০২ মে ২০২৪, বৃহস্পতিবার, ০৮:১১:২০ অপরাহ্ন
যতভাবে ডুবছে ঢাকা
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৭-১০-২০২৩
যতভাবে ডুবছে ঢাকা

উড়ালসড়ক, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, মেট্রোরেল—গতিশীল নগরজীবনের এই তিন অনুষঙ্গ থাকলেও রাজধানী ঢাকা এখন বিশ্বের সবচেয়ে ধীরগতির শহর। বিশ্বে পঞ্চম শীর্ষ যানজটের এই নগর বায়ু ও শব্দদূষণে প্রথম। স্বাস্থ্যসেবা, দূষণ, জীবনমান, ঘনবসতি, টেকসই ও বসবাসের অযোগ্য শহরের সূচকেও তালিকার তলানিতে অবস্থান ঢাকার। বছর বছর ফুটপাত ও সড়ক বিভাজক ভাঙা-গড়া, সড়কে কার্পেটিং, একের পর এক উন্নয়নেও ১০ নেতিবাচক সূচকে ঢাকার অবস্থান নিচের দিকেই রয়ে গেছে।


বিশেষজ্ঞ ও নগর-পরিকল্পনাবিদেরা বলছেন, ঢাকায় উন্নয়ন হলেও পরিবেশ ও মানুষের জীবন গুরুত্ব পায়নি। শুধু অবকাঠামো করে জীবনমান উন্নয়ন সম্ভব নয়, উল্টো কিছু অবকাঠামো নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের সমন্বয়হীনতা ভোগান্তি বাড়াচ্ছে। ফলে অধিকাংশ নেতিবাচক সূচকে ঢাকা প্রথম সারিতে।


নগর-পরিকল্পনাবিদ আদিল মুহাম্মদ খান আজকের পত্রিকাকে বলেন, ঢাকায় সড়ক যোগাযোগে নেওয়া প্রকল্পগুলোর সুফল কি নাগরিকেরা পেয়েছে? মেগা প্রকল্পের বাইরে গিয়ে ট্রাফিক ব্যবস্থার সংস্কার দরকার। ঢাকার ওপর চাপ কমানো দরকার। তিনি বলেন, প্রকল্পের ওপর নির্ভর না করে প্রথমত গণপরিবহনের ওপর জোর দিতে হবে, ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। একই সঙ্গে দুই সিটি করপোরেশনকে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে।


যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ব্যুরো অব ইকোনমিক রিসার্চের গবেষণা প্রতিবেদন বলছে, বিশ্বের সবচেয়ে ধীরগতির শহর এখন ঢাকা। গবেষণায় ১৫২ দেশের ১ হাজার ২০০টির বেশি শহরে যানবাহন চলাচলের গতি বিশ্লেষণ করা হয়েছে। সবচেয়ে ধীরগতির তালিকায় ঢাকার পরের অবস্থান নাইজেরিয়ার দুটি শহরের। শীর্ষ ২০ ধীরগতির শহরের তালিকায় বাংলাদেশের আরও দুটি শহর জায়গা পেয়েছে। তালিকায় ময়মনসিংহ নবম এবং চট্টগ্রাম ১২তম।


বাংলাদেশের শহরগুলোর ধীরগতির কারণ হিসেবে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঢাকায় চলাচলে যে সময় লাগে, দ্রুতগতির শহরে একই দূরত্বে চলাচলে সময় লাগে এর তিন ভাগের এক ভাগ। তবে বাংলাদেশের শহরগুলোর তুলনায় অন্য দেশের একই আয়তনের শহরে জনসংখ্যা ৪০ শতাংশ হলেও বড় সড়ক ৪২ শতাংশ বেশি।


বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সাম্প্রতিক এক জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঢাকাবাসীর প্রতি দুই ঘণ্টার যাত্রাপথে ৪৬ মিনিটই কাটে যানজটে। এতে অতিরিক্ত সময় নষ্ট হয় এবং কাজে ব্যাঘাত ঘটে।


যানজটের সূচকে বিশ্বে ঢাকার অবস্থান চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে ছিল ৫ নম্বরে। এই তথ্য সার্বিয়াভিত্তিক বৈশ্বিক তথ্যশালা নামবিউর ওয়েবসাইটের। বিশ্বের কোনো শহর অবকাঠামো তৈরি করে যানজট নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি বলে জানান যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক মো. হাদীউজ্জামান। তিনি বলেন, ঢাকা শহরে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা নিয়ে শক্তিশালী নীতিমালা নেই। যানজট নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব যেসব সংস্থার, তারা সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করছে না। রাজধানীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সংস্থাকে বিকেন্দ্রীকরণের সময় এসেছে।


এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্সের (একিউআই) তথ্য অনুসারে, বিশ্বে শীর্ষ বায়ুদূষণের শহরের তালিকায় প্রায়ই শুরুর দিকে থাকে ঢাকা। তবে শীত মৌসুমে চলে আসে শীর্ষে। জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচির (ইউএনইপি) ২০২২ সালে প্রকাশিত বৈশ্বিক প্রতিবেদন বলছে, শব্দদূষণেও বিশ্বে শীর্ষ স্থানে ঢাকা। দ্বিতীয় ও তৃতীয় যথাক্রমে ভারতের উত্তর প্রদেশের মুরাদাবাদ ও পাকিস্তানের ইসলামাবাদ। এদিকে দূষিত শহরের সূচকে ঢাকার অবস্থান বিশ্বে ষষ্ঠ।


বাসযোগ্য শহরের তালিকায়ও ঢাকার অবস্থান শেষের দিকে। গত জুনে প্রকাশিত ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (ইআইইউ) তথ্য অনুযায়ী, বাসযোগ্য শহরের তালিকায় ঢাকার অবস্থান ১৬৬তম। এই তালিকায় স্থান পেয়েছে বিশ্বের ১৭৩টি শহর। গত বছরও একই অবস্থান ছিল। চলতি বছর কানাডার গবেষণা সংস্থা করপোরেট নাইটের টেকসই শহরের সূচকে ঢাকার অবস্থান ৭০টি শহরের মধ্যে ৬৩তম। এই সূচকে সবার নিচে ৭০তম পাকিস্তানের করাচি। শীর্ষ স্থানে সুইডেনের স্টকহোম। ম্যাক্রোট্রেন্ডসের মেট্রো এরিয়া র‍্যাঙ্কিং-২০২৩ অনুযায়ী, ঢাকা পৃথিবীর চতুর্থ ঘনবসতিপূর্ণ শহর।


স্থপতি ইকবাল হাবিব আজকের পত্রিকাকে বলেন, রাজধানী ঢাকায় ধারণক্ষমতার চেয়ে অনেক বেশি মানুষ বসবাস করে। এই শহরে দেশের সবচেয়ে বেশি মানুষ, যানবাহন ও কারখানা রয়েছে। ফলে এখানে পরিবেশদূষণও বেশি। এসব সংকট থেকে উত্তরণে সঠিক পরিকল্পনা নিতে হবে। মানুষকে সম্পৃক্ত করেই এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হবে।


নামবিউর তথ্য অনুসারে, জীবনের মান সূচকে ঢাকার অবস্থান শেষ দিক থেকে চতুর্থ। শেষ অবস্থানে ফিলিপাইনের ম্যানিলা। জীবনমানের সূচকে সবচেয়ে ভালো নেদারল্যান্ডসের হেগ। স্বাস্থ্যসেবার মানের সূচকে বিশ্বের ২১৫টি শহরের মধ্যে ঢাকার অবস্থান ২১৪। শেষ স্থানটি ভেনেজুয়েলার কারাকাসের।


অপরিকল্পিত উন্নয়নে ঢাকায় পরিবেশদূষণসহ নানা সংকট তৈরি হয়েছে বলে মনে করেন অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার। তিনি আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘অপরিকল্পিত উন্নয়নে পরিবেশ ও মানুষের জীবন গুরুত্ব পায়নি। ফলে শহরে সবুজের পরিমাণ ও জলাধার কমেছে। কংক্রিটের জঞ্জালে বেড়েছে বায়ু ও শব্দদূষণ। বৈশ্বিক নেতিবাচক সূচকগুলো আমাদের বোঝাচ্ছে, ঢাকায় যে উন্নয়ন হচ্ছে, তা কসমেটিক উন্নয়ন।’


নগর পরিকল্পনাবিদেরা মনে করেন, ঢাকাকে দূষণমুক্ত, বাসযোগ্য ও গতিময় করতে সিটি করপোরেশনগুলো দায়িত্বশীল ভূমিকা নিতে পারে। কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে কি না, জানতে চাইলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মিজানুর রহমান মন্তব্য করতে রাজি হননি। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সেলিম রেজা আজকের পত্রিকাকে বলেন, ঢাকা শহরের পরিবেশ রক্ষায় ডিএনসিসি আন্তরিকভাবে কাজ করছে। যানজট নিরসনে স্কুল বাস সার্ভিস, ডিজিটাল ট্রাফিক সিস্টেমসহ নানা উদ্যোগ নিয়েছে। এ ছাড়া সরকারের চলমান মেগা প্রকল্পের কাজ শেষ হলে শহরের যানবাহনের গতি আরও বেড়ে যাবে।


শেয়ার করুন