসা পণ্য একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ডেলিভারি না নিলে কাস্টমস কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করা হয়। আইনি জটিলতা না থাকলে কাস্টম এসব পণ্য নিলামে তোলে। তবে আইনি জটিলতা, নিলামে বিক্রি না হওয়াসহ নানা কারণে খালাস না নেওয়া পণ্য দীর্ঘদিন বন্দরের বিভিন্ন শেড ও ইয়ার্ডে পড়ে থাকে, যা বন্দরের স্বাভাবিক পণ্য হ্যান্ডলিং বাধাগ্রস্ত করে। এসব পণ্যের মধ্যে বিভিন্ন সময় আমদানি করা বেশকিছু কেমিক্যাল, দাহ্য ও তেজস্ক্রিয় পদার্থ রয়েছে।

২০২০ সালের ৪ আগস্ট লেবাননের বৈরুত বন্দরে ভয়াবহ বিস্ফোরণে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। এতে প্রায় দেড়শ জন নিহত ও দুই হাজারের বেশি মানুষ আহত হন। ওই ঘটনার পর চট্টগ্রাম বন্দর বিপজ্জনক পণ্য সরাতে তৎপর হয়ে ওঠে। তখন তালিকা তৈরি করে কিছু পণ্য ধ্বংস করা হয়। নিলামে বিক্রি করা হয় আরও কিছু। এরপরও কিছু পণ্য থেকে যায় বন্দর অভ্যন্তরে। এছাড়া নতুন করে আমদানি করা বিপজ্জনক পণ্যও অনেকে ডেলিভারি নেননি। এভাবে বন্দরে বাড়তে থাকে বিপজ্জনক পণ্যের মজুত। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মো. ওমর ফারুক যুগান্তরকে বলেন, ‘ডেলিভারি না নেওয়া বিপজ্জনক পণ্যসহ অন্যান্য পণ্য নিলামে বিক্রি করে দিতে আমরা কাস্টমকে প্রতিমাসেই চিঠি দিই। তারা কিছু নিলাম করে। আবার নতুন করে কিছু পণ্য জমেও যায়।’ সংশ্লিষ্টরা জানান, চট্টগ্রাম বন্দরের ১৪টি শেডের মধ্যে ‘পি’ শেডে বিপজ্জনক পণ্যগুলো রাখা হয়। এখানে ড্রাম, কার্টন ও বস্তাবোঝাই বিপজ্জনক পণ্য পড়ে রয়েছে। এর মধ্যে আছে সালফেট, হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড, সালফিউরিক অ্যাসিড, ফায়ার এক্সটিংগুইশার, থিনার, সোডিয়াম সালফেট, মিথানল, ইথাইল হেক্সানল, নাইট্রিক অ্যাসিড, ক্যালসিয়াম অক্সাইড, ফার্মাসিউটিক্যালসের কাঁচামাল, রং তৈরির কাঁচামাল, টেক্সটাইল কাঁচামালসহ নানা ধরনের রাসায়নিক পণ্য। যার বেশির ভাগই দাহ্য ও বিস্ফোরকজাতীয়। এসব পণ্য সরানো না হলে যে কোনো সময় অগ্নিকাণ্ড কিংবা বিস্ফোরণ থেকে ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। এখন পর্যন্ত চট্টগ্রাম বন্দরে রাসায়নিক থেকে বড় ধরনের দুর্ঘটনা না ঘটলেও বেশ কটি ছোটখাটো ঘটনার নজির রয়েছে। সর্বশেষ গত মঙ্গলবার বন্দর ইয়ার্ডে চার বছর ধরে পড়ে থাকা অ্যাসিডবোঝাই একটি কনটেইনার থেকে ধোঁয়া বের হলে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। বন্দর কর্তৃপক্ষ দ্রুত কনটেইনারটি নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিতে সক্ষম হয়। ১৩ মে ব্যাটারি ও ইলেকট্রনিক পণ্যবোঝাই একটি কনটেইনারে অগ্নিকাণ্ড ঘটে। এতে কনটেইনারের ভেতরে থাকা পণ্য পুড়ে যায়। ২০২০ সালের জুনে অগ্নিদুর্ঘটনায় বন্দরের একটি শেড ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ২০১৫ সালের ২২ এপ্রিল নিউমুরিং টার্মিনাল চত্বরে মিথানলভর্তি ড্রামে বিস্ফোরণ ঘটলে চার শ্রমিক আহত হন।

শেয়ার করুন