২৫ জুন যেন এক স্বপ্নের বাস্তবায়নের দিন। যে স্বপ্নটা দেখা শুরু হয়েছিল ২০১৪ সালের ৭ ডিসেম্বর পদ্মা সেতুর কাজ শুরুর মাধ্যমে। আগামী ২৫ জুন পদ্মা সেতু উদ্বোধন সেই স্বপ্নই ছুঁয়ে যাবে। ২৬ জুন থেকে সেতুটি খুলে দেওয়া হবে সর্বসাধারণের জন্য।
দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলতো বটেই, গোটা দেশই সেই মাহিন্দ্রক্ষণের অপেক্ষায়। লাখ লাখ মানুষ অপেক্ষার প্রহর গুনছে কখন স্বপ্ন ছুঁয়ে সেই সেতুর উপর দিয়ে পদ্মা পাড়ির অভিজ্ঞতা নেবে।
এদিকে সারাদেশের মানুষ যখন পদ্মা সেতুর উপর দিয়ে যাতায়াতের স্বপ্নে বিভোর তখন সেতুকে ঘিরে আশপাশ জেলার মানুষেরা স্বপ্ন দেখছেন নিজেদের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির। সেতু ঘিরে উঁকি দিচ্ছে পর্যটনের বিপুল সম্ভাবনা। ভ্রমণপ্রেমীদের জন্য হোটেল, রেস্টুরেন্ট, রিসোর্ট গড়ে উঠছে পদ্মার দুই পাড়েই। আগামী দিনগুলোতে পর্যটন আকৃষ্ট করতে পদ্মা সেতুর দুই পাড় নানাভাবে সাজবে বলে জানা গেছে।
পদ্মা পাড় ঘুরে এবং স্থানীয় মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতিদিনই এই এলাকায় মানুষের আনাগোনা বাড়ছে। সামনে এই সেতু পুরো খুলে দিলে সেই সংখ্যা আরও বেড়ে যাবে। বিশেষ করে শুক্র- শনিবারসহ ছুটির দিনগুলোতে উৎসবের কেন্দ্রবিন্দু হবে পদ্মা সেতুর দুই পাড়। হাজার হাজার মানুষের ঢল নামবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
মাওয়া ঘাটের স্থানীয় বাসিন্দা হাফিজুর রহমান বলেন, ‘এখনইতো প্রতি রাতে ঘাটে তিন থেকে পাঁচ হাজার লোক আসা-যাওয়া করে। শুক্রবারে ঘাটে আট থেকে ১০ হাজার মানুষ আসে ইলিশের স্বাদ নিতে। পদ্মা চালু হলে হরহামেশাই ১০ হাজারের বেশি মানুষ থাকতে পারে। ছুটির দিনে তা কয়েকগুণ বাইড়া যাবে।’
প্রায় প্রতিদিনই ঢাকা থেকে বিভিন্ন ট্যুর অপারেটর মাত্র এক হাজার টাকার মধ্যেই একদিনের প্যাকেজে পদ্মা পাড়ের মাওয়া অংশে নিয়ে যায় ভ্রমণপিপাসুদের। পদ্মার পাড় পরিদর্শন, সঙ্গে ইলিশ খাওয়া যুক্ত থাকে সেখানে। বিশেষ করে ছুটির দিনে প্যাকেজগুলো বেশ জমজমাট। এছাড়াও তরুণরাসহ অনেক পরিবারের সদস্যরা রাতের বেলায় ছুটে যায় মাওয়া ঘাটে। সেখানে দিনের মতো সারারাতই থাকে ইলিশের নানা আয়োজন।
মাওয়া প্রান্ত থেকে শুধু সেতু দেখতেই প্রতিদিন ৪০টি স্পিডবোট ছেড়ে যায়। শুক্র ও শনিবার স্পিড বোর্ডে সিরিয়ালই মেলে না সহজে। যদিও সেতুর নিরাপত্তার স্বার্থে কাছে ঘেঁষতে দেওয়া হয় না।
মাওয়া ঘাট পাড়ে অনেকেই পেশায় এনেছেন বৈচিত্র্য। তারা কেউ খেলনা বিক্রি করেন, কেউ বেচেন নানা ধরনের ভাসমান খাবার। বলতে গেলে প্রতিদিন বিকেলের দিকে যেন একটি মেলা বসে ঘাটপাড়ের আশপাশ এলাকায়। ইতোমধ্যেই সংযোগ সড়কে বিনোদনকেন্দ্র নির্মাণের দৃশ্যও দেখা গেছে। সামনের দিনগুলোতে মানুষের আনাগোনা বাড়বে, সেই সাথে ভিড় সামলাতে অনেকেই এসব বিনোদনকেন্দ্রে আসবেন, সে হিসেবে এসব উদ্যোগ নিচ্ছেন স্থানীয়রা।
পদ্মা সেতু ঘিরে দুই পাড়ের সংযোগ সড়কের উভয় পাশেই পর্যটকদের জন্য বিনোদনকেন্দ্র, বিভিন্ন খাবারের দোকান, চা-কফি শপ গড়ে উঠতে দেখা গেছে। অনেকগুলোতে কাজ চলছে দ্রুতগতিতে।
শরীয়তপুরের বাসিন্দা আমানত উদ্দিন বলেন, ‘রাস্তার ধারে যাদের জায়গা সেই জায়গা এখন সোনার চেয়েও দাম। অনেকেই নিজেই দোকানের প্রস্তুতি নিচ্ছে, কেউ জমি লিজ দিতাছে।’
জানা গেছে, দেশের বিভিন্ন স্থানের ব্যবসায়ীরা কেউ উচ্চমূল্যে জমি কিনে ব্যবসার উদ্যোগ নিচ্ছেন, কেউ ব্যক্তিগত জমি চুক্তিতে নিচ্ছেন কয়েক বছরের জন্য। ফরিদপুরের ভাঙ্গার চাররাস্তা মোড়ে গোলচত্বরে নির্মাণ করা হয়েছে দর্শনার্থীদের জন্য আকর্ষণীয় বিভিন্ন স্পট।
‘শরীয়তপুর সুপার সার্ভিস’ নামে নতুন বাস নামাচ্ছেন শরীয়তপুর বাস মালিক সমিতির ২৪ জন সদস্য। প্রাথমিকভাবে ২৪টি বাস যেগুলো সরাসরি শরীয়তপুর থেকে পদ্মা সেতু হয়ে ঢাকা যাবে। বাসগুলোর নির্মাণ কাজ চলছে। পদ্মা সেতু চালুর সাথে সাথে তাদের বাসও চলাচল শুরু করবে বলে জানা গেছে। আগামী ২৬ জুন থেকে চালানো শুরু করতে চায় শরীয়তপুর সুপার সার্ভিস।
এ ব্যাপারে শরীয়তপুর বাস মালিক সমিতির সভাপতি ফারুক আহমদ তালুকদার জানিয়েছেন, শরীয়তপুরবাসীর জন্য স্বপ্নের মতো ঘটনা পদ্মা সেতু চালু হওয়া। প্রধানমন্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞ এখানকার সব মানুষ।
আঞ্চলিক সড়কপথের সংস্কার ও উন্নয়ন নিয়ে শরীয়তপুরের জেলা প্রশাসক মো. পারভেজ হাসান বলেন, আজকের পদ্মা সেতু প্রধানমন্ত্রীর সাহসের প্রতিফলন। আমাদের এ অঞ্চলের উন্নয়নকে আর কেউ দাবিয়ে রাখতে পারবে না। এখানে বেশ কিছু অ্যাগ্রো-নির্ভর ইন্ড্রাস্ট্রি স্থাপনের চেষ্টা করা হচ্ছে। মৃৎশিল্প, কাঁচ শিল্প আগে থেকেই আছে। আর ইপিজেড হলে তো কোনো কথাই নেই। অনেক মানুষের কর্মসংস্থান হবে।
জেলা প্রশাসক জানান, সেতুর পাশাপাশি এই অঞ্চলের সড়কপথের সংস্কার ও উন্নয়ন খুবই জরুরি। তবেই আমরা সেতুর সুবিধাটা নিতে পারব। পদ্মা সেতু থেকে ফরিদপুরের ভাঙ্গা পর্যন্ত রাস্তা আছে। শরীয়তপুর পর্যন্ত ভালো রাস্তা ছিল না। এখন ফোরলেনের কাজ শুরু হয়েছে। এই রাস্তা শেষ হলে সবাই শরীয়তপুরের ওপর দিয়ে যাতায়াত করবে। মোংলা পোর্টগামী গাড়িকেও শরীয়তপুরের সড়কে উঠতে হবে। শরীয়তপুরের মানুষ সুবিধা নিতে প্রস্তুত।
জাজিরা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মোবারক আলী সিকদারের মতে, উন্নয়নের দিক থেকে আগে থেকেই পিছিয়ে থাকা এই জেলাটির অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির সুযোগ সৃষ্টি করেছে পদ্মা সেতু। সে কারণে অর্থনৈতিক জোন হিসেবে গড়ে উঠতে যাচ্ছে। দীর্ঘদিনের মানুষের নৌপথে পদ্মা পার হওয়ার দুর্বিষহ ভোগান্তির অবসান ঘটতে যাচ্ছে।
মোবারক আলী সিকদার আরও জানান, মানুষ লঞ্চে করে, নৌকায় করে, স্টিমারে করে ঢাকায় যেত। এখানে কল-কারখানা না থাকায় কর্মসংস্থানেরও অনেক অভাব। পদ্মা সেতু চালু হওয়ার খবরে শরীয়তপুরবাসী তথা জাজিরাবাসী অনেক আনন্দিত। এখন আমাদের এলাকার জায়গা জমির দাম অনেক বেড়েছে। পাশাপাশি ব্যক্তি উদ্যোগে বিভিন্ন ব্যবসায়ী এখানে জায়গা কিনেছেন। সেতু চালু হওয়ার পর এখানে কলকারখানা হোটেল-মোটেল গড়ে ওঠবে। সেখানে এই অঞ্চলের মানুষ কাজ করলে তাদের অর্থনৈতিক চাকা ঘুরবে।
ফরিদপুর আলফাডাঙ্গা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এ কে এম জাহিদুল হাসান জাহিদ জানান, এই পদ্মা সেতু দক্ষিণাঞ্চলের সাথে ঢাকা শহরের সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন করবে। আগে ১০-১২ ঘণ্টা সময় লাগলেও আমাদের এখান থেকে সেতু দিয়ে ঢাকা যেতে সময় লাগবে আড়াই থেকে তিন ঘণ্টার মতো। সেতু চালু হলে অনেকেই বাড়ি থেকে গিয়েও ঢাকায় অফিস করবেন।
জাহিদ বলেন, আমাদের পাশের জেলা গোপালগঞ্জ। সেখানে কলকারখানা ও ইপিজেড হবে। আমাদের এখানকার লোকজনের কর্মসংস্থান হবে। তারা বাড়ি থেকে গিয়েই কারখানায় কাজ করতে পারবে। এতে আমাদের অঞ্চলের মানুষ আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হবে।
ফরিদপুরের সাধারণ মানুষও বেশ উচ্ছ্বসিত। তারা মনে করছেন ভাগ্যের চাকা ঘুরতে শুরু করেছে তাদের দিকে। অর্থনৈতিক উন্নয়নে তাদের জীবনমান আরও পাল্টে যাবে।
যানবাহন চলাচলের স্বপ্নের পদ্মা সেতু হতে যাচ্ছে দেশের সড়ক যোগাযোগে এক নতুন দিগন্ত। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে এই সেতু বড় ভূমিকা রাখবে বলে আশা সংশ্লিষ্টদের। আর ভ্রমণপিপাসুদের নতুন ঠিকানা হতে যাচ্ছে এটি।