২১ নভেম্বর ২০২৪, বৃহস্পতিবার, ০৯:৩৪:৪০ অপরাহ্ন
মার্জিন ঋণ ঝুঁকি বাড়াচ্ছে শেয়ারবাজারে
  • আপডেট করা হয়েছে : ০১-১০-২০২৩
মার্জিন ঋণ ঝুঁকি বাড়াচ্ছে শেয়ারবাজারে

মন্দা শেয়ারবাজারে আবারও গলার কাঁটা হতে যাচ্ছে মার্জিন ঋণ। ফ্লোর প্রাইসের (নিম্নসীমা) কারণে বিনিয়োগকারীরা শেয়ার বিক্রি করতে পারছেন না। কিন্তু ঋণের সুদ বাড়ছে। ফলে যেসব বিনিয়োগকারী ঋণ নিয়ে বিনিয়োগ করেছেন, তারা সবচেয়ে বিপদে। সমস্যায় রয়েছে ঋণ দেওয়া মার্চেন্ট ব্যাংক ও ব্রোকারেজ হাউজগুলোও। অর্থাৎ প্রাতিষ্ঠান ও ব্যক্তি উভয় পক্ষকেই নিঃস্ব করছে মার্জিন ঋণ। দিনদিন পরিস্থিতি আরও খারাপ হচ্ছে। সামগ্রিকভাবে বাজারের জন্যও বড় ধরনের ঝুঁকি সৃষ্টি করছে।


সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, বর্তমানে বাজারে মার্জিন ঋণ ১৫ হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি। বিভিন্ন সময়ে বাজার অতিমূল্যায়িত হওয়ার ক্ষেত্রেও এই ঋণ দায়ী। কারণ, মৌলভিত্তির বাইরে দুর্বল কোম্পানিতেও ঋণ নিয়ে কারসাজি হয়। আর নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) বলছে তারা উচ্চ সুদে মার্জিন ঋণ নিরুৎসাহিত করছে।


অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এই ঋণ বাজারে উপকারের চেয়ে ক্ষতি করে বেশি। আর বাংলাদেশের মতো দুর্বল বাজারের জন্য এটি মাত্রাতিরিক্ত ঝুঁকিপূর্ণ। জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, যত দূর সম্ভব ঋণ না করেই পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করা উচিত। কারণ, যেসব বিনিয়োগকারী ঋণ নিয়েছে, তারাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কিন্তু ঋণের বাইরে থাকা বিনিয়োগকারীরা তাদের পুঁজি সম্পূর্ণভাবে হারায়নি। ফলে ঋণের ব্যাপারে সব সময় সতর্ক থাকা উচিত।


তিনি বলেন, পুঁজিবাজারে ঝুঁকি থাকবেই। ঋণ না করে সঞ্চিত অর্থ থেকে বিনিয়োগ করা ভালো। যারা মার্জিন ঋণ নেন, তারা লোভে পড়ে নেন। দরপতনে তারাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন।


প্রসঙ্গত, গ্রাহককে শেয়ার কিনতে মার্চেন্ট ব্যাংক এবং ব্রোকারেজ হাউজ থেকে যে ঋণ দেওয়া হয়, একে মার্জিন ঋণ বলে। গ্রাহককে দেওয়া ঋণের অর্থও আবার সংশ্লিষ্ট ব্রোকারেজ হাউজ অন্য কোনো উৎস থেকে ঋণ হিসাবে নেয়। ফলে গ্রাহকের কাছ থেকে অর্থ ফেরত না পেলেও তাদেরকে ওই ঋণ পরিশোধ করতে হচ্ছে। এ কারণে দাম কমে গেলে গ্রাহকের শেয়ার তারা ফোর্সড সেল (বাধ্যতামূলক বিক্রি) করে। বর্তমানে মার্জিন ঋণের এই হার ১ ঃ ০.৮। এর অর্থ হলো কোনো গ্রাহকের ১০০ টাকা থাকলে সংশ্লিষ্ট ব্রোকারেজ হাউজ থেকে আরও ৮০ টাকা ঋণ নেওয়া যাবে। যদিও বর্তমানে এই মাত্রা তুলনামূলকভাবে কিছুটা সহনীয়। কিন্তু ২০১০ সালে গ্রাহকের বিনিয়োগের বিপরীতে দশগুণ পর্যন্ত ঋণ দিয়েছিল বিভিন্ন ব্রোকারেজ হাউজ। এর ফলে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, তা পুরো দেশের অর্থনীতিকে বিপর্যস্ত করে দিয়েছে।


জানতে চাইলে বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ রেজাউল করিম যুগান্তরকে বলেন, দীর্ঘমেয়াদে মার্জিন ঋণ বিনিয়োগকারীদের জন্য ইতিবাচক নয়। কারণ, এই ঋণের সুদ বেশি। বিশ্বব্যাপী এই ঋণ নিরুৎসাহিত করা হয়। তিনি বলেন, ২ থেকে ৮ অক্টোবর বিশ্ব বিনিয়োগ সপ্তাহ পালন হবে। সেখানে আমরা বিভিন্ন সেমিনার সিম্পোজিয়ামের মাধ্যমে বিনিয়োগকারীদের মার্জিন ঋণের মতো উচ্চ সুদে বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত করব।


জানা যায়, চলমান ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে দরপতন ঠেকাতে গত বছরের ২৮ জুলাই পুঁজিবাজারে দ্বিতীয়বারের মতো ফ্লোর প্রাইস দেয় বিএসইসি। এখনো সেটি বহাল আছে। এর ফলে বর্তমানে ২ শতাধিক কোম্পানির লেনদেন আটকে আছে। অর্থাৎ তারা শেয়ার বিক্রি করতে পারছে না। এতে যারা ঋণ নিয়ে বিনিয়োগ করেছেন, তারা বেশি বিপদে। একদিকে তারা শেয়ার বিক্রি করতে পারছে না, অপরদিকে সুদ বাড়ছে। অর্থাৎ সুদ-আসল মিলিয়ে বড় অঙ্কের দায়ে পড়তে যাচ্ছে তারা। পাশাপাশি মার্চেন্ট ব্যাংক ও ব্রোকারেজ হাউজ তাদের ঋণের টাকা আদায়ে শেয়ার ফোর্সড সেল করতে পারছে না। এতে ১৫ হাজার কোটি টাকার মতো বিনিয়োগ আটকে আছে। বর্তমানে ১৫ থেকে ১৭ শতাংশ পর্যন্ত সুদ নেওয়া হচ্ছে।


সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, নির্বাচন সামনে রেখে বাজারে অস্থিরতার আশঙ্কায় ফ্লোরপ্রাইস তুলে নেওয়ার আপাতত কোনো সম্ভাবনা নেই। নির্বাচনের পর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে ফ্লোর প্রাইস তুলে নেওয়ার কথা ভাববে বিএসইসি। ফলে অনির্দিষ্টকালীন পর্যন্ত বিনিয়োগকারীদের অপেক্ষা করতে হবে, যা পুরো বাজারের জন্য অনেক বড় দায় তৈরি করবে।


জানতে চাইলে বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমবিএ) সভাপতি মো. ছায়েদুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, বাজারে মার্জিন ঋণের পরিমাণ কত তা বলা কঠিন। কারণ, প্রতিষ্ঠানগুলো আমাদের অ্যাসোসিয়েশনকে এ তথ্য দেয় না। তবে ব্রোকারেজ হাউজ এবং মার্চেন্ট ব্যাংক উভয় প্রতিষ্ঠান বিএসইসিতে এ বিষয়ে রিপোর্ট করে।


জানা যায়, শেয়ারবাজারে লেনদেন করছে-বতর্মানে এমন ব্রোকারেজ হাউজের সংখ্যা ২৪০টি। এর মধ্যে গ্রাহককে মার্জিন ঋণ দিয়েছে-এমন হাউজের সংখ্যা ১০০টির মতো। মোট বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ ১৫ হাজার কোটি টাকার বেশি। সামগ্রিকভাবে ঋণের হার গ্রাহকের বিনিয়োগের ১৫ শতাংশের মতো। তবে মোট ঋণের ৬০ শতাংশই শীর্ষ দশটি হাউজে। অন্যদিকে ২০১০ সাল থেকে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মার্জিন ঋণে বিনিয়োগকারীরা। ওই সময়ে ঋণ নিয়ে যারা বিনিয়োগ করেছিল, তাদের সব পুঁজি হারানোর পরও হাউজগুলো তাদের কাছে টাকা পাবে। সেই টাকার বিষয়টি এখনো নিষ্পত্তি হয়নি। এর মধ্যে নতুন ঋণ আরও বাড়ছে।


জানা যায়, বর্তমানে বাংলাদেশের শেয়ারবাজারে লেদদেনযোগ্য বিও অ্যাকাউন্টের সংখ্যা ১৭ লাখ ৫০ হাজার। এসব বিও অ্যাকাউন্টে মোট শেয়ার সংখ্যা ৯ হাজার ৬৮১ কোটি। আর এসব শেয়ারের সর্বশেষ বাজারমূল্য ৩ লাখ ৯৬ হাজার কোটি টাকা। যদিও বর্তমানে বাজারমূল্যের তুলনায় মার্জিন ঋণ অনেক। কিন্তু শেয়ার বিক্রি করতে না পারায় সুদ ও আসল মিলিয়ে দিনদিন ঋণের অঙ্ক বাড়ছে।


এদিকে আন্তর্জাতিকভাবেও মার্জিন ঋণ নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। মার্জিন ঋণের ভয়াবহতা নিয়ে ২০১৭ সালে একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে মার্কিন কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভ। ওই প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে, বাজার উত্থানপতনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শক্তি হলো মার্জিন ঋণ। একই বিষয়ে আরেকটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে জার্মানির ইউনিভার্সিটি অব মুয়েনস্টার। ওই প্রতিবেদনে মার্জিন ঋণকে বাজারের জন্য অভিশাপ হিসাবে দেখানো হয়। এতে বলা হয়, আর্থিকভাবে শক্তিশালী বিনিয়োগকারীরা মার্চেন্ট ব্যাংকের সঙ্গে আঁতাত করে বেশি পরিমাণে ঋণ নেয়। এর ফলে তারা ইচ্ছামতো দুর্বল মৌলভিত্তির শেয়ার নিয়ে কারসাজি করে।


আর বাজার ধীরে ধীরে অতিমূল্যায়িত হয়। এরপর বাজারে মূল্য সংশোধন হলে তুলনামূলকভাবে কম পুঁজির সাধারণ বিনিয়োগকারীরা চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বাংলাদেশেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। পুঁজিবাজারের ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারীদের আর্থিক সহায়তা দেওয়ার লক্ষ্যে ২০১১ সালে গঠিত স্কিম কমিটির হিসাবে দেখা যায়, দেশের শেয়ারবাজারে মার্জিন ঋণ নিয়ে ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন-এমন বিনিয়োগকারীর সংখ্যা ৬ লাখ ৬৯ হাজার। তাদের মোট ক্ষতির পরিমাণ ১০ হাজার ৭০ কোটি টাকা।


শেয়ার করুন